৫ বার অজু করলে সাবান প্রয়োজন নেই— এমন কথাও শুনতে হয়েছে
গাজীপুর জেলা প্রশাসন কার্যালয়ে কর্মরত সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট উম্মে হাবিবা ফারজানা। তিনি ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের একজন সদস্য। সিভিল সার্ভিসে কর্ম জীবনের শুরুতেই করোনা সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই মোবাইল কোর্ট পরিচালনাসহ প্রশাসনিক অনান্য কাজ করতে হচ্ছে। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে সাক্ষাতকারে মোবাইল কোর্টের অভিজ্ঞতা, প্রশাসনিক কার্যক্রমসহ বিভিন্ন বিষয় উঠে এসেছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুজাহিদ উদ্দীন—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনা সময়ে কেমন আছেন জানতে না চেয়ে জানতে চাই নিজেকে কীভাবে মানসিকভাবে ভালো রাখছেন?
উম্মে হাবিবা ফারজানা: আল্লাহর অশেষ রহমতে ভালো আছি। আমার উপর রাষ্ট্রের অর্পিত দায়িত্বগুলো সুষ্ঠুভাবে পালন করার চেষ্টা করছি। নিজের মনোবল অটুট রাখার জন্য চিন্তাভাবনা পজিটিভ রাখতে হবে। কথায় আছে, পজিটিভ মানুষেরা সমস্যার মধ্যেও সমাধান খুঁজে পান, আর নেগেটিভ ব্যক্তিরা সমাধানের মাঝে সমস্যা খুঁজে পান। নিজের দৈনন্দিন কাজগুলো নিজে করছি, বই পড়ছি, ধর্মকর্মে বেশি মনোযোগী হয়েছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাইরের পরিবেশ কেমন দেখছেন? জনসাধারণের সহযোগিতা কেমন পাচ্ছেন ?
উম্মে হাবিবা ফারজানা: আমরা যারা বাইরে করোনা মোকাবেলায় সরাসরি মাঠে আছি (ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, দেশব্যপী মাঠ প্রশাসন, পুলিশ, আর্মি, আনসার, গ্রাম পুলিশ, সাংবাদিক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী), সকলেই ঝুঁকি মাথায় নিয়েই কাজ করছি। করোনা আমাদের স্বাভাবিক অভ্যাসে হানা দিয়েছে। তাই সকলেরই কিছু না কিছু সমস্যা হচ্ছে। বাজারের ভিড়টা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে, আর আছে কিছু বৈকালিক ভ্রমণে বের হওয়া মানুষ। সবার প্রতি অনুরোধ থাকবে বাজারটা সাপ্তাহিক প্লান করে করলে ভালো হয়। করোনাকালে বাইরে বের হওয়া যাবে না! লকডাউন মানতে যত গাফিলতি করবো আমরা ততই লকডাউন প্রলম্বিত হবে। গার্মেন্টসের কিছুসংখ্যক মালিকগণ বিভিন্ন কারণে শ্রমিকদের মজুরি পরিশোধ করতে পারেননি! মাঝে মাঝেই বাধ্য হয়ে শ্রমিকরা রাস্তায় নামছেন। এ কারণে অরাজকতা তৈরি হচ্ছে।
আর জনগণের সহযোগিতার কথা বললে, জনগণ বেশিরভাগই সচেতন। তারা প্রশাসন, পুলিশ, আর্মিদের কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করছেন। মাস্ক পরিধান করছেন। কিন্তু যেটা হচ্ছে, অনেকে জরুরি কাজ ছাড়াও ঠুনকো অজুহাতে বাইরে আসছেন, এটা অবশ্যই পরিহার করতে হবে। আর সকলের প্রতি অনুরোধ, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে, নিউজপোর্টালে বা খবরের কাগজে যে সংবাদই দেখুন, একটু যাচাই-বাছাই করে বিশ্বাস ও শেয়ার করুন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনার এই সময়ে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোনো ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন কিনা?
উম্মে হাবিবা ফারজানা: মাঠে কাজ করতে গিয়ে প্রতিকূল অবস্থার সম্মুখীন হতেই পারে। আমরা সর্বদা যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকি। একটি কটু অভিজ্ঞতা হয়েছিল করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার প্রথম দিকের অভিযানে একটি মাদ্রাসায় গিয়ে। করোনাভাইরাস তাদের ক্ষতি করতে পারবে না, বা তারা ৫ বার অজু করছেন বলে তাদের সাবান ব্যবহারের প্রয়োজন নেই; এরকম কিছু মতামত তারা দিচ্ছিলেন। এমনকি নারী কেন মাদ্রাসার ঢুকলো এমন আপত্তিও একজন করেছিলেন।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের অনুভূতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেই করোনার ভয়াবহতা বোঝাতে সমর্থ হই, এবং তারা পরবর্তীতে মেনে নেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দায়িত্বপালন কালে ভালো কোন অভিজ্ঞতা আমাদের সাথে যদি শেয়ার করতেন।
উম্মে হাবিবা ফারজানা: দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি কিছু কাজ ভীষণ প্রশান্তিদায়ক। করোনা পরিস্থিতিতে কাজ করতে গিয়ে অসহায়, প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক দেখলে আমি নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী তাকে ৫-৬ দিন চলার মত কিছু টাকা দিয়ে রিকশা ডেকে তার আবাসস্থলে পাঠাই। অনেকে অনেক রকমভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন এটাকে, আজকাল সব কথারই ভিন্ন অর্থ টেনে আনা হয়! যে যাই বলুন, আমার কাছে এটাই দেশপ্রেম।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মাঠপর্যায়ে পুলিশ, সেনাবাহিনীর সাথে কিভাবে সমন্বয় করে কাজ করছেন?
উম্মে হাবিবা ফারজানা: প্রথমদিকে আমরা পুলিশ ও আনসারের সহযোগিতায় মাঠে কাজ করেছি। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সেনাবাহিনী মাঠে নামে। বর্তমানে ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, সেনাবাহিনী এক টিম আকারে পেট্রোল ডিউটি করছে। নির্ধারিত সময়ের বাইরে দোকানপাট বন্ধ করা, জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা সহ সরকারি নির্দেশগুলো বাস্তবায়ন করতে একটি টিম হয়েই কাজ করছি আমরা। আইন বহির্ভূত কিছু নজরে আসলে দায়িত্বরত ম্যাজিস্ট্রেটগণ আইন অনুযায়ী মোবাইল কোর্টে শাস্তি দিচ্ছেন। সমন্বয় করে কাজ করার ফলে ভালো ফলাফল পাচ্ছে দেশবাসী, জনগণ মহামারির ভয়াবহতা ও লকডাউনের গুরুত্ব অনুধাবনে সমর্থ হয়েছেন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জনসাধারণের উদ্দেশ্যে করোনা মোকাবিলায় আপনার পরামর্শ কী?
উম্মে হাবিবা ফারজানা: আমাদের Solitude ও Loneliness এর মধ্যে পার্থক্য বুঝতে হবে। Solitude হলো- নিজেকে সঙ্গ দেয়া, মনে রিলাক্সমেন্ট এর জন্যে। চিন্তাশীলতাকে আরো গতিশীল করা। Loneliness মানে- একাকীত্বে ভোগা। এই সময়ে যাদের একা থাকতে হচ্ছে, পরিবার থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে, আমরা Solidarity উপভোগ করতে পারি। -অনলাইন ভিডিও কল, ভয়েস কলের মধ্যমে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারি গ্রুপ করে। দ্য ল্যানসেট জার্নালে একটি গবেষণায় প্রকাশিত হয়, কোয়ারেন্টাইনে মানসিক সমস্যা, হতাশা, অনিদ্রা, বিরক্তিভাব, মানসিক চাপ, অল্পতে রেগে যাওয়া, মানসিক অশান্তি ইত্যাদি হতে পারে। WHO এর পরামর্শ মতে, মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিতে যোগব্যায়াম ও মেডিটেশন করা যেতে পারে। নিজের ভালোলাগাগুলো খুঁজে নিয়ে ডেইলি রুটিন তৈরি করে নিতে পারি। আমাদের মধ্যে যারা প্রবীণ আছেন, তাদের মৃত্যুভয় জেঁকে বসতে পারে, তাদেরকে সময় দেয়া প্রয়োজন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ।
উম্মে হাবিবা ফারজানা: ধন্যবাদ।