০২ আগস্ট ২০২৫, ১৮:২০

প্রয়োজন সেল-এ্যাবল গ্র্যাজুয়েট, কারণ শিক্ষিত শ্রেণি রাষ্ট্রের যত বড় থ্রেট, অশিক্ষিত তার অর্ধেকও না

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী  © টিডিসি সম্পাদিত

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজির (বিইউবিটি) উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। দীর্ঘ শিক্ষাজীবনে তিনি একাধারে শিক্ষক, গবেষক, প্রশাসক ও শিক্ষাবিদ হিসেবে নিজের দক্ষতা ও দায়বদ্ধতার পরিচয় দিয়েছেন। বিইউবিটিতে যোগদানের আগে এই অধ্যাপক ফিজি দ্বীপপুঞ্জের ইউনিভার্সিটি অব ফিজিতে প্রথমে কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক, হিসেবে কর্মরত ছিলেন। পরে স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ডিন এবং ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। উচ্চশিক্ষার বর্তমান চ্যালেঞ্জ, গবেষণার সুযোগ, শিক্ষার মান, বিইউবিটিকে ভবিষ্যতে একটি শিক্ষাবান্ধব বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্নসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটির চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো-

ইসলামী বিশ্ববিদ্যাালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড-দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের মত দেশে কর্মজীবনের অভিজ্ঞতা থাকার পরও কেন বাংলাদেশে ফিরলেন, উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আল্লাহর কাছে প্রথম শুকরিয়া যে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা আমাকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কাজ করা সুযোগ করে দিয়েছেন। তবে শিক্ষকতা শুরু করেছি বাংলাদেশ থেকেই; যেখানে বীজ বপণ, সেখানে তো আসতে হয়, রুটের কাছে আসতে হয়। সে জন্যই আসা। কিন্তু মূল যে ফিলিংস; সেটা হলো দেশ আমাকে অনেক দিয়েছে, আমার সরকার আমার প্রতি অনেক ইনভেস্ট করেছে। রেজাল্ট ভালো করার সুবাদে স্কলারশিপ দিয়েছে। তাই যে সরকার, যে দেশ আমাকে এত কিছু দিয়েছে, আমি তাকে কিছু না দিয়ে দুনিয়া থেকে চলে যাব— এটাতো হয় না। আমি মনে করি, প্রত্যেক নাগরিকের দেশের প্রতি, সমাজের প্রতি, একটা দায়বদ্ধতা থাকা উচিত। এ দায় যদি শোধ করে না যাই, ওই পাশে (পরকালে) জবাবদিহিতা খুব কঠিন হয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে ওই দায়টা শোধ করতে পারব কি না জানি না, তবে শোধ করতে চেষ্টার মানসিকতা নিয়ে দেশে ফিরেছি। ইনশাআল্লাহ, ‘আই উইল ট্রাই মাই বেস্ট’অ।

‘‘শিক্ষিত একটা শ্রেণি রাষ্ট্রের জন্য যত থ্রেট হবে, অশিক্ষিত শ্রেণি তার অর্ধেকও হবে না। কারণ শিক্ষিত লোকজনের ভেতরে প্রত্যাশা থাকে, তারা একটা স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়। মানুষের স্বপ্ন যখন আপনি ভেঙে দিবেন, তারা কিন্তু ডেঞ্জারাস বা বিপদজনক হয়ে যায়। আমার যে গ্রাজুয়েট হবে, তারা যেন ইন্ডাস্ট্রি রেডি গ্রাজুয়েট তৈরি হয়। তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে পরে না যায়। আপনি যদি একজন গ্র্যাজুয়েটকে দুয়েক বছর ফ্রাস্ট্রেশনে রেখে চাকরি দিবেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তার প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে।

বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার মান পর্যালোচনা করলে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোথায় পিছিয়ে আছে? অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও বড় প্রশ্ন এটি। এখানে লিডারশিপের একটা বিরাট প্রবলেম আছে। তবে, বাংলাদেশে গবেষণার একটা আবহ শুরু হয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ। এটা ভালো যে বর্তমান সময়ে যেসব উপাচার্য এসেছেন, তারা রিসার্চ স্কিল নিয়ে এসেছেন। লিডারশিপ গ্যাপটা মিনিমাইজ হওয়ার লক্ষণ আমি দেখতে পাচ্ছি। এটা আগে বিশাল বড় একটা গ্যাপ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য রিসার্চে ইনভেস্ট করলে কী লাভ হয়, জাতির জন্য রিসার্চের কী গুরুত্ব, এগুলো যদি না বোঝেন; তাহলে তো  রিসার্চ হয় না। ডিনের অবশ্যই পিএইচডি থাকতে হবে। যদিও কিছু ক্ষেত্রে অনেক ডিনের পিএইচডি নেই, অনেক উপাচার্যেরও পিএইচডি নেই।

একটা জাতি যখন রিসার্চ-নির্ভর হবে, বিশ্ববিদ্যালয় যখন রিসার্চ আউটকামে বেস্ট হবে, তখন ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। এক্ষেত্রে আমাদের সরকারকে অবশ্যই এগিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া শুধু সরকারের ঘাড়ে চাপিয়ে দিলে হবে না; নিজেদের জায়গা থেকেও এগিয়ে আসতে হবে। এছাড়া, আমাদের আরও অনেক চাওয়া আছে সরকারের কাছে। আমাদের কিছু ইন্ডাস্ট্রি আছে, এখন এগুলো ভালো অবস্থানে আছে। ইন্ডাস্ট্রিগুলোকে উৎসাহ দিতে হবে। ইন্ডাস্ট্রিগুলো মানি-রিসার্চ খাতে বিশ্ববিদ্যালয় বা রিসার্চ অর্গানাইজেশনগুলাকে ডোনেট করবে, আর সরকার ইন্ডাস্ট্রিগুলো ট্যাক্স ফ্রি করে দেবে বা গভর্মেন্ট রিওয়ার্ড দিতে পারে। গবেষণায় এভাবে বিনিয়োগ আসা শুরু হলে এটি আরও উন্নত হবে।

দেশে-বিদেশে থেকে কোন অভিজ্ঞতা বা অনুশীলনগুলো আপনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় বেশি প্রয়োগযোগ্য বলে মনে করেন?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আপনি সবসময় মনে রাখবেন, আপনি একজন ফার্মার। অনেকগুলা পটেটো প্রোডিউস করেছেন, কিন্তু পটেটো সিজন ভিত্তিতে আসে। কিন্তু যখন আসে তখন আপনাকে জানতে হবে, আপনার লোকাল মার্কেট এটা কনজিউম করতে পারবে কি-না, দূরে পাঠাতে গেলে ট্রান্সপোর্ট ব্যয়ের সাথে বাজারমূল্য মিল হবে কি-না; এই এনালাইটিক্যাল ক্যাপাবিলিটি আমাদের থাকতে হবে। আরেকটি বিষয়, আমি যদি সেল করতে না পারি, আমার বিভাগে স্টোরেজ আছে কি-না, প্রোপার কোয়ালিটির স্টোরেজ আছে কি-না। এই জিনিসগুলো যদি না খেয়াল রাখা হয়, তাহলে কিন্তু মার্কেটে সার্ভাইভ করা যাবে না। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে যেমন ফার্মাররা সুইসাইড করে, আমাদের এরকম সুইসাইড করলে সেটা কিন্তু এলার্মিং হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যে ধরনের গ্র্যাজুয়েট হচ্ছে, সেই গ্রাজুয়েটদের সেল-এ্যাবল করতে হবে। আমার গ্র্যাজুয়েটদের জব মার্কেটের জন্য ফিট করতে হবে, তারা যেন চাকরি পায়। মনে রাখবেন, শিক্ষিত একটা শ্রেণি রাষ্ট্রের জন্য যত থ্রেট হবে, অশিক্ষিত শ্রেণি তার অর্ধেকও হবে না। কারণ শিক্ষিত লোকজনের ভেতরে প্রত্যাশা থাকে, তারা একটা স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়। মানুষের স্বপ্ন যখন আপনি ভেঙে দিবেন, তারা কিন্তু ডেঞ্জারাস বা বিপদজনক হয়ে যায়। আমার যে গ্রাজুয়েট হবে, তারা যেন ইন্ডাস্ট্রি রেডি গ্রাজুয়েট তৈরি হয়। তারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে ফ্রাস্ট্রেশনে পরে না যায়। আপনি যদি একজন গ্র্যাজুয়েটকে দুয়েক বছর ফ্রাস্ট্রেশনে রেখে চাকরি দিবেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, তার প্রোডাক্টিভিটি কমে যাবে।

আপনার পেটে যখন কোন কিছু না থাকবে, তখন তো কিছু বের হবে না। আমরা লেকচার দেই, ওটা তো জ্ঞানের ভেতর থেকেই আসে। আমার যদি জ্ঞান না থাকে, তাহলে আমি ক্লাস রুমে গিয়ে কি জ্ঞান বিতরণ করব। এ জন্য আগে গবেষণা করতে হবে, তারপর ক্লাস রুমে যেতে হবে।

সম্প্রতি আয়োজিত এক কনফারেন্সে অতিথিদের সঙ্গে বিইউবিটি উপাচার্য

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কর্তা তথা উপাচার্য হিসেবে কোন বিষয়গুলোকে এখন বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার স্বপ্ন জানতে চাই?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আমরা তো শিক্ষক, আমরা তো স্বপ্ন দেখি, জেগেও দেখি, ঘুমেও দেখি, এটাই আমাদের কাজ। কারণ তা নাহলে তো আমরা ছাত্রদেরকে স্বপ্ন দেখাতে পারব না। আমরা পলিটিক্স না করলেও আমরাও কিন্তু ক্লাস রুমের লিডার। আমরা ইনস্টিটিউশনের লিডার। সে জন্য স্বপ্ন আমাদের দেখাতে হয়। সেই প্রশ্নে, স্বপ্ন তো বুক ভরা। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মান গুণগত পরিবর্তন হোক। আমরা টিচিং গুলোকে, কোর্স গুলোকে ইভ্যালুয়েশন করাচ্ছি। টিচারের পারফরম্যান্স গুলোকে আমরা ইভ্যালুয়েশন করাচ্ছি।

ডিনরা ক্লাসরুমে যাচ্ছেন, র‍্যাংকিং করছেন, ডাটাগুলা নিয়ে অ্যানালাইসিস করছি আমরা। একটা টিচারকে আমরা টার্গেট দিয়ে দিচ্ছি, আপনার এই লিমিটেশন, এক সেমিস্টার দুই সেমিস্টারের মধ্যে এটা ওভারকাম করতে হবে। যে পরিমাণ রিসোর্সের প্রয়োজন, সে রিসোর্স তাদেরকে দিয়ে দিচ্ছি। বিশ্ববিদ্যালয়কে ইন্টারন্যাশনাল র‍্যাংকিং নিয়ে আসাটা খুব জরুরি। আমার গ্রাজুয়েটরা কতো পার্সেন্ট বাইরে চাকরি পাচ্ছে, সুযোগ সুবিধা কেমন পাচ্ছে এগুলো সবকিছু নিয়ে আমরা কাজ করছি। আলটিমেটলি কিছু সময়ের পরে অর্থাৎ সম্ভাব্য দুয়েক বছরের মধ্যে আমরা ইন্টারন্যাশনাল, স্পেশালি কিউএস র্যাংকিংয়ের মতো জায়গায় বিউবিটির অবস্থানকে সুদৃঢ় করতে চাই। সেই সঙ্গে আমরা এডিশনালি আরো কিছু বিষয় নজর রাখছি।

‘কমিটেড টু অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্স’ এটাই কি বিইউবিটির বিশেষত্ব? এর স্বপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্জন-উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাই। ভর্তিচ্ছুরা উচ্চশিক্ষার জন্য কেন এই শিক্ষালয়কে বেছে নেবে?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: ‘কমিটেড টু অ্যাকাডেমিক এক্সিলেন্সি’ অবশ্যই এটা আমাদের মটো। আমরা চাই আমাদের গ্র্যাজুয়েটরা বিউবিটি এম্বাসেডর হয়ে বেঁচে থাকুক। আমাদের প্রত্যেকটা গ্রাজুয়েট হবে দেশের একেকটা সুনাগরিক। ‘ইন টার্মস অফ নলেজ অলসো রেস্পন্সিবিলিটি’ একটা মানুষকে যদি আপনি পরিবর্তন করতে চান, একে বিউটি পার্লার বা টেইলরে নিয়ে পুরোটা পরিবর্তন করতে পারবেন না। মানুষের মৌলিক পরিবর্তন আসে নৈতিকতায়, চিন্তায়, চেতনায়, মগজে। এখানে যদি পরবর্তন করতে পারেন, সেই পরিবর্তনটা হবে সাসটেইনেবল। আমরা ওই জন্য এই মটোটা রেখেছি। আমরা জ্ঞান দিয়ে সাজিয়ে দিতে চাই, পরিবর্তনটা এনে দিতে চাই। এটা আমাদের মূল লক্ষ্য। এর পেছনে আমরা কাজ করছি, শিক্ষকদের কোয়ালিটি বাড়াচ্ছি। শিক্ষকরা যাতে ভালো মানের রিসার্চ করেন, রিসার্চের মেসেজগুলো ক্লাস রুমে নিয়ে যান, আমরা ম্যানেজমেন্ট সেটা পর্যবেক্ষণ করছি।

বিইউবিটি ক্যাম্পাস

ভর্তিচ্ছুরা কেন আসবে না, আমরা এত কিছু করছি ওরা তো আসবেই। এখন যেটা হচ্ছে, আমরা ক্লাসরুমটাকে প্রথম অগ্রাধিকার দিচ্ছি যেন, কোয়ালিটি নলেজ ডেলিভারি করা হয় এবং আমাদের ছাত্ররা যেন নলেজটা অর্জন করে। আমরা যে পর্যায়ের ইউনিভার্সিটি, সে তুলনায় এমনকি অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় টিউশন ফি কম নিয়ে থাকি। আমাদের ট্রাস্টের এখানে মানি মেকিং কোনো উদ্দেশ্য নেই, আমি ম্যানেজমেন্ট ওপারেশন করতে গিয়ে আর্থিকভাবে হিমশিম খাই। আমি বলি যে, এটা থেকে বাঁচার উপায় হচ্ছে টিউশন ফি বাড়ানো। ট্রাস্টি আমাকে কাজটা করতে দিচ্ছে না। তারা বলেন, টিউশনি বাড়াতে দেওয়া যাবে না, তাদের এখানে বাণিজ্য মানসিকতা নেই। তারা এডুকেশন ডেলিভারি দিতে চায় এবং তারা স্কলারশিপ দিচ্ছে। লাস্ট ইয়ারে আমরা ১৫ কোটি টাকা স্কলারশিপ ও ওয়েবার দিয়েছি। এটা কিন্তু অনেক বড় অ্যামাউন্ট। তারপর বাংলাদেশে একটা সুন্দর কালচার শুরু হয়েছে, ক্লাব কালচার। তারা খুবই একটিভ এবং খুবই অর্গানাইজ ‘আই ফিল প্রাউড ফর দ্যাট’। এখান থেকে লিডারশিপ শেখা, কমিউনিটিকে বড় করা, কমিউনিটি মেম্বার হয়ে বেঁচে থাকা এগুলো তারা শেখবে।

আপনার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া গ্রাজুয়েটদের চাকরি পাওয়ার হার কেমন? কোনো পরিসংখ্যান আছে কি? চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বিইউবিটি ডিরেক্ট কোনো উদ্যোগ আছে কিনা?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: এর নির্দিষ্ট কোন সংখ্যা জানাতে পারছি না, তবে আমরা ডাকা কালেক্ট করে সেগুরো আনালাইসিস করছি। আমাদের এলামনাইদের কাছে শুনেছি, প্রত্যেকে অর্গানাইজেশনে কিংবা প্রতিষ্ঠানে বিউবিটি স্টুডেন্টরা কাজ করছে এবং খুব ভালো করছে। আপনি যদি হাইকোর্টে সুপ্রিম কোর্টে যান, আপনি শুনতে পাবেন আমাদের ভার্সিটির আইন বিভাগ থেকে বের হয়ে তারা কত ভালো করছে। আমাদের গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি হার অনেক বেশি। আমরা রেগুলারলি এইচ.আর প্রফেশনালদের এখানে নিয়ে আসছি এবং আমরা ছাত্রদেরকে, স্পেশালি সিনিয়র ছাত্রদেরকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছি যে, ইন্টারভিউ বোর্ডে তারা কিভাবে নিজেদের প্রেজেন্ট করবে। এ স্কিলটা আমরা শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েট হওয়ার আগেই ওদের ভেতর যুক্ত করে দেওয়ার চেষ্টা করছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের দিয়ে উপস্থাপন করানো হয়, এতে করে তাদের সাহস ও কনফিডেন্স দুটোই বাঁড়বে। সেই সঙ্গে স্পিকিং স্কিলটাও বেঁড়ে যাবে। আমাদের একটা ক্যারিয়ার গাইডেন্স অফিস আছে। জব ফেয়ারের আয়োজন করা হয়, সেখানে শিক্ষার্থী ও কোম্পানীগুলো এক প্ল্যাটফর্মে আসে। আমাদের ছাত্রদেরকে তাদের কাছে পাঠাচ্ছি না বরং কোম্পানিগুলাকে আমাদের দরজায় নিয়ে আসছি। কোম্পানিগুলো ইন্টারভিউ নিচ্ছে, সিভি দেখছে, জব অফার করছে এবং শিক্ষার্থীরা জয়েন করছেন।

‘‘আমি আগেই বলেছি, আমরা তো স্বপ্ন দিনে দেখি, ওই স্বপ্ন চিন্তা করে ঘুমাই, ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্নের পরিমান তো আমাদের অনেক বড়। বিইউবিটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। জ্ঞান আলোচনা-সমালোচনা করবে এবং এই সেন্সটাই গ্র্যাজুয়েটদের দিয়ে দিতে চাই।

উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে প্রায়শই প্রশ্ন উঠে। কম-বেশি আগেও ছিল। তবে বর্তমানে শিক্ষাজীবন শেষ করা গ্রাজুয়েটদের দক্ষতা-যোগ্যতার ঘাটতি নিয়ে অনেক কথা শোনা যায়। গ্রাজুয়েটদের কোন ঘাটতিগুলো আপনাকে বেশি ভাবায়?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আমি দেশে পড়াশোনা করেছি এবং আমি খুব ক্লোজলি অস্ট্রেলিয়ায় অধ্যয়নরত আমার মেয়েকে অবজার্ভ করছি। আমি আমার সাথে তার একটা তুলনা করি। আমাকে যেমন একটা রচনা মুখস্ত করতে হতো। আমরা এসএসসিতে বিশ পঁচিশটা রচনা মুখস্ত করেছি, আমার মেয়ে কিন্তু মুখস্ত করছে না। আমার মেয়ে শিখছে, কিভাবে একটি রচনা লিখতে হয়। আপনি কাজটা করে দিয়েন না, মেমোরাইজ করবেন না, কাজটা কিভাবে করে সেটির পদ্ধতিগত শিক্ষাটা দিয়ে দেন। তাহলে আমরা এগিয়ে যাব। এই জায়গায় আমরা পেছনে রয়েছি। পদ্ধতিগত শিক্ষা ব্যবস্থাটাকে আমাদের আনতে হবে। কেউ একটা সমস্যার সমাধান করল, কিন্তু সমস্যা সমাধানের বিকল্প কোন উপায় জানল না, এটাও শেখাতে হবে। সমস্যা যখন আসবে, সে ম্যানেজারকে সাপ্রাইজ করতে পারবে কী না, সমস্যা সমাধানে আমার প্ল্যান এ, প্ল্যান বি ও সি আছে, এগুলো বুঝাতে হবে । ইন্ডাস্ট্রি ম্যানেজাররা চায় তাদের স্টাফরা তাদের সারপ্রাইজ করুক। আমার মনে হয় এ জায়গাগুলোকে আমাদের ক্লাসরুমের সঙ্গে আরো বেশি ইন্টারেক্টিভ করা উচিত। স্টুডেন্টদের থিংকিং পাওয়ারটাকে ওপেন করে দেওয়া উচিত। এর জন্য ছাত্রদেরকে শুরু থেকেই রিসার্চ দেয়া উচিত। এটা ইউনিভার্সিটি লেভেলে এসে করলে দেরি হয়ে যাবে, এটা স্কুল পর্যায়ে করা উচিৎ। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়েও এ শব্দটাকে অ্যাডপ্ট করতে পারিনি। 

প্রেজেন্টেশন স্কিল, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের স্পিকিং ও প্রেজেন্টেশন ঘাটতি রয়েছে। আপনি প্রোডাক্ট বানিয়েছেন, কিন্তু প্রোডাটি সম্পর্কে আপনি বলতে পারছেন না। তাহলে আমার তো সন্দেহ এসে যাবে যে, আরেকজনের প্রোডাক্ট নিয়ে এসে বেঁচে দিচ্ছেন। আপনি প্রোডাক্ট বানিয়েছেন, তাহলে সেটি সম্পর্কে আপনাকে পূর্ণাঙ্গ জানতে হবে। আপনাকে স্পিকিং স্কিল পাওয়ারটা নিয়ে আসতে হবে। এ জন্য আমাদের ক্লাসরুমে একজন লেকচারারের উচিত হবে, শিক্ষার্থীদের কোন টপিক দিয়ে সেটি বুঝিয়ে দেওয়া, প্রত্যেকটা কোর্সের প্রেজেন্টেশন নেওয়া। তারা প্রজেক্ট ওয়ার্ক করবে, গ্রুপ ওয়াইজ প্রেজেন্টেশন করতে দিবে, ওখানে একজন  লিডার থাকবে, তারা স্লট ভাগ করে নেবে, কে ডেভেলপ করছে, কে রাইট আপ করছে, কে লিটারেচার রিভিউ করছে, এইভাবে এই কাজগুলোকে এগিয়ে নিতে হবে।

একবিংশ শতাব্দীর বড় প্রশ্ন ‘একাডেমিক্যালি বেস্ট পারফরম্যান্স’ নাকি ‘আউটস্ট্যান্ডিং স্কিল? আপনি কোনটিকে এগিয়ে রাখবেন?

অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আজকের যে বিশ্বে আমরা বসবাস করছি, উন্নয়নের বেশ উঁচু জায়গায় আমরা রয়েছি। দেখেন মানুষের এক পকেটে মোবাইল, আরেক হাতে কম্পিউটার, যে ঘরিটা পড়ি সেটা সাথে সাথে বলে দিচ্ছে, আপনার হার্টবিট বেড়ে গেছে ভাক্তারের কাছে যান। কি সুন্দর একটা উন্নয়নের জোয়ারে আপনি ভেসে বেড়াচ্ছেন। তাহলে এখানে একাডেমিক বেস্ট পারফরম্যান্স নয়, আপনাকে টিকে থাকতে হলে, আউট স্ট্যান্ডিং স্কিল লাগবে। আইনস্টাইন বলেন, আর স্টিফেন হকিং বলেন তারা আমাদের এভারেস্টের চূড়ায় তুলে দিয়েছে, এটা কিন্তু তাদের অবদান। হ্যাঁ... কম্পিটেন্ট টেকনোলজি বলেন, এভারেস্টের উপরে থেকে যদি আপনি সার্ভাইভ করতে চান, তাহলে তা অনেক ঝুঁকি, কি প্রচন্ড বাতাস হবে, পাহাড় নাড়া দিবে, এখানে যদি দাপটটা দেখিয়ে দিতে চান, তাহলে আপনাকে আউট স্ট্যান্ডিং স্কিল লাগবে।

‘‘আমেরিকান কোন মিডিয়া যদি তাদের গ্রাজুয়েটকে নিয়ে কথা বলে তাহলে তার নামের আগে হার্ভাড গ্র্যাজুয়েট যুক্ত করে। বিইউবিটিকে ১০ বছরের মধ্যে এমন একটা অবস্থানে নিতে চাই, যেন সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবাই বলে এটা 'বিউবিটির গ্র্যাজুয়েট'।

আগামী এক দশক পর বিইউবিটিকে কোথায় দেখতে চান?
অধ্যাপক ড. এ বি এম শওকত আলী: আমি আগেই বলেছি, আমরা তো স্বপ্ন দিনে দেখি, ওই স্বপ্ন চিন্তা করে ঘুমাই, ঘুমিয়েও স্বপ্ন দেখি। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে স্বপ্নের পরিমান তো আমাদের অনেক বড়। বিইউবিটি বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিয়ে চিন্তা ভাবনা করবে। জ্ঞান আলোচনা-সমালোচনা করবে এবং এই সেন্সটাই গ্র্যাজুয়েটদের দিয়ে দিতে চাই। এখন আপনি যদি বলেন, বিইউবিটি কি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়? আমি বলব না। বিইউবিটিকে পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় করতে গেলে আরেকটা উইং-এর মধ্যে যুক্ত করতে হবে, সেটা হলো মেডিকেল উইং। আমরা খুব দ্রুতই মেডিকেল স্কুল এন্ড পাবলিক হেল্থ খুলতে যাচ্ছি। আগামী দশ বছর পর ইনশাল্লাহ, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নার্সরা বের হবে। আমি যদি বিইউবিটিকে এ অর্জন এনে দিতে চাই। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিলাম, আমার বিশটা শ্রমিক ভাই বিদেশে গিয়ে কষ্ট করে, যে টাকা পাঠাচ্ছে, আমার একটা নার্স সেভেন আইইএলটিএস ব্যান্ড স্কোর নিয়ে দশটা ভাইয়ের থেকেও বেশি রেভিনিউ এই বাংলাদেশে পাঠাবে। আমরা এ দিকটা নিয়ে এগোচ্ছি, ইনশাল্লাহ দশ বছরে আমরা এটা অর্জন করতে চাই। 

বিশ্বের এক নাম্বার বিশ্ববিদ্যালয় হার্ভার্ড। আমেরিকান কোন মিডিয়া যদি তাদের গ্র্যাজুয়েটকে নিয়ে কথা বলে তাহলে তার নামের আগে হার্ভাড গ্র্যাজুয়েট যুক্ত করে। বিইউবিটিকে এমন একটা অবস্থানে নিয়ে যেতে চাই, দশ বছরে বিউবিটির গ্র্যাজুয়েটদের সাথে এই শব্দটি অ্যাড করে দিতে চাই। যেখানে সরকারি লেভেলে, বেসরকারি লেভেলে, প্রাইভেট অফিসের যেন মানুষ বলে এটা বিউবিটির গ্র্যাজুয়েট। আশা করছি, দশ বছরের কম সময়ে আমরা এটা অর্জন করব ইনশা আল্লাহ।