মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকবে, ততক্ষণ তার কাজ করা উচিত

  © টিডিসি ফটো

ইকবাল বাহার। একজন উদ্যোক্তা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মেন্টর, মোটিভেশনাল স্পিকার, নিউজ প্রেজেন্টার ও বিজনেস প্রোগ্রাম অ্যাংকর। তিনি মাস্টার্স শেষ করার পর সিএ ও এমবিএ করেন। ইন্টারনেট কোম্পানিতে চাকরি দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। সেই জীবনেও সফল ইকবাল খুব অল্প বয়সে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার হন। সময়টা ২০০৩ সাল। নিজে কিছু করার আশায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি ছেড়ে অপটিম্যাক্স কমিউনিকেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলাদিন কিডস ডট কম চালু করেন। উদ্যোক্তা হওয়ার পর বিবেকের তাড়নায় সমাজের জন্য কিছু করার তাগিদ অনুভব করেন। সময়ের বিবর্তনে নানাবিধ প্রতিকূল অবস্থা মোকাবেলা করে আজকের অবস্থায় পৌঁছেছেন। তারই ক্যরিয়ারের বিভিন্ন খুঁটিনাটি দিক এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের পরামর্শগুলো তুলে ধরতে জানার চেষ্টা করো হয়েছে এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিনিধি আবদুর রহমান-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি এবং আপনার প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে জানতে চাই 
ইকবাল বাহার: আমি একজন উদ্যোক্তা। বেশকিছু সামাজিক কাজ করে থাকি। তরুণদেরকে উদ্যোক্তা হওয়ার ব্যাপারে আমি প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। গত আড়াই বছর যাবৎ এই প্রশিক্ষণটি সর্ম্পূন্ন বিনামূল্যে দিয়ে থাকি। এখান থেকে তিন হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করেছি, যারা এখন অন্যদের চাকরি দিচ্ছে। আগামী ১ বছরের মধ্যে আমরা আরও ১০ হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করবো। যারা দেশব্যাপী ১ লাখ কর্মসংস্থান তৈরি করবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ক্যারিয়ার শুরুটা কীভাবে?
ইকবাল বাহার: ক্যারিয়ারের শুরুতে আমি ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ সাইবার নেটে কাজ করতাম। এরপরে গ্রামীণ শক্তি এবং সিঙ্গার বাংলাদেশেও দীর্ঘদিন কাজ করেছি। দীর্ঘদিন কাজ করতে গিয়ে মনে হতো, আমি যে অবস্থানে রয়েছি তার থেকেও আরও ভালো অবস্থানে আমি থাকতে পারি, দেশের বেকার জনগোষ্ঠীর জন্য ভালো কিছু করতে পারি। সেসব মাথায় নিয়েই আমি নিজে একটা কিছু করার স্বপ্ন দেখতে থাকি। তাঁরই ধারাবাহিকতায় ২০০৩ সালে যখন আমি এই মার্কেটে আসি তখন আইএসপির বড় বড় প্রতিষ্ঠানগেুলো বাজার কাঁপাচ্ছে। সেখানে অপটিম্যাক্সের কোনও নাম ছিল না, ছিল না কোনও ব্র্যান্ড ইমেজ। তাই আমি চেয়েছি সার্ভিস দিয়েই আমি এগিয়ে যাব। বাংলাদেশের এমন কোনও প্রতিষ্ঠান নেই, যে প্রতিষ্ঠানের এমডি (ব্যবস্থাপনা পরিচালক) নিজে কাস্টমার কেয়ার হ্যান্ডেল করে। আমি নিজে এটা সব সময় মনিটর করি। কারণ আমি মনে করেছি, সার্ভিস ফার্স্ট। আর এভাবেই একটু একটু করে আজ আমি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন কোনটি?
ইকবাল বাহার: আজকের অপটিমাক্স-ই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমি বেশ কয়েকজন বেকারের জন্য জব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি। কেননা বেকারদের জন্য জব তৈরি করব, এটাই ছিল আমার বড় টার্গেট।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা শেষে চাকরি খুঁজতে ব্যস্ত থাকে। সেক্ষেত্রে আপনার ভিন্ন পথ বেঁচে নেওয়ার কারণ কি?
ইকবাল বাহার: আমিও কিন্তু এক সময় চাকরি করতাম। কিন্তু দেখেন সমস্যা হচ্ছে যে, আমাদের দেশে কিন্তু লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার বসে আছে তাদের জন্য চাকরি নাই। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে তারা কি বসে থাকবে? না তাদেরও তো জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু করতে হবে। আর এই কারণেই মূলত আমি চাকরি ছেড়ে উদ্যোক্তা হয়েছি। আর এখন তাদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যেন তারা নিজেরা কিছু করতে পারে। চাকরী নেই সমস্যা কি?

ব্যবসা অথবা ফ্রিলান্সিং করেও যেন তারা নিজে কিছু করতে পারে এবং অন্যদের জন্য কর্মসংস্থান করতে পারে। আর আরেকটি কারণে আমি উদ্যোক্তা হয়েছি আমার যে পোটেনিশিয়ালিটি; কাজ চাকরি করতে গিয়ে তা দেখাতে পারছি না। কেবল একটা বিভাগ নিয়ে আমাকে ভাবতে হচ্ছে, কাজ করতে হচ্ছে। আমি যে আরও কিছু পারি তা করতে না পারা এবং ভেতরের তাড়না থেকেই আমি উদ্যোক্তা হয়ে গেছি। কারণ আমি মনে করি মানুষ যতক্ষণ জেগে থাকবে ততক্ষণ কাজ করবে। নিজের মতো করে কাজ করার তাড়নাটাই মূলত আমাকে উদ্যোক্তা তৈরি করছে। আর তথ্যপ্রযুক্তি হলো ভেরি স্মার্ট জব, স্মার্ট মানুষ এটা ব্যবহার করে এবং সমাজের একটা বিশেষ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব থাকায় আমি এটার প্রতি আগ্রহী হয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্রে শিক্ষাব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনা উচিত?
ইকবাল বাহার: একটা সময়ে স্কুলে অলিখিত একটা নিয়ম ছিল যারা ভালো ছাত্র তারা সবাই বিজ্ঞান বিভাগে পড়বে। অর্থাৎ তারা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। এরপর আরেকটু কম মেধাবীরা বাণিজ্য বিভাগে আর একবারে কম মেধাবীরা মানবিক বিভাগে পড়বে। বর্তমানে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে সে ধারণাটি পরিবর্তন হয়েছে। এখন মেধাবীরা শুধু ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার নয়, তারা চার্টার্ড একাউন্টেন্ট, এমবিএ, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং ইত্যাদি পড়ছে। তরুণরা এখন নিজেরাই নানারকম তথ্য এনালাইসিস করতে পারছে কোথায় তাদের পড়া উচিত। বাবা-মা’রাও তাদের সিদ্ধান্ত সন্তানদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার প্রবণতা কমিয়েছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে আমাদের দেশে সবাই হুজুগে দৌঁড়ায়। এক একবার একেকটার জোয়ার আসে তো সবাই সেটাতে গা ভাসিয়ে দেয়। শিক্ষা বাণিজ্যিকরাও সেই সুযোগটা লুফে নেন। দেশের দু’চারটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বাদ দিলে বাকিগুলোর মান নিয়ে কথা নাই বা বললাম। এত বিবিএ-এমবিএ দিয়ে হবেটা কী?

কারা চাকরি দেবে, কোথায় চাকরি পাবে আমাদের তরুণরা! যে ছেলেটা বা মেয়েটা ক্রিকেট খেলবে, গান করবে, অভিনয় করবে, ফটোগ্রাফার হবে, বড় রন্ধনশিল্পী হবে, ডিজাইনের কাজ করবে, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট করবে, হোটেলে কাজ করবে, মার্চেন্ডাইজিংয়ের কাজ করবে, আধুনিক কৃষিভিত্তিক কাজ করবে- সে কেন বিবিএ, এমবিএ বা ভূগোল পড়বে! খেলা, গান, ডিজাইন, ফটোগ্রাফি, মার্চেন্ডাইজিংসহ এসব বিষয়ের ওপর তারা গ্র্যাজুয়েশন করবে, প্রয়োজনে মাস্টার্স করবে। দরকার এসএসসির পর থেকেই কারিগরি শিক্ষা। যারা গত ১৫-২০ বছরে শতশত প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি বানিয়ে এমবিএ ও বিবিএ সার্টিফিকেট বিক্রি করেছেন এবং আমাদের তরুণরা সেই সনদ দিয়ে কোনো চাকরি বা উদ্যোক্তা হতে পারেনি। তাদের অনুরোধ করব আপনারা এবার কিছু আধুনিক কারিগরি কলেজ-ইউনিভার্সিটি বানান যাতে আমাদের মেধাবী ও কর্মঠ তরুণরা এসএসসির পর থেকেই হাতে-কলমে কাজ শিখতে পারে ও ওইসব বিষয়ে প্রয়োজনে ডিগ্রি নিতে পারে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনাকালে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করতে বলা হচ্ছে আর অন্যদিকে ইন্টারনেটের দাম বাড়িয়েছে। এই সম্পর্কে আপনার অভিমত কি?
ইকবাল বাহার: মোবাইল ফোন অপারেটররা সারাদেশে নেটওয়ার্ক তৈরি করে প্রথমে ভয়েস সেবা দিয়েছে, এখন দিচ্ছে ডাটা সেবা (ইন্টারনেট) দিচ্ছে। তারা চাইলেই কমে দিতে পারছে কিন্তু আমাদের রয়েছে মাত্র দুটি এনটিটিএন কোম্পানি। আমাদের নেটওয়ার্কও সীমিত। ফলে আমাদের সেবাদান বাণিজ্যিকভাবে সফল হচ্ছে না। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবায় আইএসপিগুলো ঢাকা শহরে ৯০ এবং ঢাকার বাইরে মাত্র ১০ শতাংশ এলাকায় সেবা দিতে পারছে। সে হিসেবে মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো ঢাকায় ৪০ এবং ঢাকার বাইরে ৬০ শতাংশ এলাকায় (জায়গা) সেবা দিতে পারছে। এর মূল পার্থক্য হলো অবকাঠামো তৈরি।

প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানগুলো একা এটা করতে পারবে না। সরকারকেই করে দিতে হবে। আসলে এটা একটা রাস্তার মতো। রাস্তা সরকারই তৈরি করে দেয়। জনগণ, পরিবহণ কোম্পানিগুলো তা ব্যবহার করে। অবকাঠামো তৈরি করা হলে আমরা সেটা ব্যবহার করে এর বিস্তার ঘটাতে পারব। তবে আরও কমাতে হলে ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন) খরচ কমাতে হবে। আরও অন্তত ২-৩টি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দেওয়া উচিত। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সরকার এলজিইডি বা বিটিসিএলকে দিয়ে সারাদেশে নেটওয়ার্ক তৈরি দিতে পারে। তবে দাম আরও কমাতে হলে ট্রান্সমিশন (সঞ্চালন) খরচ কমাতে হবে। আরও অন্তত ২-৩টি এনটিটিএন প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স দিতে হবে। যদি তা সম্ভব না হয় তাহলে সরকার এলজিইডি বা বিটিসিএলকে দিয়ে সারাদেশে নেটওয়ার্ক তৈরি দিতে পারে। আর শিক্ষার্থীদের জন্য ইন্টারনেট ফ্রি করে দেওয়া দরকার। তাহলে তারা অনলাইন ক্লাস এবং তথ্য প্রযুক্তি সেক্টরে তাদের স্কেল ডেভেলপ করতে পারবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে একজন আইটি উদ্যোক্তা হওয়া কতটুকু গ্রহণযোগ্য?
ইকবাল বাহার: এখানে আসলে গ্রহণযোগ্যতার কোনো প্রশ্ন আসে না। যেকোনো কাজ, যেখানে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে সৎপথে উপার্জন করা যায়, তা অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। আপনি লক্ষ্য করে দেখবেন, বর্তমানে শিক্ষিত বেকারদের তুলনায় সরকারি চাকরির আসন একদমই কম। তাই চাকরির পিছনে না ঘুরে নিজে কিছু করার চিন্তা নিয়ে নিজের স্কিলকে ডেভেলপ করা জরুরি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার পরিকল্পনা সম্পর্কে আপনার দিকনির্দেশনা কী?
ইকবাল বাহার: ভালো ক্যারিয়ারে দরকার কঠোর পরিশ্রম। এছাড়া শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। ২১ থেকে ২৮ বছর পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। ক্যারিয়ারের প্রত্যেকটি ধাপেই সততা বজায় রাখতে হবে। সত্য কথা বলতে হবে। আর পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের জন্য কিছু করার চিন্তা করতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও ক্যারিয়ার নিয়ে আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
ইকবাল বাহার: শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার গঠন করতে মার্স্টাস ডিগ্রি করার প্রয়োজন নেই। নিজের হিসাব বুঝার মত পড়াশোন করলেই চলবে। কেউ যদি চাই সেই করতে পারে। তবে ঢালাও সবাই করতে হবে মার্স্টাস ডিগ্রি এই চিন্তা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আর কেউ যদি চায় সে চাকরি করবে তাহলে তাকে চাকরির জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন মিডিয়া ব্যক্তিত্ব হয়ে ওঠার যোগসূত্র কীভাবে?
ইকবাল বাহার: একেবারেই শখ করেই আসা। সত্যি কথা বলতে, এদিকে আসার ইচ্ছে ছিল আরও ১০ বছর আগে। কিন্তু নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভেবে বুকের ভিতরে স্বপ্নটা লুকিয়ে রেখেছিলাম। যখন দেখলাম সবকিছু মোটামুটি গোছানো হল, তখন মিডিয়া জগতে এলাম। এর পর আমি বিজনেস শো-উপস্থাপনা করি। ব্যবসা নিয়ে অনেক ব্যস্ত থাকতে হয়। সুবিধাজনক সময়ে নিউজও পড়ি। তবে এখন আর বিজনেস শো-উপস্থাপনা করার সময় হয় না। এখন শুধুমাত্র প্রতি সপ্তাহে এক দিন আমার একটি ইউটিউব চ্যানেল আছে সেখানে ক্যারিয়ার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে লাইভ করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে আপনাকে।
ইকবাল বাহার: নিউজ পোর্টাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ