গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে এজেন্ট ব্যাংক

ফজলে রাব্বি সিনান
ফজলে রাব্বি সিনান  © টিডিসি সম্পাদিত

বৈধ এজেন্সি চুক্তির অধীনে এজেন্ট নিযুক্ত করার মাধ্যমে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠির জন্য ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা প্রদানই হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিকা অনুযায়ী এটি নিয়ন্ত্রিত হয়। সম্প্রতি এবি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং চট্টগ্রাম রিজিওনের বিদায়ী ইনচার্জ ফজলে রাব্বি সিনানের সাথে কথা হয় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের।

তার সময়ে এবি ব্যাংক চট্টগ্রামে বেশ অগ্রগতি লাভ করেছে এবং বিগত বছরের তুলনায় সর্বোচ্চ আমানত সংগ্রহ করেছে। অল্প সময়ের ভেতরে কাজ করেছেন চট্টগ্রামে এবি এজেন্ট ব্যাংকিং ফরমেশন নিয়ে। তরুণ এই কর্পোরেট ব্যক্তিত্বের সাথে আলাপচারিতায় উঠে এসেছে বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের যাত্রা, ভবিষ্যৎ ও এবি ব্যাংকের পরিকল্পনার প্রসঙ্গ। আলাপচারিতার চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মুনযির সা’দ-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি লোকপ্রশাসনের ছাত্র হয়ে ব্যাংকিং প্রফেশনে কেন এসেছেন?

ফজলে রাব্বি সিনান: ব্যাংকিং সেবা জনপ্রশাসনের একটি অংশ। আর লোকপ্রশাসন মূলত আর্থিক ও সাচিবিক বিদ্যার সমন্বয়। তাই আমার পক্ষে ব্যাংকিং প্রফেশনে আসার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে সহজ হয়েছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি বর্তমানে এবি ব্যাংকের চট্টগ্রাম অঞ্চলের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এজেন্ট ব্যাংকিং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নতুন কনসেপ্ট বা ধারণা। এটি কীভাবে কাজ করে?

ফজলে রাব্বি সিনান: এজেন্ট ব্যাংকিং কনসেপ্ট বা ধারণাটা ঠিক ততটাও নতুন নয়। সর্বপ্রথম ব্রাজিলে বিংশ শতাব্দীতে এই কনসেপ্ট জনপ্রিয় হয় এবং পরে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশ, যেমন কলম্বিয়া, পেরু, মেক্সিকো, এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশে (যেমন, ভারত, পাকিস্তান) ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং প্রথম যাত্রা করে ২০১৪ সালে। এবি ব্যাংক ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে এজেন্ট ব্যাংকিং নিয়ে কাজ শুরু করে। সে হিসেবে বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের বয়স বর্তমানে ১১ বছর চলছে। এটি গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসকারী ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে সারাদেশে ২১ হাজার ১৮৬টি এজেন্ট আউটলেট পরিচালিত হচ্ছে, যা ব্যাংক শাখার তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এজেন্ট ব্যাংকের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো কি? 

ফজলে রাব্বি সিনান: এজেন্ট ব্যাংকের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো স্বল্প ব্যয়ে ব্যাংকিং সেবা প্রদান করা। এজেন্ট ব্যাংক বিশেষায়িত হিসেবে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে। এক্ষেত্রে এটি তৃতীয় পক্ষের সাথে সমন্বয় করে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তৃতীয় পক্ষ কারা? কীভাবে সমন্বয় করে থাকেন?

ফজলে রাব্বি সিনান: বাংলাদেশ ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী, (ব্যাংক কোম্পানী অ্যাক্ট ১৯৯১, সেকশন ৫-ত এবং ৭) এখানে তৃতীয় পক্ষ হচ্ছে একজন স্বাধীন এজেন্ট। যিনি ব্যাংকের পক্ষে তার কাস্টমারকে প্রয়োজনীয় ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে থাকেন। এ ক্ষেত্রে ব্যাংক তার সার্বিক কার্যক্রমকে সার্বক্ষণিক মনিটরিং ও সহায়তা দিয়ে থাকেন। বিনিময়ে উক্ত এজেন্ট, ব্যাংক থেকে কমিশন পেয়ে থাকেন। একজন স্বাধীন এজেন্ট তার অনুমোদিত আউটলেট পয়েন্টের গ্রাহকদের নতুন একাউন্ট খোলা, টাকা লেনদেন, ঋণ বিতরণসহ সকল সেবা দিয়ে থাকেন। গত বছর এজেন্ট ব্যাংকের গ্রাহকদের মধ্যে প্রায় ২,১০৮.৯৮ বিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। এর পরিমাণ ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন গ্রাহক কখন ব্রাঞ্চের পরিবর্তে এজেন্টের সেবা গ্রহণ করবে? সেক্ষেত্রে গ্রাহক কি কি সেবা পাবে?

ফজলে রাব্বি সিনান: একজন গ্রাহক ব্রাঞ্চের সকল সেবাই এজেন্টের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। ব্রাঞ্চের নির্দিষ্ট লেনদেনের সময়সূচি থাকে তবে অধিকাংশ এজেন্ট ব্যাংকের সেরকম কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। যার ফলে একজন গ্রাহক যেকোনো সময় এজেন্ট পয়েন্টে এসে লেনদেন করতে পারবেন। তবে সেক্ষেত্রে গ্রাহক কর্তৃক ক্যাশ গ্রহণের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন-এজেন্ট পয়েন্টে ব্রাঞ্চ গ্রাহক ক্যাশ জমা দিতে পারবেন, তবে তুলতে পারবেন না। কেননা এজেন্ট পয়েন্টে চেক গ্রহণ নিষিদ্ধ। গ্রাহক এখানে ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে টাকা তুলতে পারবেন। কিন্তু একজন ব্রাঞ্চ গ্রাহকের সাধারণত ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংরক্ষিত থাকে না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যেহেতু এজেন্ট ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা চলে এসেছে এক্ষেত্রে আর কোন সীমাবদ্ধতা কি রয়েছে?

ফজলে রাব্বি সিনান: জুলাই মাসে শুরু হওয়া রাজনৈতিক অস্থিরতার ব্যাপক প্রভাব পড়ে এজেন্ট ব্যাংকে। টানা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেপ্টেম্বর শেষে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আমানত হারায় প্রায় ১২ শতাংশ যা টাকার হিসাবে প্রায় ৫৪৩ কোটি টাকা। এজেন্ট ব্যাংকের সবচেয়ে বড় সীমাবদ্ধতা হলো এখানে ব্রাঞ্চের সব কাজ সম্পাদন করা গেলেও এটার প্রক্রিয়া ঠিক ব্রাঞ্চ ব্যাংকিং এর মতো নয়। এখানে ব্রাঞ্চের মতো জমা স্লিপ ব্যবহার করা হয় না এবং চেক গ্রহণ করা হয় না। ফলে অনেক সময় অসাধু এজেন্টের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়াও সকল এজেন্টের সমান বিনিয়োগ নয়। যার কারণে কিছু কিছু এজেন্ট পয়েন্ট গ্রাহকের প্রত্যাশিত লেনদেন করতে পারেন না। সেক্ষেত্রে গ্রাহককে ব্রাঞ্চে যেতে হয়। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সীমাবদ্ধতা দূরীকরণে আপনারা কি করছেন?

ফজলে রাব্বি সিনান: গ্রাহকদের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করাই একমাত্র উপায়। একজন গ্রাহক যেমন মোবাইল রিচার্জের ক্ষেত্রে জায়গায় দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হয়ে থাকে এখানেও ঠিক তেমনি করলে আর  সীমাবদ্ধতা থাকে না। এক্ষেত্রে আমরা এবি ব্যাংকের পক্ষ থেকে মাসিক গ্রাহক সচেতনতা প্রোগ্রাম করে থাকি। যার মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং গ্রাহকদের লেনদেন সম্পর্কিত ধারণা প্রদান করা হয়। যেমন- টাকা জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক জমা স্লিপ এবং নাম্বারে মেসেজ চলে আসবে। মেসেজ না আসার অর্থ হলো গ্রাহকের একাউন্টে টাকা জমা হয়নি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এজেন্ট ব্যাংকিং কোথায় বেশী গুরুত্বপূর্ণ?

ফজলে রাব্বি সিনান: অবশ্যই এটি গ্রামীণ ও দূরবর্তী এলাকায় ভালো ফাংশন করে। যেহেতু এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রুট লেভেলকে টার্গেট করে। তবে সেক্ষেত্রে এজেন্ট মালিকের ভূমিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিগত ২০২৪ সালের জুনের হিসাব অনুযায়ী সারাদেশে সক্রিয় সকল এজেন্ট ব্যাংকের মোট আমানতের পরিমাণ  প্রায় ৪০০.৭৩ বিলিয়ন টাকা, যা মোট প্রবৃদ্ধির প্রায় ২০% । এর মধ্যে ৩২৬.০৩ বিলিয়ন টাকা এসেছে গ্রামীণ এলাকা থেকে। যা মোট আমানতের ৮১.৩৬% । মূলত যেসব গ্রামীণ এলাকায় ব্যাংকের শাখা স্থাপন করা ব্যয়বহুল এবং প্রায় অসম্ভব সেসব এলাকাকে টার্গেট করে এজেন্ট ব্যাংক কনসেপ্ট কাজ করে। তবে শহর এরিয়াতেও এটি অনেক কার্যকর বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। বর্তমানে বিরাটসংখ্যক কর্পোরেট গ্রাহক এজেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিগত বছরে এবি ব্যাংক নিয়ে অসংখ্য নেতিবাচক খবর ছড়িয়েছে। এর কারণ কি?

ফজলে রাব্বি সিনান: দেখুন, বাংলাদেশের ব্যাংকিং সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় পার করছে। বিগত সময়ে অনেক ব্যাংকের মতো তার কিছুটা আঁচ এবি ব্যাংকেও লেগেছিলো। তবে এবি ব্যাংকের আর্থিক প্রভাব পড়েনি। যৌক্তিক কারণ ছাড়া এবি ব্যাংকে ‘চেক বাউন্স’ হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ নেই। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এই বছর এবি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকের পরিকল্পনা কি?

ফজলে রাব্বি সিনান: বর্তমানে এবি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা প্রায় ২৪০ কোটি টাকা আমানত এবং সারাদেশে ১৯২টি এজেন্ট আউটলেট নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চলতি বছর তা দ্বিগুণের বেশি বর্ধিত করার পরিকল্পনা করেছে এবং সে লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।


সর্বশেষ সংবাদ