০৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৯:০২

শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ

১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এই দিবসটি শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য পালন করা হয়। শিক্ষক দিবসে শিক্ষকবৃন্দের চাওয়া-পাওয়া,বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার চ্যালেঞ্জ এবং শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নসহ বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (হাবিপ্রবি) ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এবং বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডিতে অধ্যয়নরত মো. জুয়েল  আহমেদ সরকার

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাবিপ্রবি প্রতিনিধি রিয়া মোদক

 

১. শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়—আমাদের শিক্ষকরা সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত আলোকিত মানুষ তৈরি করতে পারছেন?

আজ থেকে কয়েক দশক আগে আমরা-আমাদের আগের প্রজন্মের যেভাবে সামাজিকীকরণ হতো তা মূলত পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তথা শিক্ষকদের মাধ্যমে। অর্থাৎ জ্ঞানের জগতে প্রবেশ মূলত শিক্ষকদের হাত ধরে। সেখানে তারা নীতি নৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ইত্যাদি শিক্ষা দিতেন। যে কারণে শিক্ষকদের আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে গন্য করা হয়। বর্তমানে অনলাইন ব্যবস্থা  আমাদের বিশ্বের বিভিন্ন সোর্স থেকে জ্ঞান আহরণের সুযোগ করে দিয়েছে। যার ফলে শিক্ষকদের একমাত্র জ্ঞানের উৎস ভাবার যায়গায় পরিবর্তন ও বৈচিত্র্যের সুযোগ এসেছে। তবে এখনও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে এমন অনেক শিক্ষক আছেন, যারা শিক্ষার্থীদের নিয়ে ভাবেন। তাদের জ্ঞানের বহর দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে। তবে সংখ্যাটা কম বা বেশি হতে পারে। তবে সব যায়গায় এমন আলোকিত মানুষ এখনও আছেন, নয়তো একটা সিস্টেম দাঁড়ায় থাকেনা।

২. একজন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

আমাদের মধ্যে একটা প্রচলিত ধারণা আছে। শিক্ষক হলেন জ্ঞানের বহর, তিনি শুধু জ্ঞান ঢালবেন। আর ছাত্র একটি পাত্রে সেই জ্ঞান গ্রহণ করবেন। এটাকে ব্যাংকিং সিস্টেমের সাথেও তুলনা করা যায়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কোন বিষয় জানা, বুঝতে পারা এবং বিশ্লেষণ করার ক্ষমতাই প্রকৃত শিক্ষা। এখানে কোন সুপিরিয়র-জুনিয়র নেই। এটি একটি পারষ্পরিক মিথস্ক্রিয়ার ফল। যে কেউ যে কারও কাছ থেকে জ্ঞান আহরণ করতে পারে। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কটা বন্ধুত্বপূর্ণ। এখানে কেউ কারও অথরিটি বা সাব অর্ডিনেট না। এমন আচরণে আসলে প্রকৃত জ্ঞান সৃষ্টি বা বিকাশ বাধাপ্রাপ্ত হয়।

৩. দেশের শিক্ষকরা বেতন-মর্যাদায় পিছিয়ে আছে বলে শোনা যায়-সেটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?

এটা মোটামুটি একটা ইউনিভার্সাল বিতর্ক বলতে পারি। আমি বর্তমানে যে স্টেটে আছি, এখানেও বিগত বছরে স্কুল পর্যায়ের শিক্ষকদের যে বেতন ছিলো তা পরিবর্তন করে সবার একটা বেসিক স্যালারিতে উন্নীত করা হয় একটা গবেষণার পর। আমাদের দেশেও বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর সুযোগ থাকে অনেকদিকে যাওয়ার। তবে শিক্ষকতা পেশায় যে বেতন তা অন্যান্য চাকুরির চেয়ে কম। আবার শুধু ঢালাওভাবে বেতন বাড়ালেই সব সমাধান হয়ে যাবে, ব্যাপারটা এমন নয়। শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়নের জন্য কাজ করতে হবে। একজন ফ্রেস গ্রাজুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে জয়েনের পর তাকে একজন ভালো গবেষক হিসেবে গড়ে তোমার জন্য ইনস্টিটিউশন ও ফান্ডের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিদ্যমান যেসব ফ্যাসিলিটিস আছে, সেখানে অপেক্ষাকৃত সিনিয়র বা ভালো গবেষকরা সে সুযোগটা পাচ্ছে। কিন্তু নবীন শিক্ষককে সেখানে ট্যাগ করা বা ভালো রিসার্চার হিসেবে গড়ে তোলার আয়োজনটা কম। অন্যান্য ক্যাডার বা নন ক্যাডার সার্ভিসে জয়েনের পর তাদের প্রশিক্ষণ বা ডেভেলপমেন্ট এর জন্য আলাদা ইন্সটিটিউট আছে। ইন্সটিটিশনাল এরেঞ্জমেন্ট আছে। শিক্ষকদের ক্ষেত্রে যেসব আছে তা আরও ফলপ্রসূ করতে হবে। 

৪. শিক্ষার্থীদের শেখানোর সময় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ কী বলে আপনি মনে করেন?

এটির ভিন্ন ভিন্ন কনটেক্সট আছে। আমি যদি হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেক্ষাপটে আমার অভিজ্ঞতা থেকে বলি। একটা ডিপার্টমেন্টে ৫-৬টা ব্যাচ চলমান। সেখানে শিক্ষক মাত্র ৩-৫জন। ফলে তাকে ৫-৬টা কোর্স নিতে হচ্ছে বা তারও বেশি। এতে শিক্ষার্থীরা কোয়ালিটি এডুকেশন কেমন পাচ্ছে তা একটি বড় প্রশ্ন। পাশাপাশি রুমে বেসিক সাউন্ড সিস্টেম, ল্যাব বা অবকাঠামোগত সুবিধা দরকার তা পর্যাপ্ত নেই। প্রযুক্তিগত সেসব দিকে নজর দিতে হবে। উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আছে। আপ টু ডেট সব রিসোর্স ও বই এভেইলেবল আছে। সেখানে আমাদের চ্যালেঞ্জ রয়েছে৷ পাশাপাশি শিক্ষকদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা করতে হবে।

৫. শিক্ষা ক্ষেত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী? ভবিষ্যতের শিক্ষাব্যবস্থায় আপনি কেমন পরিবর্তন আশা করেন?

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘাটতি রয়েছে, যেগুলো নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয় না, কিন্তু অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। 

প্রথমত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও, এর মধ্যে একটি আলাদা করার প্রবণতা রয়েছে। যা তাদের মাইন্ডসেটকে সীমাবদ্ধ করছে। ফলে, একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ তৈরির যে মনোভাব শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তোলা উচিত, তা গড়ে উঠছে না। শিক্ষার্থীদের মধ্যে দক্ষতা ও মানসিকতার এমন একটি কাঠামো তৈরি করা দরকার, যেখানে সবাইকে স্বীকৃতি দেওয়া হবে এবং সবাই দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারবে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় এ নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা বা পদক্ষেপ দেখা যায় না। বরং বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে বৈরীতা এবং বিভাজন তৈরি হয়, যা শিক্ষার্থীদের একে অপরের বিরুদ্ধে দাঁড় করায়।দ্বিতীয়ত, একজন শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষে প্রকৃতপক্ষে কর্মজীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছে কি না, এ বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট মনোযোগ নেই। এর ফলে শিক্ষিতের সংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু সেই সাথে বাড়ছে বেকারের সংখ্যাও। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দক্ষ এবং যোগ্য কর্মী তৈরি করা, কিন্তু এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আলোচনা প্রায় অনুপস্থিত। তৃতীয়ত আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ডিগ্রিগুলোর সাথে শিল্পখাত বা ইন্ডাস্ট্রির সংযোগ অত্যন্ত কম। গবেষণা এবং অন্যান্য কার্যক্রমের জন্য শিল্প খাতের সাথে যোগাযোগের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এ উদ্যোগে তেমন ভূমিকা রাখছে না, এবং শিল্প খাতের সাথেও সহযোগিতার প্রচেষ্টা খুবই সীমিত। ফলে শিক্ষার্থীরা চাকরির বাজারের প্রয়োজনের সাথে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে না।

এগুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বড় ঘাটতি, যা এড্রেস না করা হলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়বে, কিন্তু দক্ষ জনশক্তি তৈরি হবে না।

৬. প্রযুক্তির কারণে শিক্ষকতার পদ্ধতিতে কী পরিবর্তন এসেছে?

প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে শিক্ষকতায় ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিকই এসেছে। সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপক ব্যবহার শিক্ষার্থীদের একাডেমিক উন্নয়নে কিছু নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যেমন একাডেমিক পারফরম্যান্স, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং মানসিক স্বাস্থ্যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যায়। শিক্ষকদের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ শিক্ষার্থীদের কীভাবে এ ধরনের প্ল্যাটফর্ম থেকে দূরে রেখে জ্ঞান উৎপাদনের দিকে মনোনিবেশ করানো যায়, তা নিয়ে নতুন চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজন।কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), বিশেষ করে চ্যাটজিপিটির মতো টুলগুলো, শিক্ষার্থীরা এখন নিয়মিত ব্যবহার করছে। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা এসাইনমেন্টে সাহায্য নিচ্ছে, যা অনেক সময় শিক্ষকরাও সঠিকভাবে শনাক্ত করতে পারছেন না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ নিয়ে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা নেই, যা শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে নির্দেশনা দিতে পারে। এআই-কে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব নয়, বরং এটিকে কীভাবে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করা জরুরি।
এ ছাড়া, শিক্ষকদেরও প্রযুক্তিগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। নইলে শিক্ষার্থীদের সাথে মানসিক দূরত্ব তৈরি হতে পারে, যা শিক্ষাদানের প্রক্রিয়াকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলবে।

৭.শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার কোনও বিশেষ পরামর্শ আছে কি, যা তারা তাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে?

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সাধারণত চাকরির সুযোগ পাওয়াকে কেন্দ্র করেই পড়াশোনা করে। কিন্তু আসলে ক্যারিয়ার বলতে শুধু চাকরি পাওয়া বোঝায় না। চাকরি পাওয়ার মাধ্যমে ক্যারিয়ারের সূচনা হয়, কিন্তু ক্যারিয়ারের প্রকৃত সফলতা নির্ভর করে সেই চাকরিতে কত দূর যাওয়া যায়, তার ওপর। এ জন্য একটি ভালো রোডম্যাপ বা সুপরিকল্পনা থাকা অত্যন্ত জরুরি। 

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য একটি মজবুত ভিত্তি গড়ে তোলা। যদি কেউ শুধুমাত্র চাকরি পাওয়ার দিকেই মনোযোগ দেয়, তবে ক্যারিয়ারের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। 

তাই আত্মমূল্যায়ন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ—চাকরি পাওয়ার পর আমরা কতটা এগোতে পারব, সেই আত্মবিশ্বাস এবং প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করছি কিনা তা নিয়মিতভাবে যাচাই করতে হবে। নিজেকে দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে হলে প্রাসঙ্গিক দক্ষতা কতটুকু অর্জিত হয়েছে তা বিবেচনা করতে হবে এবং সবসময় নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। 

আমরা যদি এভাবে নিজেদের প্রস্তুত করি, তবে চাকরির বাজারে দক্ষ কর্মীর অভাব কখনো হবে না। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই দক্ষ ও কর্মঠ লোকের চাহিদা থাকে।