হাওরের তরুণ মানে শুধু সংগ্রামী নয়, স্বপ্নদ্রষ্টাও
নেত্রকোনার হাওরাঞ্চল (খালিয়াজুরী, মদন এবং মোহনগঞ্জ) প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে ভরপুর এক অঞ্চল। চারদিক জলে ঘেরা, অথচ ভেতরে লুকিয়ে আছে অপরিসীম প্রাণশক্তি-যা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তরুণদের মাঝে। খালিয়াজুরী, মদন আর মোহনগঞ্জ এ তিনটি উপজেলাকে মাওলানা আব্দুল হালিম খান ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল খান (এফ সি এ) দেখেন হাওরের হৃদয়ের মতো; আর এখানকার তরুণরাই সেই হৃদয়ের স্পন্দন।
দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, যখন এ এলাকার তরুণদের কথা ভাবি, তখন তাদের চোখে দেখি এক অদম্য ইচ্ছাশক্তি, এক অনন্ত সম্ভাবনার আলো। আমার বিশ্বাস, এ তিন উপজেলার তরুণরাই একদিন বদলে দিতে পারে নেত্রকোনার চেহারা -যদি তারা সুযোগ, দিকনির্দেশনা এবং প্রয়োজনীয় প্ল্যাটফর্ম পায়।
‘প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে গড়া শক্ত মানুষ’- তাদের উদ্দেশে কি বলতে চান?
হাওরের জীবন সহজ নয়। বর্ষায় যখন চারপাশ ডুবে যায়, তখন স্কুলে যাওয়া থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান-সবকিছুই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ কঠিন বাস্তবতার মধ্যেই তরুণরা নিজেদের নতুনভাবে তৈরি করছে। খালিয়াজুরীর এক তরুণ কৃষক যেমন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ধানের উৎপাদন বাড়াচ্ছেন, তেমনি মদনের কিছু তরুণ ফেসবুক আর ইউটিউব ব্যবহার করে স্থানীয় পণ্য বিক্রি শুরু করেছেন। মোহনগঞ্জে আবার তরুণ সংগঠকরা হাওরের সংস্কৃতি, গান আর নৌকা বাইচের ঐতিহ্যকে নতুন করে তুলে ধরছেন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে। আমি চাই এ সবকিছুর একটা সমন্বয় করতে। যেন আমার তরুণ বন্ধুরা সব প্রতিবন্ধকতা পার করে দেশ ও সমাজ গঠনে নিজেদের এক অনন্য উচ্চতায় নিজেদের নিতে পারে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে নতুন আশার আলোতে কি খালিয়াজুরী, মদন এবং মোহনগঞ্জের তরুণরা আলোকিত হতে পারবে?
হাওরের তরুণদের সবচেয়ে বড় শক্তি তাদের শেখার আগ্রহ। খালিয়াজুরী, মদন এবং মোহনগঞ্জের তরুণদের কাছে হয়ত এখন অনলাইন ক্লাস, ডিজিটাল লাইব্রেরি-এসব শব্দ অপরিচিত নয় তবে তাদের কাছে এগুলোর ব্যবহার এখনও সম্পূর্ণ ভাবে পৌঁছানো হয়নি। আমি চাই আমার এলাকাবাসীকে সাথে নিয়ে উদ্যোগ নিয়ে আইটি ট্রেনিং সেন্টার চালু করতে, যাতে গ্রামের ছেলেমেয়েরা শহরে না গিয়েও প্রযুক্তি শিখতে পারে। আমার তরুণ বন্ধুদের সাথে নিয়ে কোচিংয়ের বদলে ‘শিক্ষা ক্লাব’ বানিয়ে তাদের কাঙ্ক্ষিত যে আকাঙ্ক্ষা তা পূরণ করতে। তারা যেন এ থেকে শুধু চাকরি জন্য নিজেদের সব সময় না শেষ করে, সৃজনশীল কিছু করা ও শিক্ষার অনুপ্রেরণা পাই।
হাওরের তরুণদের সামনে চ্যালেঞ্জও কম নয়, তাদের জন্য আপনার করণীয়?
বর্ষার জল যেমন আশীর্বাদ, তেমনি দুর্ভোগও বটে। চাকরির অভাব, যোগাযোগব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা, আর প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের অভাব এসবই তরুণদের সম্ভাবনাকে বারবার থামিয়ে দেয়। অনেকেই বাধ্য হয়ে ঢাকামুখী হন। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, হাওরের ভিতরেই তাদের ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্ভব-যদি আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই, সুযোগ তৈরি করি। আমি সেই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছি। গত ২৮ তারিখ তার প্রতিফলন হিসাবে আমি একটা চাকরির মেলা আয়োজন করেছিলাম। সামনে আমার তরুণ বন্ধুদের জন্য আরও নতুন কিছু আসবে ইনশাআল্লাহ।
তার ভাষ্য, আমার কাছে হাওরের তরুণ মানে শুধু সংগ্রামী নয়, স্বপ্নদ্রষ্টাও বটে। খালিয়াজুরী, মদন ও মোহনগঞ্জের প্রত্যেকটা তরুণের মধ্যে আমি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ দেখি। তাদের জন্য প্রয়োজন বাস্তব প্রশিক্ষণ, সুন্দর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, উদ্যোক্তা সহায়তা, এবং সবচেয়ে বেশি একটা প্ল্যাটফর্ম, যেখানে তারা নিজেদের প্রতিভা দেখাতে পারবে।
‘হাওরের জল যেমন কখনো স্থির থাকে না, তেমনি এখানকার তরুণরাও থেমে নেই। তারা বদলে দিচ্ছে নিজেদের জীবন, আর ধীরে ধীরে বদলে দিচ্ছে হাওরের গল্পও। চাই শুধু একটু দৃষ্টি, একটু বিশ্বাস-তাহলেই নেত্রকোনার এই তিন উপজেলা একদিন বাংলাদেশের তরুণ শক্তির প্রতীক হয়ে উঠবে। পরিশেষে বলতে চাই, আমি বিশ্বাস করি যে তরুণ হাওরের জলে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে ভবিষ্যৎ খোঁজে, সে একদিন পুরো দেশকে নতুন আলো দেখাতে পারে।’