স্ত্রী-সন্তানকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে সিদ্দিকুরের
- মোঃ রাকিবুল হাসান তামিম
- প্রকাশ: ২৩ জুলাই ২০২০, ১২:৪২ PM , আপডেট: ২৩ জুলাই ২০২০, ০২:১২ PM
২০ জুলাই ২০১৭ সাল। তখন আমি তিতুমীর কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী। বৃষ্টিস্নাত সকালে মেস থেকে শাহবাগ মোড়ে আসি। উদ্দেশ্য ছিল— ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয় অধিভুক্ত সরকারি সাত কলেজের পরীক্ষা গ্রহণে তারিখ ঘোষণার দাবিতে শান্তিপূর্ণ মানববন্ধন। ঢাকায় আসার পর এটিই ছিল আমার প্রথম কোন আন্দোলনে যোগদান।
সেখানেই আন্দোলনরত অবস্থায় সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ খুব কাছ থেকে পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলের আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। তাৎক্ষণিক জ্ঞান হারাই। যখন জ্ঞান ফেরে তখন থেকে চোখে আর কিছুই দেখতে পাই না। নিভে যায় আমার চোখের আলো। আর কখনোই দেখা হয়নি পৃথিবী। সামনের দিনগুলোতেও আর দেখতে পাব না।
আঘাতপ্রাপ্ত হবার পর প্রথমে আমাকে সহপাঠীরা নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরবর্তীতে সেখান থেকে নিয়ে যাওয়া হয় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। সেখানেই চলে প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা। তখনো আমি আশাবাদী হয়তো উন্নত চিকিৎসা পেলে আবারো ফিরে পাব চোখের আলো। এরপর ২০১৭ সালের ২৭ জুলাই উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাইয়ের শংকর নেত্রালয়ে যাই। সেখানে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা নিশ্চিত করে বলেন, আর কখনোই চোখে দেখতে পাব না। বিষয়টি আমার কাছে অনেকটা দুঃস্বপ্নের মতো। চেনা পৃথিবীটা মুহূর্তেই যেন অচেনা হয়ে গেল। হাসিমুখেই কথাগুলো বলছিলেন পুলিশের ছোঁড়া টিয়ারশেলের আঘাতে দুইচোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমান।
সদালাপী আর বিনয়ী সিদ্দিকুর নতুন জীবনকে মানিয়ে নেবার প্রত্যয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছেন। তবে হঠাৎ করেই চোখের জ্যোতি হারানোর যে কষ্ট আর বেদনা তা হয়তো কেবল সিদ্দিকুরই উপলব্ধি করেন।
ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার ঢাকিরকান্দা গ্রামের হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান সিদ্দিকুর রহমান পরিবারের একমাত্র কর্তা বাবাকে হারিয়েছেন সেই ছোট্টবেলায়। অনেক কষ্ট আর যাতনার সংসারে মায়ের কষ্ট আর পরিশ্রমের বিনিময়ে একমাত্র পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনিই। মা আর ভাইবোনদের ঘিরেই ছিলো তাঁর সব স্বপ্ন।
বললেন, আমার জন্য মা অনেক কষ্ট আর পরিশ্রম করেছেন। এখনো হঠাৎ-হঠাৎ মায়ের আদরমাখা মুখটা একনজর দেখার প্রবল ইচ্ছা জাগে। কিন্তু সে সুযোগ আর কোনদিন হবে না। তাই ষাটোর্ধ্ব বৃদ্ধ মায়ের চোখ মুখ ছুঁয়েই স্নেহভরা মুখখানি অনুভব করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় চোখ হারানো সিদ্দিকুর রহমান আরো জানালেন, তার বড় হওয়া এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ময়মনসিংহেই। উচ্চমাধ্যমিকের পর তার ব্যাচ থেকে তিনই একমাত্র ঢাকায় উচ্চশিক্ষার জন্য আসেন। স্বপ্ন ছিলো পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের। সেই লক্ষ্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন তিনি। চোখ হারানোর পর সে স্বপ্ন বাতাসে মিশে গেছে। সেই স্বপ্ন কেবলই মরীচিকা। তবে সে সব ভেবে কখনোই হতাশা বা খরাপ লাগা কাজ করে না সিদ্দিকুরের। বরং পরবর্তী জীবনের ধারা চলমান রাখতেই সব প্রচেষ্টা তাঁর।
বর্তমানে সিদ্দিকুর রহমান এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের টেলিফোন অপারেটর হিসেবে কর্মরত আছেন। বললেন, মাত্র তিন মাসেই কাজ শিখে নিয়েছি। এখনো সবকিছু গুছিয়ে উঠার চেষ্টা করছি। কাজ করতে সহকর্মী আর অফিসের সকল কর্মকর্তারা অনেক সহায়তাও পান তিনি।
সিদ্দিকুরের জীবনে কালবৈশাখীর ঝড় বয়ে গেলেও থেমে থাকননি তিনি। অবতীর্ণ হয়েছেন জীবনযুদ্ধে। ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর খালাতো বোন সুমাইয়া সিদ্দিককে বিয়ে করেন তিনি। আট মাস হলো সিদ্দিক-সুমাইয়া দম্পতির কোল জুড়ে এসেছে নতুন অতিথি। নাম রেখেছেন প্রিন্সেস তাশবী সিদ্দিক। সবমিলিয়ে চাকরি আর পরিবার পরিজন নিয়েই নতুন জীবনকে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন সিদ্দিকুর। আক্ষেপ করে বললেন, মাঝেমধ্যে আমার খু্ব কষ্ট হয়। আমার স্ত্রী-সন্তানকে দেখতে খুব ইচ্ছে করে। আমার স্ত্রী আমার জন্য অনেক কষ্ট করে। অথচ তার মুখটি আমি দেখিনি।
সবমিলিয়ে জীবনযুদ্ধে টিকে থাকার এক অসম লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছেন তিনি। যে জীবন চোখের আলো বিহীন। যেখানে রাতদিন সব সমান। যে জীবনের একমাত্র পুঁজি হলো— সহযোগিতা আর ভালোবাসা। এই সহযোগিতা আর ভালোবাসার পুঁজি নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চান সিদ্দিকুর রহমান।