সামর্থ্যবান হয়েও যে কোরবানি করলো না, সে যেন ঈদগাহে না আসে
করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যে উদ্যাপিত হতে চলা এবারের কোরবানির ঈদ বিশেষভাবে আলাদা। আনন্দের মাঝে দেখা দিয়েছে নানা শঙ্কা, জনমনে রয়েছে নানা প্রশ্ন। কোরবানির পশু কেনা থেকে শুরু করে পশু জবাই ও খাদ্য গ্রহণের প্রতিটি স্তরে স্বাস্থ্য সতর্কতা মেনে চলা যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে নানা বিভ্রান্তি।
এ অবস্থায় কোরবানিকে আরও সুন্দর ও পরিপূর্ণ করতে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে কোরবানি বিষয়ক নানা প্রশ্নের সমাধান নিয়ে কথা হয়েছে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা আবু রুফাইদাহ রফিকের সাথে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন- আবদুর রহমান
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কাদের কোরবানি করা আবশ্যক?
আবু রুফাইদাহ রফিক: কোরবানির মূল উদ্দেশ্য মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভ। তাই কোরবানির দিনসমূহে যার কাছে আবশ্যকীয় প্রয়োজন অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকে, তাহলে তার উপর কোরবানি করা আবশ্যক। নেসাব পরিমাণ হল, সাড়ে বায়ান্ন তোলা বা এর সমমূল্য পরিমাণ অতিরিক্ত সম্পদ মজুদ থাকা। যা বর্তমান বাজার অনুপাতে প্রায় চল্লিশ হাজার টাকা। অধিকাংশ আলিমের মতে প্রত্যেক বালেগ, আকেল (পাগল নয় এমন), মুকিম (মুসাফির নয়), সামর্থ্যবান মুসলিমের উপর কোরবানি করা সুন্নতে মুয়াক্কাদা। তবে ইমাম আবু হানিফাসহ কিছু আলিমের মতে কোরবানি ওয়াজিব। তারা এ হাদিসটিকে দলিল হিসেবে গ্রহণ করেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে কোরবানি করলো না, সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ (আহমাদ, ইবনে মাজাহ: হাসান)
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কোন পরিবারে তিনজন সন্তান থাকলে আর সবাই যদি উপার্জনক্ষম হয়। এতে তিনজনের আলাদা সামর্থ্য থাকা সত্বেও যদি তিনজন মিলে বাবার নামে এক অংশ (বাবা বেঁচে আছেন) কোরবানি দেয় তা হবে কিনা?
আবু রুফাইদাহ রফিক: এ কোরবানি বাবার পক্ষ থেকে আদায় হবে। কারণ সন্তানেরা সম্মিলিতভাবে বাবাকে নিজেদের সম্পদের মালিক বানিয়ে দিয়েছে। হাদিসে এসেছে, ‘সন্তান পিতার উপার্জনের অন্তর্ভুক্ত (আহমাদ, তিরমিজি)’। তবে তা সন্তানদের পক্ষ থেকে আদায় হবেনা। এক্ষেত্রে পরিবারের যত প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্যের নিসাব পরিমাণ সম্পদ থাকবে, তাদের প্রত্যেকের উপর আলাদা কোরবানি করা আবশ্যক। শুধু এক অংশ গ্রহণ করার দ্বারা কোরবানির দায়িত্ব মুক্ত হবে না। বরং কোরবানি না করার গোনাহ হবে। তাই পরিবারে যত সদস্যের উপর কোরবানি আবশ্যক, তাদের সকলেরই কোরবানিতে স্বতন্ত্র অংশ রাখতে হবে। বাবার নামে কোরবানি দিলে তাদের দায়িত্ব মুক্ত হবে না। বরং কোরবানি না করার গোনাহ হবে। কুরআনে এই আছে যে, ‘কোন ব্যক্তি কারও বোঝা নিজে বহন করবে না (সূরা নাজম-৩৮)’।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কোন মুসলিম ব্যক্তি এমন দেশে বসবাস করেন যেখানে পশু জবাই করা নিষিদ্ধ, তাহলে তিনি কি কোরবানির পশুর মূল্য সদকা করে দিবেন?
আবু রুফাইদাহ রফিক: সদকা করে দিলে সওয়াব লাভ করা যাবে। তবে সদকা না করলে সমস্যা নেই। আর যদি আপনার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে কোরবানির পশু কিংবা নবজাতকের আকিকার পশু এবং আপনি যে দেশে অবস্থান করছেন সেখানে এটি জবাই করা অসম্ভব হয় তাহলে উত্তম হচ্ছে, আপনি আপনার পক্ষ থেকে অন্য দেশে জবাই করার জন্য অর্থ পাঠিয়ে দিবেন; যেখানে পরিবার-পরিজন রয়েছে কিংবা গরীব-মিসকীন রয়েছে। কেননা কোরবানির পশু বা আকিকার পশু জবাই করা পশুর মূল্য দান করার চেয়ে উত্তম।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কোরবানির পশুর গোশত বণ্টন করার পদ্ধতি; খাওয়ার ক্ষেত্রে ও সদকা করার ক্ষেত্রে সম্পর্কে বলুন।
আবু রুফাইদাহ রফিক: কোরবানির গোশত নিজেরা খাবে, আত্মীয় ও গরীবদেরকে দিবে এবং থাকলে জমা করেও রাখা যাবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা কোরবানির গোশত নিজে খাও এবং দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থকে খাওয়াও (সূরা হজ্জ্বঃ ২৮)’। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) কোরবানির গোশত সম্পর্কে বলেছেন, ‘তোমরা নিজেরা খাও ও অন্যকে আহার করাও এবং সংরক্ষণ কর (বুখারী, হাদীস নং ৫৫৬৯; সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১৯৭১)’। অতএব বুঝা গেল কোরবানির গোশত নিজে খাবে আর অভাবী লোককে দিতে হবে। তবে আশপাশে দরিদ্রের সংখ্যা বেশি হলে তিনদিনের বেশি জমা করে রাখা যাবে না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একই পশু কোরবানি ও আকিকার নিয়তে জবাই করা কি জায়েয হবে?
আবু রুফাইদাহ রফিক: এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায় না, তাই একই পশুতে কোরবানি ও আকিকা দেওয়া ঠিক হবেনা। কারণ দুটি আলাদা আলাদা বিধান। তাছাড়া হাদীসে আকিকা শুধু বকরি দ্বারা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে (নাসায়ী)।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যদি পরিবারের কর্তাব্যক্তি কোরবানি দিতে নারাজ হন সেক্ষেত্রে অন্যকোন সদস্য পরিবারের সবার পক্ষ থেকে কোরবানি দিতে পারবেন?
আবু রুফাইদাহ রফিক: হ্যাঁ পারবেন। পরিবারের কর্তাব্যক্তি যদি ইসলামের এ নিদর্শন পালনে অসম্মতি জ্ঞাপন করে সেক্ষেত্রে স্ত্রী নিজে কিংবা অন্য কোন ব্যক্তির সহায়তায় কোরবানির পশু কেনা ও জবাই করার মাধ্যমে কোরবানি করতে পারেন। এটা তার স্বামীর জ্ঞাতসারে হোক কিংবা অজ্ঞাতসারে হোক; তার স্বামীর অনুমতি নিয়ে হোক কিংবা অনুমতি ছাড়া হোক। কেননা কোরবানি করা সকলের জন্য সুন্নত। পরিবারের কর্তা যদি কোরবানি করতে অসম্মতি জানায়; তাহলে স্ত্রী সেটা পালন করার অধিকার রয়েছে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘হে লোক সকল! নিশ্চয় প্রত্যেক পরিবারের উপর প্রতি বছর কোরবানি রয়েছে...(মুসনাদে আহমাদ, ১৭২১৬) ও (সুনানে আবু দাউদ ২৭৮৮)’।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যিনি কোরবানি করবেন তিনি যদি পুরুষ হন সেক্ষেত্রে তার স্ত্রী-পুত্রদের জন্যে যিলহজ্জ মাস শুরু হওয়ার পর চুল কাটা ও নখ কাটা কি জায়েয হবে?
আবু রুফাইদাহ রফিক: জি জায়েজ হবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘কেউ যদি জবাই করার জন্য কোন পশু প্রস্তুত রাখে এবং সে যিলহজ্জ মাসে প্রবেশ করে তখন সে যেন তার চুল ও নখ না কাটে; যতক্ষণ না সে কোরবানি সম্পন্ন করে (সহিহ মুসলিম, ১৯৭৭) ও (সুনানে আবু দাউদ, ২৭৯১)’। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে কোরবানি করতেন। কিন্তু এমন কোন বর্ণনা আসেনি যে, তিনি তাদেরকে বলেছেন যে, ‘তোমরা তোমাদের চুল, নখ ও চামড়ার কোন অংশ কেটো না’। যদি এগুলো করা তাদের জন্য হারাম হত তাহলে অবশ্যই তিনি তাদেরকে নিষেধ করতেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
আবু রুফাইদাহ রফিক: দেশের অন্যতম শিক্ষা, তারুণ্য, ক্যাম্পাসভিত্তিক নিউজ পোর্টাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ।