প্রশ্নোত্তরে মাহে রমজান, তৃতীয় পর্ব
প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাসের ভয়াবহ পরিস্থিতিতে আজ রবিবার দেশে পবিত্র রমজান মাসের নবম রোজা চলছে। একজন রোজাদারের সিয়াম সাধনাকে আরো সুন্দর ও পরিপূর্ণ করতে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে আপনার মনে জাগ্রত হওয়া রমজান নিয়ে নানা প্রশ্নের সমাধান নিয়ে হাজির হয়েছে বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হযরত মাওলানা আবু রুফাইদাহ রফিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আবদুর রহমান—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মাহে রমজান আমাদেরকে কী শিক্ষা দেয়?
আবু রুফাইদাহ রফিক: আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ। শুরুতেই দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মাধ্যমে সবাইকে পবিত্র মাহে রমজানের শুভেচ্ছা। একইসঙ্গে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের ধারাবাহিক এমন আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানাই। রোজা আমাদেরকে সবর ও সহমর্মিতার শিক্ষা দেয়। অভাবের কারণে যাদেরকে ক্ষুধার্ত থাকতে হয়, তাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা অনুভব করে তাদেরকে আহার দিতে রোজা আমাদেরকে উদ্বুদ্ধ করে। হজরত সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত- নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘রমজান সবরের মাস আর সবরের প্রতিদান জান্নাত।’ বায়হাকি। ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা সবর ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।’ – সূরা আল বাকারা: ১৫৪ সুতরাং রমজানে সিয়াম সাধনা আমাদেরকে শিক্ষা দেয় সবর ও সহমর্মিতা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রোজা অবস্থায় বউকে চুমু (kiss) খেলে বা জড়িয়ে ধরলে কোন সমস্যা আছে? যদি হ্যাঁ হয় তাহলে আবেগ না আসলে?
আবু রুফাইদাহ রফিক: সওম অবস্থায় স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরা কিংবা চুম্বন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ এ অবস্থায় একজন পুরুষ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। তবে রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সওম অবস্থায় তার কোনো কোনো স্ত্রীকে চুম্বন করেছেন বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে। একই হাদিসে এ কথাও উল্লেখ আছে যে, রাসুল নিজের জৈবিক চাহিদাকে যতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারতেন, তোমাদের পক্ষে তা সম্ভব নাও হতে পারে। (বুখারী, ৩০/২৩)।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তারাবীর সম্পর্কে কেউ কেউ বলেন যে, এই নামায আট রাকাত। বিশ রাকাত তারাবীর কোনো প্রমাণ নেই। জানতে চাই, তাদের দাবির সত্যতা কতটুকু?
আবু রুফাইদাহ রফিক: রাসুল সাল্লালাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বিশ রাকাত নয়, বরং আট রাকাত তারাবির প্রমাণ রয়েছে। বিশ রাকাত তারাবির প্রচলন ওমর রা. এর সময় থেকে শুরু হয়েছিল। সুতরাং কেউ ইচ্ছে করলে আট কিংবা বিশ রাকাত পড়তে পারে। এ নিয়ে বিতর্ক করা উচিৎ হবেনা। মনে রাখতে হবে, নফল নামাজে রাকাতের সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং নামাজে কত দীর্ঘ কেরাত পড়া হয় এবং কত ধীরে-সুস্থে বিনয়ের সাথে পড়া হয়, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উত্তম সালাত সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জবাব দেন, 'তূলুল কুনূত' তথা দীর্ঘ সময় বিশিষ্ট সালাত।(মুসলিম)। তারাবির নামাজও নফল। তাই তাড়াহুড়ো করে বিশ রাকাত পড়ার চেয়ে ধীরেসুস্থে মনোযোগ দিয়ে আট রাকাত পড়াই উত্তম। কেউ বিশ রাকাত পড়তে চাইলে অবশ্যই ধীরেসুস্থে পড়তে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন অমুসলীম ভাই প্রশ্ন করেছেন। মুসলিমরা রোযার মাসে জোর করে হোটেল-রেঁস্তোরা বন্ধ রাখে। যারা রোযা করে না তাদের উপর এটা জুলুম নয় কি?
আবু রুফাইদাহ রফিক: যে সমাজে রোজাদারের সংখ্যা বেশি, সেখানে হোটেল রেস্তোরাঁ বন্ধ রাখাই যুক্তিযুক্ত। তবে অমুসলিমদের জন্য সীমীত আকারে খাবরের দোকান খোলা রাখার জন্য নিষেধ করা হয় না। আর যেখানে মুসলিমরা সংখ্যালঘু, সেখানে খাবারের দোকান বন্ধ রাখতে চাপ প্রয়োগ করবে কে?
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রোযা থেকে একজন মানুষ পানি শূন্যতায় ভোগার কথা নয় কি?
আবু রুফাইদাহ রফিক: আমাদেরকে মনে রাখতে হবে, সিয়াম একটা ইবাদত, যা আল্লাহর সন্তুষ্টির আশায় আমরা পালন করি। এখানে কষ্ট কতটুকু সেটা বিবেচনায় নিয়ে আমরা এ ইবাদত পালন করিনা। আমাদের বিবেচনার বিষয় হচ্ছে আল্লাহর সন্তোষ অর্জন। কিন্তু যারা আল্লাহ ও পরকালে বিশ্বাস রাখেনা, তারা পার্থিব স্বার্থ ছাড়া অন্য চিন্তা করতে পারেনা। সুতরাং তাদের কাছ থেকে এমন অবান্তর প্রশ্ন আসাই স্বাভাবিক। তারপরও বলবো, একজন সুস্থ মানুষ সিয়াম সাধনার কারণে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে, এমন প্রমাণ নেই। ইসলাম সামর্থ্যের বাইরে কাউকে কিছু করতে বলেনা। এ জন্য অসুস্থ, বয়স্ক এবং মুসাফিরের জন্য রমজানের সওম না রাখার সুযোগ দিয়েছে। কোন সুস্থ ব্যক্তিও যদি দিনের মাঝখানে এসে পানি শূন্যতায় ভোগে এবং তার মারাত্মক ক্ষতি হওয়ার আশংকা দেখা দেয়, তবে সে রোজা ভাঙ্গতে পারবে এবং পরে কাজা করে দিতে পারবে। সুতরাং আর কোন প্রশ্ন থাকতে পারেনা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মানুষ যদি কখনো চাঁদে বা মঙ্গলে কিংবা অন্য কোনো দূরবর্তী গ্রহের উপর বসতি স্থাপন করে তখন তারা কেমন করে রোযা করবে? চাঁদের মাটিতে থেকে কি চাঁদ দেখে রোযা/ঈদ করা সম্ভব?
আবু রুফাইদাহ রফিক: ইসলামের বিধানগুলো দুনিয়ার অধিবাসীদের জন্য, চাঁদ বা অন্য গ্রহের অধিবাসীদের জন্য নয়। আল্লাহ সবকিছুর স্রষ্টা, তিনিই ভালো জানেন মানুষ কোথায় বসবাস করার ক্ষমতা রাখে। আশা করি দুনিয়া ছেড়ে স্থায়ীভাবে অন্য গ্রহে বসবাস করার কোনো সুযোগ কখনো হবেনা। সুতরাং এ প্রশ্ন অবান্তর মনে হয়। তারপরও প্রশ্নকারীকে এতটুকু বলতে পারি যে, আগে সেখানে গিয়ে কোন মুসলিম বসবাস করা শুরু করুক, তারপর না হয় ফতোয়া দেওয়া যাবে। প্রতিটি নতুন সমস্যার সমাধান কিয়াস এবং ইজমার ভিত্তিতে করার সুযোগ ইসলামে রয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রোযার মাসে শয়তানকে নাকি শেকল দিয়ে বন্দী করে রাখা হয়! তাহলে এই মাসে মানুষ অপরাধ করে কী করে? তাছাড়া অদৃশ্য শয়তানকে শেকল দিয়ে বন্দী করে রাখা যায়-ই বা কীভাবে?
আবু রুফাইদাহ রফিক: মানুষ শুধু শয়তানের ধোঁকায় অন্যায় কাজ করেনা, জন্মগতভাবেই মানুষের মধ্যে খারাপ কাজের প্রবণতা থাকে, যা তাকে খারাপ কাজে উদ্বুদ্ধ করে। কুরআনে বলা হয়েছে, নিশ্চয়ই মানবাত্মা অন্যায়ের দিকে অধিক প্ররোচনাদায়ক। সুরাহ ইউসুফ, ৫৩। সুতরাং শয়তান বন্দি হলেও এই প্রবণতা মানুষকে অন্যায কাজে চালিত করে। আবার শয়তানের একটা প্রভাবও মানুষের মধ্যে থেকে যায়। রমজানের পূর্বে যে যত বেশি শয়তানের অনুসরণ করে, রমজানে তার মধ্যে শয়তানের প্রভাব তত বেশি কাজ করে। তাছাড়া জিন শয়তান বন্দি হলেও মানব শয়তান তো আছেই, যারা শয়তানের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং শয়তানি কর্মকাণ্ড মানুষের সামনে সাজিয়ে তুলছে (আল্লাহু আ'লাম)। তবে শয়তান বন্দি হওয়ার কারণে রমজান মাসে অন্যায় অপরাধ কমে যায়, এটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রোযা যদি আয়ু বাড়ায় তাহলে মুসলিমদের আয়ু সবচেয়ে কম কেন?
আবু রুফাইদাহ রফিক: আমার জানামতে, রোজা আয়ু বাড়ায়, এমন কথা কুরআন হাদিসের কোথাও বলা নেই। সুতরাং এ প্রশ্ন আসা উচিৎ নয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অটোফেজি কী? অটোফেজির সাথে রোযার কোনো সম্পর্ক আছে কি?
আবু রুফাইদাহ রফিক: অটোফেজি মানে আত্মভক্ষণ বা নিজেকে খেয়ে ফেলা। এটা শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গসমূহকে পরিষ্কার করার একটি প্রক্রিয়া, যা সম্পন্ন হয় কোষীয় পর্যায়ে। এ পদ্ধতি চালু করতে প্রয়োজন ইন্টরমিটেন্ট ফ্যাস্টিং বা সবিরাম উপবাস। এটি একটি পরিকল্পিত উপবাস, যার নির্দিষ্ট নিয়ম ও ডিজাইন থাকে। রোজা তেমন এক ধরনের উপবাস, যা ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে মুসলিমরা রমজান মাসে পালন করে থাকে। রমজান শব্দটি রমজ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, যার অর্থ জ্বালিয়ে দেওয়া, যা অটোফেজি শব্দের সাথে মিলে যায়। অটোফেজি শুধু সুস্থ মানুষের জন্যই উপকারী। রোজাও শুধু সুস্থদের উপরই ফরজ। উল্লেখ্য, রোজা বা মুসলিমদের অন্যান্য ইবাদত চিকিৎসা বিজ্ঞানের অনেক পদ্ধতির সাথে মিল রাখে এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় প্রমাণিত হয়েছে, যা আমাদের পার্থিব লাভ এবং ইসলামের সৌন্দর্য৷ কিন্তু স্মরণ রাখতে হবে, আমাদের ইবাদতের মূল চেতনা পার্থিব কল্যাণ লাভ নয়, বরং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের মাধ্যমে পরকালীন কল্যাণ ও মুক্তি অর্জন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
আবু রুফাইদাহ রফিক: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।