বই না পড়ায় জাতি হিসেবে পিছিয়ে রয়েছি
হোসেন ইকবাল। একজন প্রতিভাবান তরুণ লেখক ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর জন্ম ১৯৮৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জয়পুরহাট জেলায়। ছোট বেলা থেকে বইপড়ার নেশা ছিল বলেই কাকতালীয়ভাবে ২০১১ সালে আলোকিত মানুষ গড়ার প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যোগদান করেন। তিনি বাংলা ভাষার অত্যন্ত পরিশীলিত একজন লেখক। কাব্যময় ভাষায় জীবন-ঘনিষ্ঠ উপন্যাস এবং কবিতাও লিখে থাকেন তিনি। করোনা-কালে তার লেখালিখি এবং সাহিত্য নিয়ে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রহমান—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কবে, কীভাবে আপনার লেখালেখির শুরু করলেন? প্রথম লেখা কী ছিল?
হোসেন ইকবাল: লেখালেখির কথা বলার আগে বই পড়ার কথা না বললেই নয়। শুরুটা করেছিলাম ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকাকালীন ১৯৯৬ সালে আমার প্রিয় স্কুল পুনট উচ্চ বিদ্যালয়ে। বাংলা স্যার খুব ভালোবেসে জোর করে বই বাড়িতে নিয়ে পড়তে দিতেন। তারপর থেমে নেই, বাজাররের লাইব্রেরি-স্টেশনারির দোকান থেকে ২ টাকা করে উপন্যাস বই ভাড়া নিয় পড়তাম সপ্তাহে দুই তিনটি। স্কুলের মধ্যে ভালো ছাত্র ছিলাম প্রাইমারী স্কুল থেকেই। তখন এলাকায় পূনট ইউনিয়নের মধ্যে স্কুলে ছাড়া লাইব্রেরি ছিল না কোথাও। স্কুল ভিত্তিক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই পড়া কর্মসূচিও আমার স্কুলে না থাকলেও পুনট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ছিল। আমার বড় বোন তার স্কুলে সেই কর্মসূচির সদস্য হয়ে বই পড়ার সূযোগ পেত। সে বইও আমি পড়তাম। পড়ার ফলেই একটা উপন্যাস লেখার প্রবণতা জাগে।
তবে প্রথমে কবিতা লিখেছি ২০০০ সালে দশম শ্রেণিতে থাকাকালীন, কবিতার নাম "হায়রে বিংশ শতাব্দী" এর প্রেক্ষাপট ছিল- ২০০০ সালটা খুব বড় বন্যা,খরা, ঘনকুয়াশা এবং সবচেয়ে আলোচিত ৫ মে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার ভবিষ্যৎবাণী। সেইদিন ৭টি গ্রহ একই সরল রেখায় এসেছিল তবুও কিছুই ঘটেনি এবং সেইদিনই ঐ কবিতাটা লিখেছি। তখন দশম শ্রেণিতে পড়তাম। আসলে অল্প বয়সে প্রচুর বই না পড়লে লেখালেখি করলেও সেই লেখা মানসম্মত না হওয়াটা স্বাভাবিক এবং অভিজ্ঞ হওয়ার পর সেই লেখা পড়লে কাঁচা হাতের নিদর্শন পাবেন আপনিও। সেজন্য আগে পড়তে হবে প্রচুর।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের দেশের কথাসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি আপনার কাছে কী রকম মনে হয়?
হোসেন ইকবাল: কথাসাহিত্য আসলে সাহিত্যের ব্যাপক জনপ্রিয় একটি শাখা। লিখতেও বেশ মননশীলতা, প্রচুর ধৈর্য আর সৃজনশীলতা প্রয়োজন। গল্প আর কবিতা স্বল্প সময়ে লেখা সম্ভব বলে কবি ও গল্পকার অসংখ্য আত্মপ্রকাশ করেছেন। এতদ্বসত্তেও অনেক তরূণ লেখক কথাসাহিত্য লিখছেন বলে খুবই আনন্দের কথা। তবে তারা খ্যাতিমান লেখকের মতই লেখার চেষ্টা করছেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বলা হয়ে থাকে যে, বাঙালি কবিরা প্রথম লিখতে শুরু করেন প্রেমে পড়ে, কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে প্রেমই, তবে তা প্রকৃতি-প্রেম। ব্যাপারটা কী এমন?
হোসেন ইকবাল: এ কথা সত্য যে প্রেমে সফল কিংবা ব্যর্থতা সেই পুরুষ বা নারীর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। এরকম পরিস্থিতিতে হৃদয়ের অলিগলিতে সাহিত্যের উপাদানগুলো উঁকি মারতে থাকায় একসময় লিখতে শুরু করে। তবে আর সবার মত আমারক্ষেত্রে না ঘটলেও মূলত বইপড়া নেশা থেকেই লেখালেখির ইচ্ছা জেগেছে। মনে হয়েছে তাঁরা লিখতে পারলে আমি লিখতে পারব না কেন? সেই ইচ্ছে থেকেই লেখায় হাত দেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শুধু গল্পের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের সাহিত্যের অন্যান্য ক্ষেত্রেও একটা নৈরাজ্যিক ভাব লক্ষণীয়। কেউ কেউ বলেন, এই নৈরাজ্যের কারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক। আবার কেউ কেউ বলেন অর্থনৈতিক বিপর্যস্ততার কথা। আপনি কি বলেন?
হোসেন ইকবাল: আমরা বই না পড়ার জন্য সামাজিকভাবে অসচেতনতায় দায়ী। রাষ্ট্রীয়ভাবে উন্নত দেশের মত বই পড়ি না বলে জাতি হিসেবেই আমরা পেছনে আছি। ঐ যে কথায় আছে "বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না" এই কথাটা পাঠক সমাজের বেশিরভাগ মানতে চান না। উপরন্ত বইয়ের পাঠক কমে যাওয়া এবং প্রকাশকদের ব্যাবসায়িক মানসিকতা লেখালেখির প্রতি লেখকদের আগ্রহে প্রচুর অনিহা তৈরি করে জাতিরই ক্ষতি করছে। অর্থনীতির চেয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়ই দায়ী।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিল্প-সাহিত্য কি সমাজ পরিবর্তন করে?
হোসেন ইকবাল: শিল্প-সাহিত্য সমাজে গুণগত পরিবর্তনের মাধ্যমে সভ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলে সভ্যতার বিকাশে অতি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নজরুল সাহিত্যের কোন মাধ্যম আপনার কাছে বেশি ভালো লাগে?
হোসেন ইকবাল- জাতীয় কবি তথা বিদ্রোহী কবির অন্যায়ের বিরুদ্ধে শোষণের বিরুদ্ধে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে যে সাম্যের জয়গান করেছেন সেটাই আমার হৃদয়ে নাড়া দেয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন এবং তরুণ লেখক লেখা পড়েন কি? তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?
হোসেন ইকবাল: হ্যাঁ আমি আমাদের দেশের তরুণ লেখকদের বই পড়ি। বইয়ের জগতে চাকুরীর সুবাদে খ্যাতিমান লেখকের পাশাপাশি তরুণ লেখকের বইও পড়ছি। তরুণদের বলছি- সত্যি কথা বলতে কি লেখক হতে হলে তিনটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথমত- বই পড়, দ্বিতীয়ত- বই পড় এবং তৃতীয়ত- বই পড়। প্রকাশকদের পিছে না ছুটে লেখার পিছে ছুটে বেড়াও এবং যে কোনো মাধ্যমে প্রকাশ করে পাঠকের মাঝে তা ছড়িয়ে দাও। গ্রন্থাকারভাবে প্রকাশ হবেই একদিন!
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনায় ঘরবন্দি সময়ে কী লিখছেন? কী পড়ছেন?
হোসেন ইকবাল: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে আজ অবধি বিশ্ব এত বড় মহাসংকটে পড়েনি। সবকিছুই স্থবির ও লোকারণ্য যেনো ভূতুরে নগরীতে পরিণত হয়েছে। করোনা মহামারীতে কোটিরও বেশি আক্রান্ত ও পাঁচ লক্ষেরও বেশি মৃত্যুবরণ করেছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বাসায় প্রায় সবাই অলস জীবন পার করতে বাধ্য হচ্ছে। দরিদ্র মানুষগুলোসহ বহু মানুষ কর্মহীন হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। স্রষ্ঠা যেনো এই সংকট থেকে সবাইকে মুক্তি দেয় এই কামনা করছি। এই অলস সময়ে বই পড়ছি। চোখের বালি, দিবারাত্রীর কাব্য, শার্লক হোমস রচনা সমগ্র এবং জেমস বন্ড রচনা সমগ্র এছাড়াও নবীজির জীবনী, হাদীস পড়েছি। আবার লেখালেখিও চালিয়ে যাচ্ছি আগামী বইমেলায় প্রকাশের লক্ষ্যে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কি কি বই লিখেছেন কয়টি প্রকাশ পেয়েছে আর কয়টি বাকি আছে। কোন বিষয়ে লিখতে পছন্দ করেন?
হোসেন ইকবাল: কবিতা লেখার পাশাপাশি উপন্যাস "শেষপ্রান্তে দাঁড়িয়ে" লেখা শুরু করেছি ২০০১ সালে এবং ২০০৩ সালে লেখা শেষ করেছি। ঐ উপন্যাসটি ২০০৩ সালে প্রকাশের জন্য ঢাকার একটি প্রকাশনা ২০ হাজার টাকা চাওয়ায় তা প্রকাশ করা আমার ছাত্রজীবনে অসম্ভব ছিল। উপন্যাসটি ২০১৯ সালে নতুন করে ব্যাপকভাবে এডিটিং করে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ প্রকাশিত হয় ঢাকার অর্জন প্রকাশনী থেকে এবং ২০১৯ সালে লেখা গোয়েন্দা উপন্যাস "রিভেঞ্জ" ও এই গ্রন্থমেলায় ঐ প্রকাশনী থেকেই প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু ২০০৩-২০০৮ পর্যন্ত আরো দুটি উপন্যাস অর্ধসমাপ্ত করে রেখেছি যা এখনো শেষ হয়নি এবং অসমাপ্ত থাকায় নামও স্থির করা হয়নি।
আসলে লেখালেখিতে প্রচুর সময় আর ধৈর্যের প্রয়োজন। চাকুরী করার পাশাপাশি লিখতে থাকা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। এরপর ২০১১ সালে সফল উপস্থাপক, পরিবেশ আন্দোলনে প্রথম সারির একজন, সফল সংগঠক, একজন সুবক্তা, আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা, দক্ষিণ এশিয়ার নোবেল নামে খ্যাত 'ম্যাগসাসাই' আন্তর্জাতিক পুরষ্কারপ্রাপ্ত জীবন্ত কিংবদন্তি আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের প্রতিষ্ঠিত বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকুরীর সুবাদে সাহিত্যের সমুদ্রে যুক্ত হয়ে পড়ি। এতে বই পড়ার প্রবণতা আরো সোনায় সোহাগা হয়ে ওঠে আমার জন্য।
এ পর্যন্ত বেশকিছু কবিতা ও গল্প আমার প্রতিষ্ঠিত ত্রৈমাসিক সাহিত্য পত্রিকা "স্বরলিপি"তে প্রকাশিত হয়েছে। এরপর ২০২০ সালে লেখা নতুন উপন্যাস "চেনা মুখ অচেনা মানুষ" এবং দুর্ধর্ষ গোয়েন্দা হিমেল বাহিনীর টিআইএ গোয়েন্দা সিরিজের "হারকিউলিস রহস্যের খোঁজে হিমেল বাহিনী" অমর একশে গ্রন্থমেলা ২০২১ সালে প্রকাশের অপেক্ষায়। আগামীতে আরো লিখতে থাকব পাঠকদের অনুপ্রেরণা পেলে। কারন লেখালেখির মাধ্যমে মানুষের জন্য সমাজের জন্য তথা বিশ্বের জন্য কল্যাণকর হয় এমন কিছু করা সম্ভব।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
হোসেন ইকবাল: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভ কামনা রইল। ধন্যবাদ।