১০ জুলাই ২০২৫, ১৫:৩৯

‘একটা রেজাল্ট তোমার পরিচয় না, তোমার গল্পটা তুমি নিজেই লিখবে’

লামিয়া ইসলাম আনজুম  © টিডিসি

জিপিএ-৫ না পেয়ে শুরু হয়েছিল সংশয়, আজ তিনি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও যুক্তরাষ্ট্রে গবেষণা করছেন। যেখানে অনেকে একটি পরীক্ষার ফলেই নিজেকে মূল্যায়ন করে ফেলেন, সেখানে লামিয়া ইসলাম আনজুম প্রমাণ করেছেন—জীবনের শুরুটা কোথা থেকে হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হলো, তুমি কোথায় থামছ না।

স্কুলজীবনে কাঙ্ক্ষিত জিপিএ না পাওয়া, আশপাশের মানুষের প্রশ্নবাণ, বিষণ্নতা—সবকিছুর মধ্যেই তিনি হার না মেনে এগিয়ে গেছেন। সায়েন্স থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে বদল, নতুন বিষয়ের সঙ্গে লড়াই, বিশ্ববিদ্যালয়ে অসাধারণ অ্যাকাডেমিক রেজাল্ট, গবেষণার প্রতি গভীর ভালোবাসা—সবকিছু মিলিয়ে আজ তিনি এক সফল নারীর প্রতিচ্ছবি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক থেকে শুরু করে বেলজিয়ামে মাস্টার্স ও এখন যুক্তরাষ্ট্রে ফুল-ফান্ডেড পিএইচডি—এই পথচলায় রয়েছে অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস আর নিজের ওপর অটুট বিশ্বাস। চলুন, শুনে নিই তার গল্প, তার মুখেই—

এসএসসি পরীক্ষায় আপনার ফলাফল কেমন হয়েছিল? তখন কী অনুভব করেছিলেন?
এসএসসিতে আমার জিপিএ-৪.৬৩ ছিল, জিপিএ-৫ পাইনি। সবাই যখন জিপিএ-৫ নিচ্ছে, তখন একটু খারাপ লেগেছিল। মনে হচ্ছিল, হয়তো আমি কিছুটা পিছিয়ে যাচ্ছি। একরকম অস্বস্তি কাজ করত। কিন্তু সেদিন বুঝিনি, এই রেজাল্টটাই হয়তো আমাকে একদিন আরও বড় কিছুর জন্য তৈরি করবে। সময়ের সঙ্গে বুঝেছি, একটা ফলের চেয়ে অনেক বড় জিনিস হলো, মানুষ হিসেবে তুমি কতটা পরিশ্রমী, কতটা থেমে না যাওয়ার মানসিকতা রাখো।

জিপিএ-৫ না পাওয়া ইস্যুতে কী ধরনের মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া পেয়েছিলেন চারপাশ থেকে?
সেই সময় আশপাশের অনেকে বলত, ‘একটু আর চেষ্টা করলে হতো’, ‘কেন জিপিএ-৫ পেলে না?’ আবার কেউ কেউ মুখে না বললেও চোখেমুখে বুঝিয়ে দিত। এমন কথাগুলো একটু ভেঙে দিত। কিন্তু আমি জানতাম, শুধু রেজাল্ট দিয়ে সব কিছু মাপা যায় না।
আমি নিজেকে বোঝাতাম—যদি আমি মানসিকভাবে নিজে শক্ত থাকি, তাহলে মানুষের কথায় খুব একটা ধাক্কা লাগবে না। এই মাইন্ডসেটটাই আমাকে টিকিয়ে রেখেছে।

তখনকার সেই হতাশা বা চাপ আপনি কীভাবে মোকাবিলা করেছিলেন?
আমি আমার নিজের ওপর ফোকাস করেছিলাম। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পেয়ে কিছুটা আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনি। কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমার সবচেয়ে বড় চাপ ছিল আমি সায়েন্স থেকে পলিটিক্যাল সায়েন্সে চলে যাওয়া, পুরো বিষয়টাই ছিল নতুন। তারপরও চেষ্টা করেছি, পড়েছি, শেখার আগ্রহ রেখেছি। একসময় সে ভয়ের জায়গাটাকেই ভালোবেসে ফেলেছি। নতুন জায়গায় গেলে একটু অস্বস্তি লাগবেই, কিন্তু শেখার আগ্রহ থাকলে সময়ের সঙ্গে সেটাই তোমার নিজের জায়গা হয়ে যায়।

আপনার জীবনে কীভাবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন এলো? দেশের বাইরে পড়ার সুযোগ কীভাবে পেলেন?
এসএসসি এবং এইচএসসির পর আমার পড়াশোনার জার্নিটা নতুনভাবে শুরু হয়। ইউনিভার্সিটিতে আমি অনার্সে জিপিএ ৩.৮২ আর মাস্টার্সে জিপিএ ৩.৮১ পেয়েছিলাম। এ ভালো ফল আর আগ্রহ থেকেই আমি গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে মাত্র ৩-৪ মাসের মধ্যেই জগন্নাথ ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগ দিই। এরপর গবেষণার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করি এবং একসময় আন্তর্জাতিক পর্যায়ের স্কলারশিপ পাই।

তারপর বেলজিয়ামে মাস্টার্স করি এবং এখন আমেরিকায় ফুল ফান্ডেড স্কলারশিপে পিএইচডি করছি। একটা জিপিএ খারাপ হলেও তুমি যদি নিজের জায়গায় ভালো করো, তবে পরিবর্তন আসতেই পারে, সেটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আরও পড়ুন: পাসের হার-জিপিএ ৫ কম কেন— উত্তরে যা বললেন চেয়ারম্যান

আপনি যেসব যোগ্যতা বা দক্ষতা তৈরি করেছিলেন, যা আপনাকে স্কলারশিপ বা সুযোগ পেতে সাহায্য করেছে—সেগুলো কী কী?
আমার মনে হয় সবচেয়ে বড় জিনিস ছিল অভ্যাস আর আগ্রহ। আমি নিয়মিত পড়তাম, রিসার্চ পেপার লিখতাম, বাস্তব ইস্যু নিয়ে ভাবতাম। আমার ফেমিনিস্ট থিওরি, পাবলিক পলিসি আর পলিটিকস নিয়ে কাজ করার আগ্রহ আমাকে অনেক জায়গায় আলাদা করে তুলে। আর এগুলোর কারণেই আমি আজ একটা ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে, ভালো স্কলারশিপে, নিজের পছন্দের বিষয়টা নিয়ে পিএইচডি করতে পারছি।

যদি বলি জিপিএ-৫ আপনার লক্ষ্য পূরণে কোনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, কেন সেটা বলেন?
একদমই না। জিপিএ-৫ না পেলেও আমি আমার কাজ দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছি। আমার এখন peer-reviewed জার্নালে পাবলিকেশন আছে, বইয়ের চ্যাপ্টার আছে, গবেষণার স্কোর আছে—সব মিলিয়ে একটা স্ট্যাবল জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছি। এটা প্রমাণ করে যে, কেউ যদি নিজের যোগ্যতায় এগিয়ে যেতে চায়, তবে শুরুটা কেমন ছিল, সেটা খুব একটা বড় বিষয় না।

এসএসসিতে যাদের কাঙ্ক্ষিত ফল হয়নি, তাদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
আমি সবার প্রতি, বিশেষ করে বাংলাদেশের এসএসসি পরীক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলছি, রেজাল্ট ভালো হলে ভালো কথা, কিন্তু যদি প্রত্যাশার চেয়ে কম হয়, তাহলে ভেঙে পড়ো না। এসএসসি একটা স্টেপ, জীবন না। সামনে কলেজ আছে বিশ্ববিদ্যালয় আছে, ক্যারিয়ার আছে, স্কিল ডেভেলপমেন্ট আছে। তুমি যদি নিজের ভেতরটা চেনো এবং ধৈর্য ধরে এগিয়ে চলো, তাহলে জীবনে সবকিছু সম্ভব। একটা রেজাল্ট তোমার পরিচয় না, তোমার গল্পটা তুমি নিজেই লিখবে।