সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতি অপসারণ, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি থেকে সরে আসিনি

আখতার হোসেন
আখতার হোসেন  © টিডিসি সম্পাদিত

গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচারী হাসিনার পতনের পর বেশকিছু দাবি নিয়ে মাঠে সরব ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। দাবিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি, ৭২-এর মুজিবীয় সংবিধান বাতিল, রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর অপসারণ এবং গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সে দাবি পূরণ হয়নি এবং আন্দোলন অনেকটাই স্তিমিত হয়ে পড়েছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেছেন, তারা এখনো এই প্রধান দাবিগুলো থেকে সরে আসেননি। সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে এক সাক্ষাৎকারে রাজনৈতিক বাস্তবতায় গণপরিষদ নির্বাচন এবং নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তুতিসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক তাওসিফুল ইসলাম-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সকল রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠন  একত্রে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বৈরাচার পতনের আন্দোলন করেছে। অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে সে ঐক্যে কিছুটা ফাটল ধরেছে। সেটা কেন? 

আখতার হোসেন: জুলাই অভ্যুত্থানের সময়ে সমস্ত রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন এবং যারা রাজনীতি করে না তারাও সকলে মিলেই এই আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আন্দোলনের অর্জন - হাসিনার পলায়ন। তারপরে প্রত্যেক সংগঠনের যে দলীয় রাজনীতি আছে সেই রাজনীতিতে তারা ফোকাস করেছে। এই কারণে দৃশ্যত মতপার্থক্য মনে হলেও যখন ফ্যাসিবাদের প্রশ্ন আসে, সকল ছাত্রসংগঠনকে একই সুরে কথা বলতে দেখি। ফ্যাসিবাদের প্রশ্নে কোন ছাত্রসংগঠনের দ্বিমত আছে - এমনটা আমার মনে হয়নি। কিন্তু প্রত্যেকটা ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের নিজস্ব এজেন্ডা আছে। নিজস্ব ভিউ  পয়েন্ট আছে৷ নিজেদের কিছু সাংগঠনিক আদর্শ এবং বক্তৃতা আছে। তার উপর ভিত্তি করে তারা তাদের রাজনীতিকে সামনের দিকে অগ্রসর করে নিয়ে যাবে। প্রত্যেকটা দলের আদর্শ এবং ভিউ যদি একই রকম হয় তাহলে হয়না। বহুদলীয় গণতন্ত্রের আমাদের এই দেশে বহুমত থাকবে, বহু দল থাকবে, মতৈক্য থাকবে, মতানৈক্যও থাকবে। সবকিছু মিলিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা ছাত্র সংগঠনগুলো তাদের আলাদা আলাদা রাজনীতির বাইরে গিয়েও বাংলাদেশ প্রশ্নে এক। বাংলাদেশে কোনোভাবে আর দিল্লির আগ্রাসন চলতে পারে না - এই পয়েন্টেও সকল ছাত্র সংগঠন একমত হয়েছে। আবার একইসাথে ১৫ আগস্টের আগে টিএসসিতে যখন সকল ছাত্র সংগঠন নিয়ে বসা হলো তখন সবার সম্মিলিত মতামত ছিল, ১৫ আগস্ট তথাকথিত জাতির পিতার শোক দিবস পালন করা যাবেনা। অর্থাৎ সকল মতানৈক্যের বাইরে গিয়েও সব ছাত্র সংগঠনের বাংলাদেশকে ধরে রাখার একটা ইতিবাচক চিন্তা আছে। কিন্তু ছাত্র সংগঠনগুলো যদি পরস্পর রেষারেষিতে থাকে, এক সংগঠন আরেক সংগঠনের ব্যাপারে যদি অযাচিত মন্তব্য করে, তাহলে সেটা অবশ্যই খারাপ দেখায়। আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। নতুন ছাত্র রাজনীতি করবো। ছাত্ররা টেন্ডারবাজি করবে না, দখলদারি করবেনা, গেস্টরুমে নিয়ে অত্যাচার করবে না, কাউকে সালাম দেওয়া হল না কেন সেজন্য ধরে র‍্যাগ দিবে না। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এই আন্দোলনের সময়ে আপনাকে দেখলাম অনেকটাই পর্দার পেছন থেকে কাজ করেছেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম কমিটিতেও সমন্বয়কের দায়িত্বে আপনি ছিলেন না। এই কমিটিতে না থাকার কারণ আসলে কী? 

আখতার হোসেন: আমি দীর্ঘ সময় ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এক্টিভিজমের সাথে জড়িত ছিলাম। আমার ছাত্রত্ব শেষ হয়েছে। আমি ভাবতে থাকি ক্যাম্পাস থেকে শিফট করে জাতীয় রাজনীতিতে চলে আসব। আমার পরে সংগঠনের জন্য অ্যাক্টিভিজম করবেন সেরকম নেতৃত্ব তখনো তৈরি হয়নি। সে কারণে এবং আমি যেহেতু আগে থেকে সরকারবিরোধী মুখ হিসেবে ক্যাম্পাসে পরিচিত- তাই আমি সামনে আসলে আন্দোলন বাঁধাগ্রস্ত হতে পারতো, শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভয়ের সঞ্চার করতে পারত ছাত্রলীগ - এই দুইটা বিষয় মাথায় রেখে আমি সামনে আসিনি। শুরুতেই যেন শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন নেমে না আসে এবং নতুন নেতৃত্ব তৈরির জন্য ১৭ জুলাই গ্রেপ্তার হওয়ার আগ পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে থেকে কাজ করাটা শ্রেয় মনে করেছি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পরে উপদেষ্টা পরিষদ বর্ধিত হয়েছে। সেখানে আপনার নামও প্রস্তাব করা হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকে আপনার সাথে এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে কিনা? 

আখতার হোসেন: উপদেষ্টা হওয়ার বিষয়টা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ একটা সিদ্ধান্ত। কিন্তু সব বিষয়ে আমার অংশগ্রহণ আছে বিষয়টি এরকম নয়। অর্থাৎ ড. মুহাম্মদ ইউনুস স্যারের নেতৃত্বে যে উপদেষ্টামণ্ডলীরা আছেন, তারা তাদের স্ব স্ব ক্যাপাসিটিতে এবং একইসাথে সেসময় যারা লিয়াজু কমিটিতে যারা ছিলেন তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে উপদেষ্টা পরিষদটি গঠিত হয়েছে। আমি দীর্ঘদিন ধরে এক্টিভিজম করে আসছি। সে জায়গায় আমি মনে করি আমার আরো শক্তভাবে এক্টিভিজম শেখা উচিত।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সহযোগিতায় গত ৩১ ডিসেম্বর আপনারা জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে সরকারের পক্ষ থেকে প্রস্তাব এসেছিল সকল রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে সরকার জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরি করবেন। আপনারা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে তৈরি করার জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। সেটার প্রস্তুতি কতটুকু? সরকারের সাথে আপনাদের যোগাযোগ হয়েছে?

আখতার হোসেন: আমরা প্রক্লেমেশনের দাবি থেকে সরে এসেছি বিষয়টি এমন নয়। বরং আমরা প্রক্লেমেশন পাঠের কর্মসূচি স্থগিত রেখেছি। প্রক্লেমেশনের দাবিতে আমরা অটল। সে লক্ষ্যে পুরো বাংলাদেশে লিফলেট বিতরণের কাজ চলছে, আমরা জনসংযোগ করছি। সারাদেশের প্রত্যেকটা এলাকায়, গ্রামেগঞ্জে আমাদের লিফলেট পৌঁছে গেছে। মানুষের বক্তব্য শুনছি আমরা, তারা কিরকম বাংলাদেশ চায়। সেরকম বাংলাদেশের কথা আমাদের প্রক্লেমেশনে থাকবে। মানুষ দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ চায়, ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ চায়, জীবন এবং জীবিকার নিরাপত্তা চায়। এই কথাগুলো আমরা তাদের কাছ থেকে শুনেছি। একইসাথে বাংলাদেশের মানুষ এক সাম্যের দেশ চায়, ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সকলের মানবিক মর্যাদার এক বাংলাদেশ চাচ্ছে। এমতাবস্থায় ৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র পাঠের কর্মসূচি স্থগিত রেখে আমরা সরকারকে ১৫ জানুয়ারির মধ্যে প্রক্লেমেশন ঘোষণা করার আহ্বান জানিয়েছি। সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ চোখে পড়েনি। বরং সরকারের আরো কিছু সময় লাগতে পারে - সেরকম আভাস আমরা পেয়েছি। আমরা ১৫ তারিখ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো। এরপরে সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের যদি আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়  এবং যৌক্তিকভাবে তাদের যদি সময়ের প্রয়োজন হয় সেটা বিবেচনা করা যাবে। আর যদি মনে হয় শুধু শুধু কালক্ষেপণ করা হচ্ছে, আমাদের সিদ্ধান্ত হয়ত আমাদেরই গ্রহণ করা লাগতে পারে। কিন্তু আমরা চাই, বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক পক্ষ এবং দল সবাই মিলে এক ভাষায় যেন আমরা একটা প্রক্লেমেশন দিতে পারি। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমাদের চাওয়া থাকবে প্রক্লেমেশনের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান পরিষ্কার করুন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির জন্য সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু আপনি বলছেন সারাদেশে জনসংযোগ আপনারাই করছেন। এই কাজটি করা সরকারের দায়িত্ব ছিল? নাকি সরকার আপনাদেরকে দায়িত্ব দিয়েছে? 

আখতার হোসেন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অভ্যুত্থানের প্ল্যাটফর্ম। অভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় লেজিটিমেট বডি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তারাই প্রক্লেমেশনের কথাটা প্রথম উঠিয়েছে। দাবি জানিয়েছে। সরকারকে একটা সময় বেঁধে দিয়েছে। অতএব স্ব-উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি সারাদেশে লিফলেট বিতরণ এবং জনসংযোগ করছে। আমরা সরকারের কাছে যে খসড়া প্রস্তাবনা উত্থাপন করব সেখানে যেন জনগণের চাওয়া প্রস্ফুটিত হয় সেজন্যে আমরা লিফলেট বিতরণ করছি। অপরদিকে সরকারের কাজ হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসা। তাদের কাছ থেকে প্রস্তাবনা সংগ্রহ করা। আমরা সরকারের কাছ থেকে দায়িত্ব নিয়ে করছি বিষয়টা এমন নয়। আমরা স্ব-উদ্যোগে মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছি তাদের ভাষা, কথা ও চাওয়াগুলো জানার জন্য। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে আপনাদের বেশ কিছু বড় দাবি ছিল। যেমন, সংবিধান বাতিল করতে হবে। আসলে আপনাদের দাবিটা কার কাছে ছিল? অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে? যদি তাদের কাছেই হয়ে থাকে, তারা সংবিধান বাতিল করার এখতিয়ার রাখে?

আখতার হোসেন: ৫ আগস্টের পর অনেক কিছু করা হয়ত সম্ভবপর ছিল। কিন্তু যে অভ্যুত্থানটি সংঘটিত হলো সেটা এখনো বিপ্লবে পরিণত হয়নি। বিপ্লবে রূপান্তরিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে আমরা আছি। অতএব আমরা সংবিধান বাতিলের যে দাবি জানিয়েছি সেখান থেকে সরে আসিনি। এখন প্রশ্ন এসেছে, যদি এই সংবিধান বাতিল হয়ে যায় তাহলে নতুন সংবিধান প্রয়োজন হবে। নতুন সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে কারা মুখ্য ভূমিকা পালন করবে? এই সরকারে যারা আছেন তারা? নাকি বৈষম্যবিরোধীতে যারা আছেন তারা?আমরা বলেছি - না। একটা গণপরিষদ নির্বাচন হবে। নির্বাচনে জয়ীরাই একটা লেজিটিমেট বডি হবে। তারাই সংবিধান প্রণয়ন করবেন। একইসাথে আমরা বলেছি, যারা গণপরিষদে আসবেন তারা আইনসভার সদস্য হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন। সামনে কোন নির্বাচনটা হবে তা নিয়ে একটা ডিলেমা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মত হলো, এখানে তেমন কোনো ডিলেমা থাকা উচিত না। আমরা আমাদের জায়গা থেকে দুইটা দাবি জানিয়েছি - সংবিধান প্রণয়ন এবং গণপরিষদ নির্বাচন। অন্যান্য দলগুলো হয়ত শুধু নির্বাচনের কথা বলছেন। আমরা মনে করি, ৫৩ বছর পরে বাংলাদেশের মানুষ একটা নতুন সুযোগ পেয়েছে। এই সুযোগটাকে কাজে লাগানো দরকার। বাংলাদেশের সংবিধান যে অবস্থায় আছে - এক তৃতীয়াংশের বেশি সংশোধন করা যাবে না। এই সংবিধানকে আওয়ামী মোড়ক দেওয়া হয়েছে। এই সংবিধান বাংলাদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাসের সকল নেতাকে বাদ দিয়ে একজনকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করেছে। অনেক মৌলিক চাহিদার স্বীকৃতি এই সংবিধানে দেওয়া নেই। ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়েও চূড়ান্ত বিতর্ক আছে। এই সংবিধানটা এমনভাবে আওয়ামী মোড়কে আবৃত যেখানে গণতন্ত্রের কথা বলা হলেও প্র্যাক্টিস তারা করেছে স্বৈরতন্ত্রের, ভোট ডাকাতির। সেখানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা থাকলেও তারা ইসলামবিদ্বেষের চর্চা করে গেছে। সমাজতন্ত্রের কথা থাকলেও লুটেরা অর্থনীতি তারা চালু করেছে। জাতীয়তাবাদের কথা বলে ভারতের কাছে তারা দেশ বিক্রি করে দিয়েছে। তারা বলেছে, ভারতকে যা দিয়েছি তা আজীবন মনে রাখবে। একাত্তরের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সুবিচারের যে ধারণা, সেটাকে এই সংবিধান ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই কারণে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং চব্বিশের অভ্যুত্থানের চেতনাকে ধারণ করতে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করা প্রয়োজন। সে দায়িত্বটা পাবেন গণপরিষদে নির্বাচিত সদস্যরা  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাদের আরো দুটো বড় দাবি ছিল। রাষ্ট্রপতি অপসারণ এবং আওয়ামি লীগ নিষিদ্ধের দাবি। সে দাবি থেকে সরে এসেছেন? কীভাবে এই দাবি পূরণে আপনারা কাজ করছেন? 

আখতার হোসেন: আওয়ামী আমলে আওয়ামী লীগের এক দোসরকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বানানো হয়েছে। আমরা আমাদের জায়গা থেকে দাবি জানিয়েছিলাম যে রাষ্ট্রপতি চুপ্পুকে অপসারণ করতে হবে। তিনি ফ্যাসিবাদের প্রতীক হয়ে এখনও সেখানে বসে আছেন। আমাদের দাবি থেকে আমরা এখনো পর্যন্ত সরে আসি নাই। তবে এটা সত্য আমরা যখন দাবিটি জানিয়েছিলাম তখন নানাবিধ বাস্তবতার কারণে সফল হতে পারেনি। হয়ত সামনের দিনে আরও খোলাসা করে বলা যাবে। আমরা স্পষ্ট করে বলেছি, আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার হারিয়ে ফেলেছে। এদেশে তারা নিকৃষ্ট এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। ২০০০ এর অধিক মানুষকে গুলি করে, কুপিয়ে হত্যা করা হলো। যারা এই হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ এ ভোট ডাকাতি করেছে, গণতন্ত্রকে যারা হরণ করলেন, যারা শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ড করলেন, যারা পিলখানা ট্র্যাজেডি ঘটালেন, যারা ২০২১ সালে মোদীর আগমনের বিরোধিতা করায় রাস্তার মধ্যে মানুষকে গুলি করে পাখির মতো হত্যা করলো, তাদের বিচার হওয়া প্রয়োজন। তাদের সঠিকভাবে বিচারের আওতায় নিয়ে আসা সরকারের প্রধান কর্তব্য। এখনও পর্যন্ত সরকার এই জায়গায় সফলতার মুখ দেখাতে পারেনি। আমরা চাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করবে যেন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে আর রাজনীতি করার সুযোগ না পায়। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট কারো কারো নামে তদবির বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। সেগুলো কীভাবে এড্রেস করছেন? 

আখতার হোসেন: নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে আমি দায়িত্ব নিয়ে বলতে চাই, নাগরিক কমিটির কেউ যদি কোন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন, যার কাছে খবরটা থাকবে তিনি যেন আমাদের কাছে খবরটা পৌঁছিয়ে দেন। আমরা সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিব। ইতোমধ্যে আমরা কয়েকজনকে বহিষ্কার করেছি আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্টতার কারণে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: নতুন বছরের শুরুতে আপনাদের একটা রাজনৈতিক দল গঠনের পরিকল্পনা জানিয়েছিলেন। সে প্রস্তুতি কতটুকু?

আখতার হোসেন: জাতীয় নাগরিক কমিটি সারাদেশে প্রায় ২০০ থানায় কমিটি করতে সক্ষম হয়েছে। আমি আশা করছি জানুয়ারির মধ্যে সবগুলো থানায় প্রতিনিধি কমিটি দেওয়া সম্ভব হবে। একইসাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সারাদেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। এ সমস্ত কমিটিতে অনেক মানুষ আছেন যারা ভবিষ্যতের রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণ করবেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি আরো অনেক মানুষকে আমাদের রাজনৈতিক যাত্রায় অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করব। সারাদেশে যেসব মুক্তা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সেগুলোকে একত্র করে মালা গাঁথার চেষ্টা করব। আমরা আশা করছি, ফেব্রুয়ারির মধ্যেই আমাদের রাজনৈতিক দলের ঘোষণা দিতে পারব। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন, জাতীয় নাগরিক কমিটি কিংবা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সরাসরি রাজনৈতিক দলে পরিণত হবেনা। এই দুটি প্লাটফর্ম প্রেশার গ্রুপ হিসেবে কাজ করে যাবে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দলের নাম কি ঠিক করেছেন?

আখতার হোসেন: না। নাম এখনো চূড়ান্ত করিনি। অনেকের কাছে একটা ম্যাসেজ গেছে যে, জনশক্তি নাম হতে পারে। পরবর্তীতে আমরা একটা প্রেস রিলিজের মাধ্যমে আমাদের বক্তব্য পরিষ্কার করেছি যে এখনো নাম ঠিক হয়নি। নামের প্রস্তাবনা চেয়ে আমি একটা ফেসবুকে পোস্ট করেছিলাম। সেখানে শতাধিক প্রস্তাবনা এসেছে। আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করছি। সে নামগুলো পর্যালোচনা করে একটি নাম ঠিক করব। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাদের একটা ছাত্র সংগঠন ছিল - গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে সেটার কার্যক্রম স্থগিত করেছেন। সে সংগঠন নিয়ে পরিকল্পনা কী?

আখতার হোসেন: গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির যাত্রা শুরু হয় ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর। এক বছর পেরোতে না পেরোতেই গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির নেতাকর্মীরা বাংলাদেশের সকল জনগণকে সাথে নিয়ে একটি সফল গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছে। এরপরে আমরা ছাত্রশক্তির কার্যক্রম স্থগিত করেছি। এখনও স্থগিত আছে। সামনের দিনে সেটা স্থগিত থাকবে নাকি আবারো নতুন করে শুরু হবে সেই সিদ্ধান্ত আমরা আলাপ-আলোচনা করে তারপর জানিয়ে দেবো। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেকেই বলেন, আপনারা সরকারের সংগঠন। কারণ, আপনাদের পক্ষ থেকে সরকারে প্রতিনিধি আছে। সরকারের কাজের সমালোচনা করে অনেকে আপনাদেরকে দায়ী করে। এ ব্যাপারে কী বলবেন?

আখতার হোসেন: ৮ সেপ্টেম্বর যেদিন জাতীয় নাগরিক কমিটি ঘোষণা হয় সেদিন আমরা প্রেস রিলিজ দিয়ে স্পষ্ট করেছি, আমরা আলোচনা, সমালোচনা এবং কাজের ভিত্তিতে সরকারকে মূল্যায়ন করতে চাই। আমরা সরকারকে সহযোগিতাও করতে চাই, আবার সরকারের কাজগুলোকে পর্যালোচনাও করতে চাই। দুইদিন আগে সরকার যে ভ্যাট বাড়ালো তার সমালোচনা করেছি যেন জনগণের জীবন ও জীবিকার উপর বিরূপ প্রভাব না পড়ে। সময়ে সময়ে আইনশৃঙ্খলার যে অবনতি ঘটেছে সে বিষয়টিও আমরা স্পষ্ট করেছি। আমরা আসলে সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই এই অর্থে, যাতে করে সরকার তার প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজগুলো সম্পন্ন করতে পারে। একইসাথে যারা পতিত ফ্যাসিস্ট আছে তারা যেন সরকারকে উৎখাত করে কোনোভাবে ফ্যাসিজমকে ফিরিয়ে আনতে না পারে। এই পয়েন্টে আমরা সরকারকে সহযোগিতা করার পক্ষে। কিন্তু সরকারের যে দৈনন্দিন কার্যপ্রণালী আছে, যত কাজ তারা করছে, যেখানেই আমরা দেখছি জনস্বার্থের পরিপন্থী কিছু আছে তার প্রত্যেক ব্যাপারে আমাদের সমালোচনা অব্যাহত রেখেছি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক ছিলেন। বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আবারো ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। সে জায়গায় অনেক ছাত্র সংগঠন দ্রুততম সময়ে নির্বাচন চায়, আবার কোন কোন সংগঠন সংস্কারের পরে নির্বাচন চায়। আপনার আহ্বান কী?

আখতার হোসেন: বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে আমার আহ্বান থাকবে যত দ্রুত সম্ভব ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার জন্য। ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের বৈধ প্রতিনিধি পাবে। একইসাথে ছাত্র রাজনীতির রূপায়ণ কিরকম হতে যাচ্ছে - সে প্রশ্নের একটা মীমাংসা হতে পারে ডাকসু নির্বাচন। অনেক ছাত্র সংগঠন মনে করছে, জাতীয় নির্বাচনের পরে ডাকসু নির্বাচন হওয়া উচিত। কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছোট ছোট নির্বাচন। নির্বাচনগুলো একটা টেস্ট কেইস হতে পারে যে বাংলাদেশে ফ্রি এন্ড ফেয়ার নির্বাচন সম্ভব। সেই টেস্ট কেইসগুলো বিবেচনায় নিয়ে আমরা যখন জাতীয় নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হব তখন এগুলো আমাদেরকে নানাবিধভাবে উপকৃত করতে পারে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন গ্রুপে দেখেছি, প্রায় ৯৯% শিক্ষার্থী দ্রুততম সময়ে ডাকসু নির্বাচন চায়। তাদের এই মতামতের প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ প্রশাসন যেন শ্রদ্ধা রাখে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশের এই সংকটময় মুহূর্তে দেশবাসীর প্রতি আপনার কী আহ্বান আছে?

আখতার হোসেন: বাংলাদেশ অনেকদিন পর  এক নতুন আবহে নিজেকে রাঙানোর সুযোগ পেয়েছে। আমি দেখেছি বাংলাদেশের সকল মানুষ বিপদে-আপদে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছে। এইতো সেদিন সীমান্তে আমাদের বিজিবির সাথে বিএসএফের দ্বন্দ্ব শুরু হয়, তখন সব মানুষ দলবেঁধে সেখানে গিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। আমরা দেখি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি দারুণভাবে বিরাজ করে। আমরা চাই বাংলাদেশের মানুষ নাগরিক অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকবে, নাগরিক মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকবে। এই কথার উপরেই যেন সামনের রাজনীতি নির্ধারিত হয়। আমরা যদি কোন ভুল ত্রুটি করি অবশ্যই আমাদেরকে জানাবেন। আমরা নিজেদেরকে সংশোধিত করতে চাই। একইসাথে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের সাথে কাজ করতে চাই। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ধন্যবাদ আপনাকে।

আখতার হোসেন: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।


সর্বশেষ সংবাদ