মুখরোচক লেখায় সাংবাদিকতা হয় না, ব্যবসা হতে পারে
যেকোনো রাষ্ট্র বা সমাজের জন্য গণমাধ্যমের ভূমিকা অপরিসীম। এই পৃথিবীতে রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতন ও যুদ্ধ-বিগ্রহের পেছনে গণমাধ্যমই অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে। ভারতবর্ষ থেকে বৃটিশদের তাড়ানো থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত সবখানেই সাংবাদিকের কলম ছিলো সোচ্চার এবং নির্ভীক।
সারা পৃথিবীজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। পরিবেশের মতো কিছু ক্ষেত্রে ইতিবাচক সংবাদ এসেছে, কিন্তু সামগ্রিক ক্ষেত্রে করোনার প্রভাবটা নেতিবাচক। উন্নত, উন্নয়নশীল ও দরিদ্র সব দেশেই লোকসানের কারণে গুটিয়ে নিতে হচ্ছে সংবাদ কোম্পানি, পাল্টে যাচ্ছে সাংবাদিকতার সার্বিক চিত্র।
বৈশ্বিক পরিসরে ও বাংলাদেশে সাংবাদিকতার বর্তমান চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে কথা বলেছেন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় (জাককানইবি)- এর ফিল্ম এন্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহকারী অধ্যাপক মাহমুদা সিকদার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জাককানইবি প্রতিনিধি জিহাদুজ্জামান জিসান।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমান সময়ে মানুষ অনলাইনে প্রচুর সময় দিচ্ছে, নিউজ পড়ছে। এটা কি অনলাইন বিপ্লব কি না?
মাহমুদা সিকদার: করোনাকালীন সময়ে যেহেতু মানুষ ঘরে বসে আছে, বাইরে যেতে পারছে না, অনলাইনেই অফিস কার্যক্রম পরিচালনা, বিশ্বের খবর রাখা, কেনাকাটা-বাজারসদাই সহ সামগ্রিক চাহিদা মেটাতে হচ্ছে, সেদিক বিবেচনায় অনলাইন বিপ্লব বলা যেতে পারে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ভবিষ্যতে অনলাইন সাংবাদিকতা কি শীর্ষে থাকবে?
মাহমুদা সিকদার: এখানে অনেকগুলো বিষয় আছে। অনলাইন সাংবাদিকতা নির্দিষ্ট প্যাটার্নে চলছে কি না বা তৈরি হচ্ছে কি না এটার উপর নির্ভর করবে অনলাইন সাংবাদিকতা শীর্ষে থাকবে কি না। বিষয়টি এমন নয় যে, করোনার মতো একটা পরিস্থিতিতে যেখানে আমরা বাইরে যেতে পারছি না, সংবাদের চাহিদা অনলাইনে মেটাতে হচ্ছে, একারণে অনলাইন সাংবাদিকতা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এরকমভাবে কিন্তু অনলাইন সাংবাদিকতা শীর্ষে আসতে পারবে না।
অনলাইন সাংবাদিকতাকে শীর্ষে যেতে হলে কনটেন্ট থেকে শুরু করে সবকিছুতে আমূল পরিবর্তন আনতে হবে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায়, একই সংবাদ প্রতিষ্ঠান যাদের প্রিন্ট এবং অনলাইন দুটো ভার্সন আছে, দুটো প্লাটফর্মে দুই ধরনের নিউজ প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষ করে অনলাইন ভার্সনে এক ধরনের সস্তা, মুখরোচক এবং আকর্ষণ তৈরি করে এমন নিউজের বিস্তার তুলনামূলক বেশি। এভাবে যদি কেউ সাংবাদিকতা করতে চান, সেটা সাংবাদিকতা হবে না; ব্যবসা হতে পারে।
এক্ষেত্রে অবশ্যই কনটেন্টের গুণগত মান নিশ্চিত করতে হবে, নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র থাকতে হবে। অন্যথায় অনলাইন সাংবাদিকতা শীর্ষে থাকা সম্ভব নয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিভিন্ন দেশের নামী-দামী পত্রিকাগুলো এই মহামারিতে বন্ধ হয়ে গেছে, তারা শুধু অনলাইন ভার্সন চালু রেখেছে। করোনায় বাংলাদেশও সেই পথে এগোচ্ছে কি না?
মাহমুদা সিকদার: করোনার ভয়াবহ প্রকোপ থাকলেও আমরা জীবনকে অনেকটা সহজ-স্বাভাবিক করে নিয়েছি। করোনা পরিস্থিতিতে গণমাধ্যমগুলো প্রিন্ট ভার্সনের পাশাপাশি অনলাইন ভার্সনও চালু করেছে, ভালো কনটেন্ট তৈরি করছে এবং সেগুলো আপডেটও করছে। করোনার জন্যই হোক, অনলাইনে সমৃদ্ধি আনা বাংলাদেশের জন্য বেশ ভালো একটা বিষয়। তবে বিজ্ঞাপন, পাঠক এবং সার্কুলেশন হয়তো কমেছে কিন্তু একেবারে পত্রিকা বন্ধ করে শুধুমাত্র অনলাইন ভার্সনে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা বাংলাদেশে এখনো সৃষ্টি হয় নি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: লক্ষ্য করা গেছে বর্তমান সময়ে ফেসবুক থেকে তথ্য নিয়ে নিউজ করা হয়। এছাড়া নিউজকে আকর্ষণীয় করতে মিস লিডিং করা ও মিস ইনফরমেশন দেওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। এটা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কি না?
মাহমুদা সিকদার: অনলাইন নিউজের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়াসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে আমরা সংবাদ পেয়ে থাকি। কারো ফেসবুক স্ট্যাটাস, পেজ বা গ্রুপের পোস্ট, শেয়ার করা নিউজ কিংবা ইউটিউব থেকেও কোনো সংবাদ জানতে পারি। প্রায়শই চোখে পড়ে ‘বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন’, ‘পরবর্তী ঘটনা শুনতে ক্লিক করুন’। এছাড়াও চটকদার হেডলাইন দেখে অনেকেই অজ্ঞতার বশে বিভিন্ন অখ্যাত সাইট থেকে কোনো তথ্য জেনে সেটিকে বিশ্বাস করছেন।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের দুটো উপায় আছে। প্রথমত, সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোতে সম্পাদকসহ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে গণমাধ্যম স্বাক্ষর ব্যক্তিবর্গ থাকতে হবে। কারণ গণমাধ্যম বিষয়ে শিক্ষিত ব্যক্তি সংবাদ সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো অতিরঞ্জিত না করে জনগণের কাছে সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারেন। যার ফলে সংবাদের গুণগত বৈশিষ্ট্য এবং গ্রহণযোগ্যতা অক্ষুণ্ণ থাকে।
দ্বিতীয়ত, সংবাদপাঠককেও সংবাদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। পাঠকের উচিত সুপরিচিত কোনো নিউজ পোর্টাল কিংবা নির্ভেজাল উৎস থেকে সংবাদ সংগ্রহ এবং গ্রহণ করা। কোনো ঘটনা সংবাদ হওয়ার উপযোগিতা আছে কি না সে বিষয়ে সাংবাদিক এবং পাঠক উভয়ের ন্যূনতম জ্ঞান থাকতে হবে।
এই দুটো বিষয় নিশ্চিত হলে সাংবাদিকতায় আরো সমৃদ্ধি আনা সম্ভব। কারণ অনলাইন যেমন বিপ্লব আনতে পারে, বিপর্যয়ও আনতে পারে। এটা ভুলে গেলে চলবে না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাংবাদিকতার বর্তমান যে অবস্থা, বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা, কর্মীছাটাই, চাকুরি নিশ্চয়তার হার কম- এ ধরনের চ্যালেঞ্জে নতুনরা কি সাংবাদিকতায় আসতে নিরুৎসাহিত হচ্ছে?
মাহমুদা সিকদার: হ্যাঁ, নিরুৎসাহিত হচ্ছে। তবে আমি মনে করি, এই সংকটগুলো অনেকটা তৈরি করা সংকট এবং অপেশাদারিত্বের কারণে এই সমস্যাগুলো ক্রমাগত বাড়ছে। প্রথমত, স্নাতক পর্যায়ে সাংবাদিকতা বিষয়টি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পড়ানো হলেও বর্তমানে সাংবাদিকতা বিষয়ে শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত সাংবাদিকের সংখ্যা কম। একারণে যখনি অপেশাদার মানুষজন এই সেক্টরে জায়গা করে নিচ্ছে, তখন মালিকগোষ্ঠী সংবাদের গুণগত মান নিশ্চিতকরণে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন এবং সাংবাদিককে ন্যূনতম সম্মানী প্রদান করা হয়। অনেক সময় কর্মীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতেও প্রচ্ছন্নভাবে এই সংকটগুলো নিজ থেকে সৃষ্টি করা হয়।
এর বাইরেও অনেকসময় মিডিয়া হাউজগুলো নতুন বিজ্ঞাপন পায় না, বিভিন্ন কারণে বিজ্ঞাপন হারিয়ে ফেলে। যার কারণেও কর্মীদের বেতন দিতে সমস্যা তৈরি হয়। তবে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোর সদিচ্ছা থাকলেই এই সমস্যাগুলো মোকাবেলা করা সম্ভব।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমান সমাজে লোভনীয় সব চাকুরির ভিড়ে সাংবাদিকতায় মেধাবী কিংবা তুলনামূলক ভালো শিক্ষার্থীরা আশঙ্কাজনক কম আসছে। এটা কি ভবিষ্যৎ সাংবাদিকতার জন্য চ্যালেঞ্জ? সাংবাদিকতা অতি মেধাবীশূন্য হয়ে পড়ছে- ব্যাপারটা এমন কি না?
মাহমুদা সিকদার: প্রথমত, সাংবাদিকতা খুব সহজ একটি পেশা নয়। দেখা যায়, সাংবাদিকদের ২৪ ঘণ্টাই কোথায় কি ঘটছে খোঁজখবর রাখতে হয়, যেকোনো সময় সংবাদ সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আবার ঝুঁকিপূর্ণ স্থান থেকেও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে উপযুক্ত তথ্য উদ্ঘাটন করে আনতে হয়। অনেকে পড়াশোনা করলেও এসকল বিষয়ে সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনা। অন্যদিকে শিক্ষকতা, ব্যাংকে চাকরি কিংবা সরকারি চাকরির মতো জায়গাগুলোতে নির্দিষ্ট সময়ে বেতন-বোনাস দেওয়া হয় এবং চাকুরির নিশ্চয়তাও বেশি। আবার পারিপার্শ্বিক দিক থেকে অনেকেই সাংবাদিকতাকে সম্মানিত পেশা হিসেবে দেখেন না। একারণে অনেকে মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও সাংবাদিকতা পেশায় আসতে চান না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনা পরিস্থিতির কারণে সাংবাদিকতার যে স্বাভাবিক গতি নষ্ট হয়েছে, তা আবার ফিরবে কি না? ফিরলেও পূর্বের অবস্থায় ফিরবে কি?
মাহমুদা সিকদার: আমার মনে হয়, করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সাংবাদিকতায় নতুন ধারা সৃষ্টি হবে। অনলাইনে ক্লাস শুরু হওয়ার পর পাঠদানে যেমন বৈচিত্র্য এসেছে, এই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সাংবাদিকতাও নতুনভাবে বিকশিত হবে। তবে এর জন্য সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা, সঠিক ব্যবস্থাপনা এবং গণমাধ্যমকে সচেতনভাবে ব্যবহার করা বেশ জরুরি। পাশাপাশি সাংবাদিকতাকে সঠিক ধারায় ফেরাতে সঠিক নীতিমালা প্রণয়ন বর্তমানে সময়ের দাবি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাংবাদিকতায় ভালো করতে নবীন সাংবাদিকদের কি পরামর্শ দেবেন?
মাহমুদা সিকদার: সবার আগে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। গণমাধ্যম সম্পর্ক সুস্পষ্ট ধারণা এবং প্রবল আগ্রহ থাকলে তবেই সাংবাদিকতায় আসা উচিত। পাশাপাশি সাংবাদিককে মেধাবী, সাহসী এবং প্রচুর পরিশ্রমী হতে হয়। বিভিন্ন বিষয়ে সম্যক জ্ঞান রাখতে হবে এবং স্পষ্টভাষী হতে হবে। কাজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং আন্তরিক হতে হবে। সেই সাথে সততা এবং সময়ানুবর্তিতার গুণাবলী থাকা একান্ত জরুরি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মাহমুদা সিকদার: আপনাকেও ধন্যবাদ।