নারীর ক্ষমতায়নে পরিবারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে
প্রতিবছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবস পালন করা হয়ে থাকে। নারীর বিভিন্ন বৈষম্যও অবহেলাকে প্রাধান্য দিয়ে দিনটিকে নারীর অধিকার ফিরে পাবার লড়াই হিসেবে প্রজ্জ্বলিত করা হয়েছে। এই দিবসটি ঘিরে জমে থাকা নারীর বিভিন্ন সংগ্রাম ও লড়াইয়ের বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করার জন্য গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্রের সাথে কথা বলেছেন তানভীর আহম্মেদ ও অনিক আহম্মদ। তাঁর সাক্ষাতকারের চুম্বক অংশটুুকু নিচে তুলে ধরা হল—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সংক্ষেপে আপনার পরিচয়টা বলবেন?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: আমি ড. কৃষ্ণা ভদ্র। সিলেটের হবিগঞ্জ জেলায় আমার জন্ম। হবিগঞ্জের বিকেজিসি গভঃ গালর্স হাইস্কুল থেকে ১৯৮৩ সালে মেট্রিক্স, বৃন্দাবন সরকারি কলেজ, হবিগঞ্জ থেকে ১৯৮৫ সালে এইচএইচসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অনার্স এবং ১৯৯৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে মাস্টার্স করেছি। এছাড়াও ভারতের মহারাষ্ট্রের, পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৯ সালে পিএইচডি অর্জন করি। এরপরে ‘বিলাস’ নামক একটি এনজিওতে ৯ বছর কাজ করেছি এবং সেখানে ওই এনজিওর প্রজেক্ট কো-অর্ডিনর হিসেবে আমি ১০টা স্কুল প্রতিষ্ঠা করি। এছাড়াও নিফট নামে আরেকটা এনজিওর সহ-সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি। পাশাপাশি আমি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সিনিয়র সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারী দিবস সম্পর্কে আপনার ভাবনা কী?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: নারীকে কোন দিবসের মধ্যে ফেলা যায় না। নারী-পুরুষের মধ্যে কোন ভেদাভেদ নেই। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই মানুষ। কাজী নজরুল ইসলামের নারী কবিতার মতো, গাহি সাম্যের গান-
আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী,অর্ধেক তার নর।
ঠিক তেমনি নারীদের দিবসের মধ্যে আটকে রাখা যাবে না। তাঁদের মানুষের মতো বাঁচতে দিতে হবে, তবেই নারী তাঁর অধিকার ফিরে পাবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিবসটির কতটুকু ভূমিকা আছে বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: অনেক ভূমিকা আছে। একজন নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় দিবসটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই বিশেষ রকমের চেতনার উন্মেষ ঘটে। সচেতনা বৃদ্ধি পায়, কুসংস্কার, খারাপ মনোভাব ইত্যাদি বিষয়ের পরিবর্তন ঘটে। তাঁদের সম্পর্কে বাজে ধারণার পরিবর্তন ঘটে। নারীরা নিজেদের নিয়ে কথা বলার মতো বিশেষ একটি শক্তি পায়। নিজেদের তুলে ধরতে পারে, প্রকাশ করতে পারে। তাঁদের সম্পর্কে ভুল ধারণা গুলোর উপর চ্যালেঞ্জ দিতে পারে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন নারী শিক্ষক হওয়ার পিছনে আপনাকে কতটা সংগ্রাম করতে হয়েছে
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: আমার পরিবারের অনেক বেশি সাপোর্ট থাকায় আমাকে খুব বেশি একটা সংগ্রাম করতে হয়নি। তবে, সমাজের মানুষের নিকট মাঝে মাঝে বাজে মন্তব্যের শিকার হতে হয়েছে। কখনো কখনো সমাজের মানুষ নারী শিক্ষা নিয়ে বাজে মন্তব্য করতো। ঘরের বাহিরে যাওয়া নিয়েও তাঁরা কটুক্তি করতো। আমার পরিবার কখনোই বিষয়গুলো মাথায় নেয়নি। আমিও কখনো এসব বিষয়ে মাথা ঘামায়নি। যার ফলে এই বিষয়টা বড় কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যাতায়াতেও বেশি একটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি। তবে, কিছু কিছু সময় অত্যন্ত খারাপ লাগার বিষয় ছিল। সব মিলিয়ে আমার জীবনটা অতটা সংগ্রামী না হলেও এই পর্যন্ত আসতে মোটামুটি সংগ্রাম করতে হয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীর ক্ষমতায়নে একটা পরিবারের কি কি ভূমিকা রাখা প্রয়োজন?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: অবশ্যই পরিবারের সর্বোচ্চ ভূমিকা থাকতে হবে। একটা পরিবারই পারে একজন নারীকে ক্ষমতার আসনে বসিয়ে দিতে। পরিবারের সাপোর্ট থাকলে আমি মনে করিনা অন্য কোন কিছুর দরকার আছে। আজকে মেয়েরা ক্রিকেট খেলছে, ফুটবল খেলছে, ডাক্তার হচ্ছে, ইঞ্জিনিয়ার হচ্ছে সবটা কিন্তু পরিবারের সাপোর্ট থাকায় সম্ভব হচ্ছে। পরিবারের সাপোর্ট থাকলে সমাজে হাজার জনে হাজার কথা বললেও কোন কিছু আসে যায় না। আমি মনে করি, নারীর ক্ষমতায়নে পরিবারই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীর অগ্রগতিতে কোন কোন বিষয়গুলোকে বাঁধা হিসেবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: বাল্য বিবাহ, নারীদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা, কুসংস্কার, পরিবারের অসচেতনা, সামাজিক অবক্ষয়, কু-মনোভাব ইত্যাদি বিষয়গুলো নারীকে প্রতিনিয়ত বাঁধার সৃষ্টি করে। এ ধরনের বিষয়গুলোকেই মূলত নারীর অগ্রগতিতে বাঁধা হিসেবে দেখছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীর অগ্রগতিতে নারীদের কি ভূমিকা রাখা দরকার?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: প্রথমত নারীকে সবকিছু ইতিবাচক হিসেবে নিতে হবে। কখনোই অতিরিক্ত উত্তেজিত কিংবা মাথা গরম করে কোন কিছু করা যাবে না। সব কিছু সু-কৌশলে করতে হবে। সব সময় নিজেকে মেলে ধরার চেষ্টা করতে হবে। নিজের অধিকার সচেতন হতে হবে। নিজের তাগিদে নিজেকে নিজে গড়ে তুলতে হবে। সব সময় অধিকার আদায় করে নিতে হবে, নিজের জায়গা তৈরি করে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীর অগ্রগতিতে পুরুষের কতটুকু ভূমিকা থাকা প্রয়োজন?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: পুরুষের সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখতে হবে। একজন পুরুষের সাপোর্ট ছাড়া একজন নারী কখনও উন্নতি করতে পারবে না। নারীকে প্রতিনিয়ত সাপোর্ট দিয়ে যেতে হবে। নারী-পুরুষ মিলিয়েই সমাজ ব্যাবস্থা। পুরুষের সাহায্য ছাড়া নারীর অগ্রগতি কখনোই সম্ভব নয়। পুরুষ যদি সর্বদা সকল কাজে তাঁদের সহায়তা করতে পারে তাহলে নারীরা কখনোই বাঁধার সম্মুখীন হবে না। এক্ষেত্রে পুরুষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নারীর নিরাপত্তাজনিত প্রশ্নে আপনার কি বলার আছে?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: আজকের সমাজের নারীরা ঘরে-বাহিরে সব জায়গায় নিরাপত্তা হীনতায় ভুগছেন। মেয়েদের প্রতি নেতিবাচক চিন্তা-ধারার জন্যই তাঁরা বিভিন্ন হয়রানির শিকার হচ্ছে। অসুস্থ, বিকৃত মানুষগুলো মেয়েদের নিরাপদে চলাচল করার প্রধান বাঁধা। আমাদের নারীদের নিরাপত্তা খুবই সংকটাপন্ন এই বিষয়গুলোকে অবশ্যই পরিত্রাত করতে হবে। মানুষের মানুষিকতার পরিবর্তন নিয়ে আসতে আসতে হবে, একটি সভ্য সমাজ ব্যাবস্থা তৈরি করতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি দেশে ধর্ষণের হার অনেক বেড়ে গেছে— এই সম্পর্কে কি বলবেন? ধর্ষণ রোধে করণীয় কি হতে পারে?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: অত্যন্ত বিকৃত মানুষগুলো এসব করে থাকে। আর তাদের মাথায় কোন সুস্থ বোধ নেই। ধর্ষকের কোন দেশ নেই, মা-বোন নেই। সমাজে মূল্যবোধের অভাব, নৈতিক অবক্ষয়ের অভাব, হতাশাগ্রস্ত, নেশাগ্রস্ত সমাজ ব্যাবস্থা এসব বর্বরদের তৈরি করে। ধর্ষণ রোধে অবশ্যই আইনের সু-শাসন জরুরি। প্রশাসনের দায়িত্বশীলতা ও দায়বদ্ধতাও থাকতে হবে। সাথে সরকারের কঠোর নির্দেশনাও থাকতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যেসব নারীরা মুখ বুজে সব অন্যায়-অত্যাচার মেনে নিয়ে চুপ করে থাকে তাঁদের সম্পর্কে কিছু বলার আছে?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: কখনোই চুপ করে থাকা যাবে না। আবার অতিরিক্ত রাগান্বিতও হওয়া যাবে না। সুবিধামতো রুখে দাঁড়াতে হবে। পরিস্থিতি বুঝে নিজের করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। নিজের অধিকার নিজেকেই আদায় করে নিতে হবে। চুপ করে থাকলে কখনোই নিজের নায্য অধিকার কিংবা নিজের উপর হওয়া অন্যায়ের বিচার পাওয়া যায় না। তাই প্রতিবাদ করতে হবে। কখনো চুপ করে থাকা যাবে না।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যেসব নারীরা লড়াই করে এগিয়ে যাচ্ছে এবং আগামীতে যারা লড়াইয়ে সামিল হবে তাঁদের বিষয়ে কি বার্তা আছে?
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: কখনও ভয় পেলে চলবে না। সাহসের সাথে এগিয়ে যেতে হবে। নেগেটিভ কোন বিষয় ভেবে দমে যাওয়া যাবে না। সব সময় পজিটিভলি ভাবতে হবে। পুরুষের সাথে মিশতে হবে। সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মূল্যবান সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. কৃষ্ণা ভদ্র: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।