২০ জুলাই ২০২৫, ১৯:৩৩

মানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ আর দায়বোধের বহিঃপ্রকাশ জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান : সারজিস আলম

সারজিস আলম  © সংগৃহীত

বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাই মাসে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হয়, যা শেষ পর্যন্ত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার সরকারের পতনে গড়ায়। এ ঐতিহাসিক আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন কয়েকজন সাহসী ও দূরদর্শী তরুণ নেতা- তাদেরই একজন সারজিস আলম। 

পঞ্চগড়ের আটোয়ারী থেকে উঠে আসা এই তরুণ প্রথমে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের মাধ্যমে, পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে অমর একুশে হল থেকে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত রাজনীতির প্রতি হতাশ হয়ে তিনি ২০২২ সালে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেন।

২০২৪ সালে তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর অন্যতম সংগঠক হিসেবে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সক্রিয় হন, যা দ্রুত রূপ নেয় দেশব্যাপী এক গণআন্দোলনে। আন্দোলনের মধ্যমুহূর্তে গ্রেফতার, নির্যাতন এবং রাজপথের সংঘর্ষেও তিনি পিছু হটেননি। 

আন্দোলনের পর তিনি ‘জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন’-এর  সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরে ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’র প্রধান সংগঠক হিসেবে যুক্ত হন। সর্বশেষ ২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি’র (এনসিপি) উত্তরাঞ্চলীয় প্রধান সংগঠকের দায়িত্ব পান তিনি। রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের পথে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং মানবিক মূল্যবোধকে সামনে রেখে গড়ে ওঠা নতুন এই ধারার রাজনীতিতে সারজিস আলম আজ এক গুরুত্বপূর্ণ নাম।

এ প্রেক্ষাপটে বাসসকে বিশেষ সাক্ষাৎকার দেন সারজিস আলম। সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর আপনার ছাত্রজীবন কেমন ছিল? বিশেষ করে শুরুটা কেমন ছিল, আর আপনি কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমার জীবনের অন্যতম বড় সাফল্য ছিল। আমি প্রথম ঢাকায় আসি কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্য। কিন্তু আমার কলেজের কাছাকাছি যে এলাকা, ওই এলাকাতেই ছিলাম। আর ভর্তি পরীক্ষা দিতে আসার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কখনো আসা হয়নি।  যখন প্রথম আসি, প্রথম বর্ষে, মাথায় একটা জিনিসই ছিল যে হলে থাকতে হবে। কারণ আমি কয়েকজনের সাথে পরামর্শ করে হলে থাকার সুবিধা অসুবিধাগুলো জানতে পারি।  তারা বলে যে হলে থাকলে অবশ্যই ছাত্রলীগের প্রোগ্রাম, গেস্টরুম করতে হয়। কিন্তু থাকা-খাওয়া, রিডিং রুম সুবিধা বা পরিবেশ খুবই ভালো। আর গ্যাসের সমস্যা, বিদ্যুতের সমস্যা বা অন্যান্য যে সমস্যা এসব থেকে হলে একদম মুক্তি। যাই হোক ঢাকায় আমার কোনো আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত ছিল না তা না। আমার ঢাকায় আত্মীয় ছিল, কিন্তু এতটা কাছের না যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতেই তাদের বাসায় থেকে যাওয়া যেত। 

এরপর অমর একুশে হলের মতো একটি তুলনামূলক শান্ত ও নিরিবিলি হলে থাকার সুযোগ পাই। সেই হলেই আমার ছাত্রজীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় শুরু হয়। প্রথমদিকে গণরুমে থাকতে হয়েছে। চার সিটের রুমে প্রায় ৪০ জন থাকত। ঘুমাতে হতো মেঝেতে। যদিও এই অমানবিক অবস্থা তখন আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হতো। কারণ, সবাই এতে অভ্যস্ত ছিল। সকালে ক্লাস, বিকেলে টিউশনি, রাতে গণরুমে ঘুম এটাই ছিল রুটিন। কিন্তু তবুও মনে হতো, আমি একটা বড় কিছু অর্জনের পথে আছি। সেই কষ্টগুলোকে সহ্য করার শক্তি আসত ভেতরের স্বপ্ন থেকে। প্রথম বর্ষে কখনও মনে হয়নি এগুলো মানুষের ওপর চাপ বা চ্যালেঞ্জ হিসেবে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে কারণ আমার আশেপাশে হাজার শিক্ষার্থী একই রকম জীবনযাপন করছে। সিনিয়ররা জুনিয়রদের সচেতন করতে পারতেন না, কারণ ছাত্রলীগের ভয় কাজ করত। জানতে পারলে নিশ্চিত হল থেকে বের করে দেওয়া হতো। 

আপনি ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? কীভাবে যুক্ত হলেন, আর পরে কেন সরে দাঁড়ালেন?
ছাত্ররাজনীতি শুরুতে আমার কাছে একটা রোমাঞ্চকর ও গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র মনে হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেককে দেখতাম ছাত্রদের পাশে দাঁড়ানোর কথা বলছে। প্রথমে আমিও তাদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। অতিথি কক্ষে যেতাম, স্লোগান শিখতাম, নেতাদের বক্তৃতা শুনতাম। মনে হতো, ছাত্রদের জন্য কিছু করার এটিই শ্রেষ্ঠ পথ।

কিন্তু ধীরে ধীরে একটা অদ্ভুত বিভ্রান্তি তৈরি হতে থাকে। বুঝতে পারি, এখানে একটা ভয়ের সংস্কৃতি আছে। অতিথি কক্ষে (গেস্টরুমে) না গেলে ‘ভালো ছাত্র’, ‘ভবিষ্যতের নেতা’ হওয়া যায় না। অতিরিক্ত আদব-কায়দা না করলে তিরস্কার করা হয়। স্বতঃস্ফূর্ততা নেই, বরং একটা অদৃশ্য নিয়ম-কানুনের বাঁধনে সবাই আবদ্ধ। ২০১৮ এর আন্দোলনে আমার স্পষ্ট মনে আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কার্জন হল থেকে একটা মিছিল আসে। ওই মিছিলটা রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত আসে। ওখানে আমি একদম সামনে ছিলাম এবং স্লোগান দিয়েছিলাম। তখন থেকেই বিবেকের একটা তাড়না অনুভব করি। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন আমার চোখ পুরোপুরি খুলে দেয়। আমি ফেসবুকে কিছু পোস্ট করেছিলাম, যেখানে ছাত্রলীগের কিছু নেতার কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলি। এরপর আমাকে অতিথি কক্ষে ডেকে নেওয়া হয়, জেরা করা হয়, পোস্ট মুছে ফেলতে বাধ্য করা হয়। এক প্রকার হুমকির মুখেই তখন লেখালেখি বন্ধ করে দিতে হয়। আমাকে বলা হয়, ‘রাজনীতি করতে চাইলে লেখালেখি বন্ধ করতে হবে, আর লেখালেখি চালিয়ে যেতে চাইলে রাজনীতি ছেড়ে দিতে হবে’ তখন আমি দ্বিতীয়টিকে বেছে নিই। এই সিদ্ধান্তে অনেকেই অবাক হয়েছেন কারণ ছাত্রলীগ আমাকে হলের সহ সভাপতির পদ দিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আমি আমার ইচ্ছার প্রতি অনড় থেকে, রাজনীতি না করে লেখালেখি চালিয়ে যাই এবং চাকরি বা বিসিএসের পড়াশোনার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি অব্যাহত রাখি। রাজনীতির আদর্শগত স্বপ্ন আর বাস্তবের গা-জোয়ারি, তোষামোদ ও দমননীতি এই দুইয়ের মধ্যে গভীর পার্থক্য বুঝতে পারি। আমি এমন রাজনীতির অংশ হতে পারিনি, যেখানে নিজের বিবেক বিক্রি করতে হয়। নেতৃত্ব মানে যদি দম্ভ, দুর্ব্যবহার আর অন্যায়কে চুপচাপ মেনে নেওয়া হয়, তবে সে নেতৃত্ব আমার নয়। ফলে আস্তে আস্তে আমি রাজনীতি থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিই।

আপনি ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর কী পরিবর্তন আসে? আপনি কীভাবে এই দায়িত্ব পালন করেছিলেন? এবং আপনার জীবনে এর প্রভাব কেমন ছিল?
২০১৯ সালে ডাকসু নির্বাচন ছিল আমার জীবনের এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। নির্বাচনে আমি আমার হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোটে নির্বাচিত হই। অনেকেই যেখানে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়, সেখানে আমি একটি প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন করে এই স্থান অর্জন করি। এতে আমার প্রতি ছাত্রদের আস্থা প্রমাণিত হয়। আমি সর্বকনিষ্ঠ ছিলাম কিন্তু সদস্যদের মধ্যে সর্বোচ্চ আর পুরো হলে তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছিলাম। 

যাই হোক ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে মনোনীত হয়েও, আমি কাউকে ছেড়ে কথা বলিনি। ডিবেট সার্কিট, সংস্কৃতি ক্লাব থেকে শিক্ষার্থীরা মনোনয়ন পেয়েছিল। একুশে হলে ছাত্রলীগ মনোনয়ন দিয়েছিল ১৩ জনকে, কিন্তু নির্বাচিত হয়েছিল সাতজন। অন্যান্য হলে ভোটে বাধা দেওয়ার অভিযোগ থাকলেও, আমাদের হলে সেসব ঘটেনি।

আমি সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছি তৃতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে। মোটামুটি ৯০০ জন ভোটার, আমার সংগ্রহ ৬২৪ ভোট, এতে ভেবেছি, আমি শুধু একজন ছাত্র না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের প্রতিনিধি। এই জয়ের পর নিজের বিশ্বাসে অটল থাকার ক্লান্তিহীন সিদ্ধান্ত অব্যাহত রাখি এবং অনেক বেশি আত্মসমালোচক হয়ে উঠি।

কারণ, এখন আর আমি শুধু একজন শিক্ষার্থী নই, আমি দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন প্রতিনিধি। আমি চেষ্টা করতাম নিজের কাজ দিয়ে মানুষের আস্থা বজায় রাখতে। কিন্তু আবারও বাস্তবতা আমাকে হতাশ করে। নতুন হলে সভাপতি আসার পর শুরু হয় অতিথি কক্ষে জোর করে ছাত্রদের তোলা, অকারণে অশ্রাব্য ভাষায় কথা বলা, রাজনৈতিক চাটুকারিতা ইত্যাদি। আমি এসবের বিরোধিতা করি, আবার অনেক সময় চুপ থেকেও নিজেকে সরিয়ে নিই। কারণ আমি বুঝতে পারি আমার অবস্থান আর তাদের আদর্শ এক নয়। একসময় আমি আর কোন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে যেতাম না, অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলতাম। আমি যে রাজনীতির স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম, সেটা তো এখনকার দলীয় চর্চার মধ্যে নেই। নেতৃত্বে গিয়ে যদি নিজের আত্মমর্যাদাই হারাতে হয়, তবে সে নেতৃত্ব আমার দরকার নেই।

২০২৪-এর কোটা আন্দোলনে কীভাবে যুক্ত হলেন? কীভাবে সবাইকে সংগঠিত করলেন? প্রথম দিকের গল্পগুলো শুনতে চাই।  
৫ জুন বিকেলে খবর এল সরকার ১৮ নম্বর পরিপত্র বাতিল করেছে। আমি তখন সায়েন্স লাইব্রেরিতে পড়ছিলাম। মাথায় যেন বাজ পড়লো। সেদিন বিকেলেই আমার ভেতরে একটা ঝাঁকুনি কাজ করল, বুঝতে পারলাম, এটা আর শুধু একটা পরিপত্র নয়, এটা সরকারের পক্ষ থেকে একটা ঘোষণা। সরকার চাইল বলেই এটা বাতিল হলো। এই আন্দোলনটা হবে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আর সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়ালে আমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে যেতে পারে। বিসিএস পরীক্ষা ভালো দিয়েও চাকরি না পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, ভেরিফিকেশনে বাদ পড়ে যেতে পারি।

তবু সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিই যা হয় হোক, আমি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হব। আমার বিসিএস না হলে না হবে। অন্তত আমি প্রিলি-রিটেন-ভাইভা পর্যন্ত দিয়ে দেখিয়ে দেব আমাকে বাদ দিলে সেটা হবে অন্যায়। আমার তখনকার মানসিকতা ছিল যদি কিছু না হয়, তাহলে দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করব, চাকরি করব, কিন্তু এই অনৈতিকতার একটা বিহিত আমি দেখে ছাড়ব।

সেদিন রাতেই, ৫ জুন রাত ১১টার দিকে বাকেরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। সে জানতো যে আমি সায়েন্স লাইব্রেরির অ্যাডমিন প্যানেলের একজন এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করি। এর আগে আমরা মোকাররম ভবনের পাশে ক্যাফেটেরিয়ার দাবিতে একটা ছোট আন্দোলন করছিলাম। সেখানে খাবারের দোকানগুলো উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কোনো বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়াই। শিক্ষকদের জন্য তো ক্যাফেটেরিয়া আছে, কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ ছাত্ররা সেখানে ২০০ টাকা দিয়ে খেতে পারি না। এই সূত্র ধরেই বাকের আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বাকের আমাকে বলেন, ৬ জুন সকালে আমরা সোশ্যাল সায়েন্সের সামনে বসব। আমি শোয়েব ভাইসহ আরও দুইজন বন্ধুকে নিয়ে যাই সেখানে। বাইক থেকে নেমে হেঁটে যেতে যেতে মনে পড়ে, আমার বন্ধু হাসনাতকে ডাকি সে ভালো অ্যাকটিভিস্ট, ফেসবুকে ভালো রিচ আছে। ভাবলাম, তাকে যুক্ত করতে পারলে আন্দোলনের প্রভাব বাড়বে। আমি তখনো জানতাম না, বাকের-নাহিদরা আগেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করেছে।

সেখানে দেখি নাহিদ, আসিফ, কাদের, মাহিন, রিফাত, হান্নান, আবু সাঈদ ভাইসহ অনেকেই ছিলেন। তবে বাকের ছাড়া কাউকে আমি চিনতাম না। পরে ভিডিওতে দেখি তারা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও সক্রিয় ছিল। আমি চিনতাম কোটা সংস্কার আন্দোলনের নূর ভাই, রাশেদ ভাই, ফারুক ভাই, আখতার ভাই, হাসান আল মামুন ভাই এসব মানুষদের।

৬ জুন শহীদ মিনারে আমরা প্রথম মিছিল করি। সায়েন্স লাইব্রেরি ও সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে আলাদা আলাদা মিছিল গিয়ে শহীদ মিনারে একত্র হই। সেখানে নাহিদ উপস্থাপনা করে, আমিও বক্তৃতা দিই। তারপর রাতে বটতলায় আলোচনা হয়। শুক্র ও শনিবার তো ক্যাম্পাস ফাঁকা থাকবে, তাই কর্মসূচি রোববার (৯ জুন) করা হবে। এরপর ধীরে ধীরে আন্দোলনটা গুছিয়ে আনা শুরু হয়। আমি নিজেও তখন পঞ্চগড় থেকে একটা ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে দিই। কেন কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন যৌক্তিক, কেন এটা প্রয়োজন। এইভাবে ধীরে ধীরে আমরা সবাই আমাদের জায়গা থেকে কথা বলতে থাকি, যোগাযোগ করি, তাদের কেউ প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে, কেউ ঢাবি হলে, কেউ বাইরে থেকে। শেষ পর্যন্ত, আমরা ১ জুলাই সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে মিছিল শুরু করি, রাজু ভাস্কর্য পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে আন্দোলনের মূল পথচলা শুরু হয়। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নামটি কখন ও কীভাবে আসে? আন্দোলনের একতা গঠনের জন্য এই নামের গুরুত্ব কী ছিল?
আমরা চেয়েছিলাম আমাদেরকে একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক। এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন। সেই জায়গা থেকে আমরা নাম দিলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। প্রথমে বিভিন্ন ভার্সিটির নামসহ ব্যানার আসছিল, যেমন ‘বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। পরে একরকমভাবে শুধুই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে সবাই আসতে শুরু করল। এতে আন্দোলনের একতা তৈরি হলো, বিভাজন কমে গেল। আমার মনে আছে, আমরা অন্তত ২০টা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যোগাযোগ করেছিলাম পাবলিক, প্রাইভেট মিলিয়ে। এগুলো করতাম আমরা নিজেরা, আমাদের দলের অন্যান্যরা।

হলকেন্দ্রিক ছাত্রদের সংগঠিত হওয়া এবং গ্রুপভিত্তিক আন্দোলনের কৌশল কীভাবে তৈরি হলো?
আগে কী হতো, জানেন? কোনো শিক্ষার্থী যদি হলে থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে চাইতো, তাকে গেটেই দাঁড় করিয়ে দেওয়া হতো। ছাত্রলীগের ছেলেরা গেটেই থাকতো, বের হতে চাইলে তাকে জেরা করত, ভয় দেখাত, কিছু ক্ষেত্রে শারীরিকভাবে বাধা দিত। আবার কেউ একা হলে ঢুকতে গেলেও তাকে আটকে দেওয়া হতো। পুরো বিষয়টাই ছিল আতঙ্ক তৈরি করা, যাতে কেউ ব্যক্তিগতভাবে আন্দোলনে যোগ দিতে না পারে।

কিন্তু এবার (২০২৪ সালের আন্দোলনে) আমি দেখলাম, পুরো ব্যাপারটাই বদলে গেছে। শিক্ষার্থীরা এবার আলাদা কৌশল নিয়েছে। তারা একা একা বের না হয়ে, একসাথে বের হয়েছে। এক হলে ঢুকে, সেখান থেকে ৫-৬ জনকে ডেকে নিয়ে সবাই একসাথে বের হয়ে আসছে। আবার হলে ঢোকার সময়ও সবাই একসাথে ঢুকছে।

এই স্ট্র্যাটেজিটা আসলে একদিনে তৈরি হয়নি। এটা স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে মাঠের অভিজ্ঞতা থেকে। আমরা দেখেছি, যখন কেউ একা থাকে, তখন ভয় কাজ করে। রুমে বসে মানুষ ভাবে, ‘আমি যাব, যাব।’ কিন্তু বাইরে কাউকে দেখতে না পেলে সে আর বের হয় না। কিন্তু যখন কেউ দেখে, ৫-৬ জন একসাথে রুমে এসে ডাকছে ‘চল, নিচে নাম’ তখন একটা মানসিক জোর তৈরি হয়। তখন সে আর একা না, তখন সে একটা দল।

এই পুরো প্রক্রিয়াটা সাইকোলজিক্যাল ব্যারিয়ার ভাঙার একটা কার্যকর পদ্ধতি ছিল। আমি যেহেতু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, সব হলে কী কী ঘটেছে তাতে আমার একটা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। আমি ২০২১ সালের শিক্ষার্থী, তাই সেই সময়কার হলের সিনারিও আমার খুব পরিষ্কার।

আমার হলে কী হতো? কয়েকজন সিনিয়র ভাই ছিলেন তারা সবাই বিসিএসের পড়ায় ব্যস্ত, কিন্তু তারা ছাত্রলীগেরও গুরুত্বপূর্ণ পোস্টে ছিলেন। কেউ ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি, কেউ সাংগঠনিক সম্পাদক। এসব পোস্ট ছাত্রলীগে খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এগুলো অল্প কয়েকজনই পায়। আমার রুমমেট শুভ, আন্দোলনের সময় খুব সক্রিয় ছিল, ওর নাম ছাত্রলীগের জয়েন্ট সেক্রেটারির তালিকায় তিন বা চার নম্বরে ছিল। কৌশিক নামে আরেকজন ছিল, সে দুই নম্বরে ছিল। এই ছেলেরা আন্দোলনের সময় পক্ষ নিয়েছিল শিক্ষার্থীদের। ছাত্ররা কী করত? নিজেদের মতো একটা গ্রুপ ছিল। তারা লনে নামতো, তারপর ডাইনিং থেকে ডাকতো, রিডিং রুম থেকেও ডাকতো। তারপর লনে কিছুক্ষণ স্লোগান দিত। এটা এক ধরনের বার্তা ছিল ‘নামো, সময় হয়ে গেছে।’ সেই স্লোগান শুনে বাকি শিক্ষার্থীরাও নেমে আসতো। পুরো হল জেগে উঠতো।

এইভাবে একটা সময় তৈরি হলো। প্রত্যেকটা হলই যেন নিজে নিজে দায়িত্ব নিয়ে আন্দোলনে নামছে। ব্যানার এলো ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। কিন্তু এই দায়িত্বটা আমরা কেউ গিয়ে দিয়ে আসিনি। এই দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা নিজ থেকেই নিয়েছে। এর মধ্যে একটা নিজস্ব অনুভব কাজ করছিল ‘আমরাই যদি না নামি, তাহলে কে নামবে?’ একটা মানসিক জাগরণ তৈরি হয়েছিল। হলগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে দায়িত্ব নিয়েছিল।

আমরা যাদের চিনি, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতাম। যেমন, ছেলেদের হলগুলোতে আমরা জানতাম কে কে আছে। তাদের বলতাম ‘তোমরা কখন আসতেছো, রেডি হচ্ছো কি না?’ এভাবেই ১৮টা হল থেকে একেকটা করে মিছিল নামতে লাগলো। যদি প্রতিটা হলে ১০০ জন করেও নামে, তাহলে তো ১৮০০ মানুষ! আর এই মানুষগুলো যখন একসাথে শাহবাগে দাঁড়ায়, তখন তার প্রভাব হয় বিশাল।

তখন গণমাধ্যম বলে ‘পাঁচ হাজার মানুষ শাহবাগে।’ কেউ বলত ‘১০ হাজার।’ আমরা জানি, সেটা হয়তো ১৫শ কিংবা দু’হাজার, কিন্তু তারা একসাথে ছিল বলেই সেটা দেখায় বিশাল। মানুয়ের সংখ্যার চেয়ে অনেক বড় হয়ে দাঁড়ায় তাদের ঐক্য। এই পদ্ধতিটা আমাদের আন্দোলনকে শুধু বাঁচিয়ে রাখেনি, এটা আতঙ্কের অবসান ঘটিয়েছে। কারণ একা মানুষ ভয় পায়, কিন্তু দলবদ্ধ মানুষ সাহস পায়। আমাদের আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায় মানে ১৪ জুলাই পর্যন্ত এই কৌশলটা আমাদের সবচেয়ে কার্যকর শক্তিগুলোর একটি ছিল।

আপনাদের আন্দোলনের কৌশল কী ছিল? কীভাবে নেতৃত্বের সমন্বয় ও সংগঠন চালানো হয়েছিল? 
আমাদের স্ট্র্যাটেজি ছিল মূলত আমরা তিনজন নাহিদ, আমি আর হাসনাত, সিনিয়র সমন্বয়কের যে প্রথম তালিকাটা বের হয়েছিল, সেখানে নাহিদ ছিল এক নম্বরে, তারপর আমি, তারপর হাসনাত। আমরা তিনজন মিলে একটা কোর টিম তৈরি করেছিলাম। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, যে কোনো ঘোষণা বা প্রেস ব্রিফিংয়ে আমরা তিনজন একসাথে উপস্থিত থাকবো। এছাড়াও, বাকের, রিফাত রশিদ, হান্নান মাসুদ, মাহিন, কাদের এরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিল।

শাহবাগ মঞ্চে তিনজনই একসঙ্গে কথা বলতাম। একটা সময় আমি খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, মঞ্চে যেতে চাইছিলাম না। তখন পিজি হাসপাতালের পাশের বটগাছটার নিচে বসেছিলাম। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নাহিদ আমাকে ওখান থেকে ডেকে নিয়ে আসে। বলল, ‘মঞ্চে না থাকলে অনেকে ধরে নেবে তুমি সরে গেছো’। কারণ আমি তো ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা, এটার কারণে যদি মঞ্চে আমি না থাকি, সেটাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে। কিন্তু আমি থাকা মানেই একটা ম্যাসেজ এই, আন্দোলনের ভেতরে ছাত্রলীগের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকেও কেউ আছে, এবং এটা একটা শক্তি। এই মঞ্চটা সরকারবিরোধী ট্যাগ পায়নি, তার একটা কারণ আমি ছিলাম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই আন্দোলনটা সাহস পেয়েছিল কারণ হলে ছাত্রলীগ করে আসা একটা পরিচিত মুখ মঞ্চে ছিল, যার মাধ্যমে অন্য ছাত্ররাও অনুপ্রাণিত হয়েছে। একধরনের সুরক্ষা বা প্রোটেকশনের অনুভূতিও কাজ করেছিল যদি কিছু হয়, আমাদের মতো কেউ পাশে থাকবে।

আমরা চেয়েছিলাম আমাদের একক নেতা হিসেবে না দেখা হোক। বরং একটা সমন্বয় কাঠামো থাকুক। একই ব্যানারে, একই কর্মসূচিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় যুক্ত হোক, এটাই ছিল দ্বিতীয় স্ট্র্যাটেজি। কারণ আলাদা আলাদা ব্যানারে থাকলে, আলাদা আলাদা নেতাদের প্রভাবিত করে বা দমন করা সহজ। একক প্ল্যাটফর্ম হলে সেটা কঠিন।

আমরা এই কাঠামোয় সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়ক নামে দুই লেয়ারের নেতৃত্ব তৈরি করি। একজনকে যদি গুম, গ্রেফতার বা টার্গেট করা হয়, অন্য লেয়ার দায়িত্ব নিতে পারবে। এটাই ঘটেছিল যখন আমরা ডিবি অফিসে ছিলাম, এক লেয়ার চলে গেল, আরেকটা দাঁড়িয়ে গেল। 

১৪ জুলাই বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল? ওইদিন রাতে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বক্তব্য আন্দোলনকারীদের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল?
যখন আমরা বঙ্গভবনে স্মারকলিপি দিতে যাই, তখন একটা আশা ছিল যে রাষ্ট্রপতি হয়তো নিজে স্মারকলিপি গ্রহণ করবেন। কিন্তু উনি নিজে না এসে সামরিক সচিবের মাধ্যমে স্মারকলিপি গ্রহণ করালেন। ওখানে আমাদের বসার জায়গাটাও তেমন ছিল না, আমরা ভেবেছিলাম হয়তো ভেতরে বসানো হবে। তো প্রত্যাশার তুলনায় কিছুটা হতাশই হয়েছি।

এরপর আমাদের প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনা চীন থেকে ফিরে এসে আন্দোলন নিয়ে ইতিবাচক কিছু বলবেন, হয়তো বলবেন ১৮-এর পরিপত্র পুনর্বহাল হচ্ছে। কিন্তু উনি যে টোনে বক্তব্য দিলেন, সেটা ছিল অত্যন্ত প্রতিহিংসাপরায়ণ। ‘মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনীরা পাবে না, রাজাকারের নাতি-নাতনীরা পাবে?’ এইভাবে বলার প্রয়োজন ছিল না।

বক্তব্যের শব্দ যেমন বিষাক্ত ছিল, টোনটা ছিল আরও খারাপ। আমি তখন একুশে হলে নিজের রুমে ছিলাম। শুনেই একটা শক খাওয়ার মতো অবস্থা হলো। এরপর থেকেই হলে হলে ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ স্লোগান ওঠা শুরু হলো।

সেদিন রাতে একুশে হল থেকে মিছিল কীভাবে গড়ে উঠল এবং আন্দোলন কীভাবে ‘গিয়ার আপ’ হলো?
আমি রুম থেকে বেরিয়ে দেখি ১০-১৫ জন দাঁড়িয়ে আছে বাইরে।  আমরা নিচে নেমে এসেছি লনে। সেখানে দাঁড়িয়ে স্লোগান শুরু করলাম ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’। রিডিং রুম, ডাইনিং সব জায়গা থেকে লোকজন নামতে থাকলো। পাঁচ মিনিটের মধ্যে কয়েকশো হয়ে গেলাম। এরপর গেটে গিয়ে আরও স্লোগান দিলাম, আর লোক বাড়তে থাকলো। আমি নিজে তখন সমন্বয়কের দায়িত্বে, সবাই জিজ্ঞেস করছিল কোন রুটে যাবে মিছিল। আমি সিদ্ধান্ত নিই শহীদুল্লাহ হল হয়ে যাব।

ওখানে গিয়ে কিছু ছাত্র যুক্ত হলো। এফএইচ হল, কার্জন হল সেখান থেকেও লোকজন বাড়তে থাকলো। এরপর বিশাল মিছিল হয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে বেরিয়ে এলাম।

হাসনাতকেও ফোন দিয়ে ডাকি। সেও যোগ দেয়। আমরা তখন রাজু ভাস্কর্যের দিকে এগোই। দেখি মেয়েদের হল থেকেও মিছিল বের হয়েছে। এরপর আমরা ভিসি চত্বর পর্যন্ত যাই, আবার ফিরে এসে মেয়েদের হলগুলোর সামনে আসি, মেয়েরা বসে পড়ে, ছেলেরা দাঁড়িয়ে যায় চারপাশে। তখন থেকেই আন্দোলন নতুন গতি পায়।

রাত একটা বাজে, ছাত্রলীগ তখন ইন্টারকন্টিনেন্টালে মিটিং করছে।  আমরা চিন্তিত হই, ওরা যদি ঢোকে তাহলে মেয়েদের নিরাপত্তা থাকবে না। আমি, হাসনাত, উমামা, নুসরাত মিলেমিশে সিদ্ধান্ত নিই মেয়েদের হলে ফেরত পাঠাতে হবে। আমি নিজে সুফিয়া কামাল হল পর্যন্ত দিয়ে আসি।

ছাত্রলীগ তখনো ঢুকতে পারেনি, আমরা ক্যাম্পাসে ছিলাম বলেই। পরে যখন ওরা ঢোকে, তখন আমরা হালকা মজা করে বলি বাংলা সিনেমার পুলিশের মতো, আমরা চলে যাওয়ার পর আসে!

১৫ জুলাই বিকেলে একাত্তর হলে ছাত্রলীগের হামলা এবং ১৬ তারিখের সংঘর্ষ নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
 ১৫ তারিখ দুপুরে আমাদের ঘোষণা ছিল ভিসি চত্বর হয়ে শহীদ মিনারে বিক্ষোভ মিছিল করবো। কিন্তু খবর আসে একাত্তর হল ও সূর্য সেন হল থেকে ছাত্রদের বের হতে দিচ্ছে না। বাকের মাইক থেকে ঘোষণা দেয়, কয়েকশো জনের মিছিল একাত্তর হলে যায়, সেখানে হামলা হয়, রক্তাক্ত হয় অনেকে।

আমরা ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম মেয়েদের নিয়ে, উদ্দেশ্য ছিল মেয়েদের নিরাপদ রাখা। ছেলেরা গিয়েছিল পাল্টা ধাওয়া দিতে। পরে, এফবিএসের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগ আমাদের ওপর ইট ছোড়ে, মেয়েরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, অনেকেই আহত হয়। আমি মেয়েদের নিয়ে ভিসি চত্বর হয়ে এসএম হল পর্যন্ত যাই।

কেউ ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়নি, কারণ আহতরা সেখানে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ সেখানেও হামলা করে, গুলি, ককটেল ছোড়ে। ঐদিন হাসনাত ছিল টার্গেট, ও ভিসির অফিস সংলগ্ন জায়গা থেকে বের হতেই ছাত্রলীগের লোকজন ওর পায়ের ওপর পিটায়, পা একেবারে কালো হয়ে যায়। আমি গাড়ি নিয়ে ওকে ইবনে সিনায় নিই, ওখানে চিকিৎসা হয়। তারা একুশে হলে আমার রুমেও আসে । আমাদের রুমের সামনে ছাত্ররা পাহারা দেয়। কারণ আমরা তখন মূল নেতৃত্বে ছিলাম। পরে একুশে হল থেকেও অনেকে শহীদুল্লাহ হলে যায়। কার্জন এলাকার তিনটি হল তখন চূড়ান্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ছাত্রলীগ পুরো ব্যাকফুটে চলে যায়।

১৬ তারিখ শহীদ মিনারে গিয়ে বোঝা যায়- অনেকে সেফ জোনে চলে গেছে, হল ছেড়ে চলে গেছে, মেয়েদের উপস্থিতিও অনেক কমে যায়। তবু ওই দিন শহীদ মিনারের অবস্থান কর্মসূচিতে দুই-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণ ছিল অন্য পাশের তিন হলের ছাত্রদের-ওরাই তখন আন্দোলনের ধারক। 

১৬ জুলাই একদিকে ছাত্রলীগের টিএসসিতে অস্ত্রসহ অবস্থান ও আগের দিনের সংঘর্ষের অভিজ্ঞতা, অন্যদিকে আন্দোলনকারীদের বড় অংশের রাজু ভাস্কর্যের দিকে যেতে চাওয়ার চাপ, এই পরিস্থিতিতে কী ধরনের সংকটের মুখে পড়েছিলেন এবং কীভাবে আন্দোলনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন? 
ওই দিনের পরিস্থিতি ছিল খুবই জটিল। ছাত্রলীগ অবস্থান নিয়েছিল রাজু ভাস্কর্যে, এবং আমাদের কাছে নির্ভরযোগ্য সূত্রে খবর আসে যে তাদের কাছে অস্ত্র আছে। এই তথ্য আসে পুলিশের ভেতরের আমাদের কিছু ভাই, ইন্টেলিজেন্স এবং আমাদের নিজেদের ছেলেদের সোর্স থেকে। তারা বলছিল, রাজু কেন্দ্রিক ছাত্রলীগ ব্যারিকেড দিয়েছে এবং সেখানে সংঘর্ষের আশঙ্কা প্রবল।

শহীদ মিনারে আমাদের কর্মসূচি ছিল বক্তব্য ও বিক্ষোভের মাধ্যমে শেষ করার। কিন্তু মাঠে যারা এসেছিল তারা চাচ্ছিল রাজু ভাস্কর্য দিয়ে বিক্ষোভ মিছিল দিতে। আমি, হাসনাত, নাহিদ আমরা কয়েকজন আলোচনা করি। নাহিদরা সিদ্ধান্ত নেয় যে সংঘর্ষ এড়াতে রাজু দিয়ে যাওয়া হবে না, পলাশী ঘুরে শহীদ মিনারে গিয়ে কর্মসূচি শেষ করা হবে। ওরা চলে যায়, আমি আর হাসনাত থেকে যাই, কারণ আমরা দেখতে পাই, উপস্থিত জনতা সেটা মানছে না, তারা রাজুর দিকেই যেতে চায়।

আমি বুঝতে পারি, আগের দিনের সংঘর্ষে আমাদের অনেক সাপোর্ট নষ্ট হয়েছে। যারা ছিল, তারা হয় আহত হয়েছে বা ভয় পেয়েছে। বিশেষ করে নারীদের অংশগ্রহণে প্রায় ধস নেমে গেছে, যারা আমাদের জন্য একধরনের প্রতিরক্ষা বলয় ছিল। আমি জানতাম, ওইদিন যদি আরেকটা সংঘর্ষ হয়, তাহলে আমরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। তাছাড়া খবর ছিল, ছাত্রলীগের কিছু সদস্য অস্ত্রসহ অবস্থান করছে। যদি ওরা গুলি চালায়, চার-পাঁচজন স্পট ডেথ হয়, তাহলে আন্দোলন হয়তো শেষ হয়ে যাবে। আমার মাথায় তখন কৌশল আসে, সেটা হলো আমি আজকের প্রোগ্রামটা শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করব, যাতে আগামীকাল আবার শক্তি নিয়ে নামা যায়।

এই চিন্তা থেকে সিদ্ধান্ত হয়, আমরা দোয়েল চত্বর হয়ে কার্জনের সামনে গিয়ে প্রোগ্রাম শেষ করব। কিন্তু দোয়েল চত্বরে গিয়ে দেখি, কেউ সরছে না। তখন বলি, আমাদের আগে সরতে হবে, তাহলেই মিছিল সরবে। আমি কার্জনের গেট দিয়ে এফএইচ হলের পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জিওলজি ডিপার্টমেন্ট পর্যন্ত যাই। 

এ সময় হাসনাত বারবার ফোন দিচ্ছিল, বলে, ‘তুমি কই? ক্রাউডকে থামানো যাচ্ছে না, সবাই রাজু যাবে।’ আমি তখনো বলি, না, রাজুতে যাওয়া যাবে না। কারণ আমি স্পষ্ট বুঝেছি যদি সংঘর্ষ হয়, তাহলে আন্দোলন শেষ হয়ে যেতে পারে। একটা বড় অংশকে আগের দিনেই হারিয়ে ফেলেছি। আজ আরেকটা সংঘর্ষ হলে হয় আরও রক্তপাত হবে, নয়তো আন্দোলনের গতি থেমে যাবে। আমি তখন চাইনি, রাতের শাপলা চত্বরের মতো আরেকটা ম্যাসাকার হোক।

তখন আমি হাসনাতকে বলি, আমি কার্জনের দিকে গেলাম। পরে দেখি, মিছিল আর কার্জনে নেই। ওরা কার্জন হয়ে ঢাকা মেডিকেল ঘুরে শহীদ মিনারে গেছে। আমি ফোন দিই, হাসনাত বলে, ‘আমি মিছিল নিয়ে শহীদ মিনার পর্যন্ত চলে এসেছি।’ তখন মিছিল অনেক বড়। আবারো অনেকে রাজু ভাস্কর্যের দিকেই যেতে চাচ্ছে। কিন্তু রাসেল টাওয়ারে পুলিশের ব্যারিকেড ছিল।

আমার মাথায় তখন দুইটা লক্ষ্য, সংঘর্ষ যেন না হয়, আর আন্দোলন যেন সফলভাবে শেষ করা যায়। নিজেদের মধ্যেও যাতে বিভাজন না হয়। তাই আমি মিছিলটাকে ফুলার রোড দিয়ে জগন্নাথ হলের পাশের রাস্তা ধরে ভিসি চত্বরে নিয়ে যাই, সেখানেই প্রোগ্রাম শেষ করি।

অনেকে এই সিদ্ধান্তকে বিতর্কিতভাবে দেখে, বলে আমি ছাত্রলীগের মুখোমুখি হতে দিইনি। কিন্তু আমি জানি, একজন নেতার জায়গা থেকে শুধু আগ্রাসী হলেই হয় না ঠাণ্ডা মাথায়, কৌশল নিয়ে, বিচক্ষণতার সঙ্গে ভাবতে হয়। যারা আমার পাশে ছিল, তারা আগ্রাসী হতে পারে, কিন্তু আমার দায়িত্ব ছিল আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখা। ওইদিন আমি সেই দায়িত্বটা পালনের চেষ্টা করেছি।

১৪, ১৫ ও ১৬ জুলাই দিনে এবং রাতে যে কর্মসূচিগুলো ছিল, বিশেষ করে ১৬ জুলাই রাতের পরিস্থিতি কেমন ছিল? ছাত্রলীগের অবস্থান এবং ক্যাম্পাসের পরিবেশ কী রকম পরিবর্তিত হয়েছিল?
ওই তিন দিনে প্রতি দিন দুটো করে কর্মসূচি চলে। দিনে একটা, রাতে একটা। ১৬ জুলাই রাতে বিশেষ করে ক্যাম্পাসের সব হলেই এক ধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয় ছাত্রলীগকে ঘিরে। ওই পাশের ছাত্ররাও এই আতঙ্ক থেকে অনুপ্রাণিত হয়। আমরা লক্ষ্য করি, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তখন হলগুলোয় বেশি ঢুকে পড়েনি, কারও কাছে কিছু তথ্য গিয়েছে যে ছাত্রলীগের ওপর আক্রমণ হতে পারে। রাতেই সব হল খালি হয়ে যায়, ছাত্রলীগ চলে যায়। সকালেই ক্যাম্পাস পুলিশ-বিদ্রোহী বাহিনী পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেয়। ১৫ ও ১৬ জুলাই রাত এবং ১৭ জুলাই দিন এই সময়কে আন্দোলনের এক সংকটপূর্ণ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় বলা যায়। সেই রাত থেকেই হলগুলোয় ছাত্রলীগকে বের করে দেওয়ার প্রতিযোগিতা শুরু হয়। রোকেয়া হলে আতিকা নামের এক ছাত্রলীগ কর্মীকে বের করা হয়, যা অন্য হলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। মেয়েরাও এই প্রতিবাদের অংশীদার হয়, কারণ যেভাবে তারা অত্যাচারিত হচ্ছিল, তা সহ্য করার মতো ছিল না। এই প্রতিবাদ একসাথে সারা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ে, তাই কোন হল আগে বা পরে এমন তুলনা করা কঠিন।

১৭ জুলাই সকালবেলায় সিন্ডিকেট সভার সময় ক্যাম্পাস বন্ধ করার ঘোষণা কীভাবে জানা গেল এবং এই ঘোষণার বিরুদ্ধে আপনারা কী ধরনের প্রস্তুতি ও প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন?
১৭ জুলাই সকালে আমাদের কাছে খবর আসে যে ওইদিন সিন্ডিকেটের একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং হবে এবং সেই মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ার। একই সঙ্গে সবাইকে হল থেকে বের করে দেওয়া হবে। এই খবর পেয়ে আমি একটি ভিডিও বানাই এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিই, বলি আমরা হল ছাড়বো না। একুশে হল থেকে প্রায় ২৫০-৩০০ ছাত্র মিছিল নিয়ে শহীদুল্লাহ হলের সামনে জড়ো হই। নাহিদ এবং অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে সিনেট ভবনের মুখে পদযাত্রার পরিকল্পনা করি। আমরা একুশে হল থেকে বের হয়ে শহীদুল্লাহ হলে আসি, অন্য হলের ছাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। মেট্রোর নিচ দিয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাশে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু বিজিবি ও পুলিশ বাধা দেয়। বাধা পার হওয়ার সময় ককটেল বোমা, সাউন্ড গ্রেনেড এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করা হয়। আমরা ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ি, পরে আবার রোকেয়া হলের কাছে একত্রিত হই। যদিও তারা ভয়ে আমাদের দমাতে চেয়েছিল, আমাদের সাহস আরও বেড়ে যায়। এরপর আমরা ভিসির চত্বরে বসে ধৈর্য ধারণ করি, যেখানে মূলত একুশে হলের ছাত্ররা ছিল, কিছু ছিল শহীদুল্লাহ ও এফএইচ হলের। 

১৭ জুলাই বিকেলে গায়েবানা জানাজার সময়