উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রযুক্তি নির্ভর শিক্ষার মানোন্নয়নে কাজ করতে চাই
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। বর্তমানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠন ইউনিভার্সিটি টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইউট্যাব) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সম্প্রতি তাকে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। আজ রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) থেকে পরবর্তী চার বছর জন্য এই দায়িত্ব পালন করবেন তিনি। দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনের হালচাল ও পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের নানা দাবি এবং বাউবিতে আগামীর পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। গল্প-আলাপে পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন ইরফান এইচ সায়েম—
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সম্প্রতি বাউবির উপাচার্য হিসেবে আপনি নিয়োগ পেয়েছেন। আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাই?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: বাউবির উপাচার্য হিসেবে আমাকে দায়িত্ব দেওয়ার জন্য বর্তমান সরকারকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। রাষ্ট্র মেরামতের অংশ হিসেবে সরকার আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছেন এটি তার একটি অংশ। আমি এখনও এই বিশ্ববিদ্যালয়টির দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। দায়িত্ব গ্রহণ করলে বুঝতে পারবো আমাকে কি কি করতে হবে। তবে বাউবি যে উদ্দেশ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল, সেটি ধরে রাখতে চেষ্টা করবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দায়িত্ব গ্রহণ পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: বিগত সময়ে শুনতাম উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় সার্টিফিকেট দেওয়ার একটি কেন্দ্র। কেউ লেখাপড়া শেখেনি, লেখাপড়া থেকে বঞ্চিত তাদের দূরশিক্ষণ থেকে পড়াশোনার সুযোগ দিতেই এটির যাত্রা শুরু। তার মানে এই নয় যে, নকলকে উৎসাহিত করা, পরীক্ষার হলে গেলেই পাস— এটা শিক্ষার মান উন্নত করতে পারে না।
আগের সরকার যেমন জিপিএ-৫ দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করেছে এবং নকল মুক্ত পরীক্ষা তৈরি করতে পারেনি; নকলে সব সয়লাব হয়ে গেছে, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়েরও একই অবস্থা। যাদের অষ্টম শ্রেণি পাশেরও যোগ্যতা নেই তাদের উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে এনে সার্টিফিকেট দিয়ে দেওয়া হতো। এর মাধ্যমে শিক্ষার মান কখনও উন্নত হতে পারে না।
শিক্ষা মানেই ‘ট্রান্সফার অফ নলেজ’ বা ‘জ্ঞানের বিতরণ’— সেটা এখানে হয় না, এখানে সার্টিফিকেটের নামের কাগজ দেওয়া হয় যা রুটি-রুজির সংস্থান করে মাত্র। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের মানোন্নয়নের জন্য অবশ্যই নকলমুক্ত পরিবেশ তৈরি করবো। তাদের লেখাপড়া শিখতে হবে, লেখাপড়া না শিখে এবং জ্ঞান অর্জন না করে সার্টিফিকেট পাওয়ার কোনো মানে হয় না।
উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় যে মিশন নিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল— তা ধরে রাখতে চেষ্টা করবো। সেজন্য বৈশ্বিক মানদণ্ড মেনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করবো। এছাড়া যে প্রজেক্টগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে সেগুলো আবার চালু করতে হবে। যেন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শিক্ষার মানোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারে। আমি শুধু সার্টিফিকেট বিতরণের পক্ষে না— শিক্ষার মানোন্নয়নের পক্ষে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাউবির পূর্বের প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন ধরনের অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এসব বিষয়ে তদন্তমূলক কোনো ব্যবস্থা নেবেন কি না?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: গত সরকারের সময় অনিয়মগুলোকে তারা নিয়মে পরিণত করেছিলেন। যত অন্যায় অপকর্মকে তারা নিয়মে পরিণত করেছিল। বাউবি প্রশাসনে আগে যারা ছিলেন, তারা যদি ভালো কেউ থেকে থাকে তাদের স্বাগত জানাবো। আর কেউ যদি খারাপ কাজ করা থাকে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে কাজ করবো কিংবা তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আওতায় আনার চেষ্টা করা হবে।
কেউ যদি অন্যায় করে পার পেয়ে যায় আগামীদিনে আরও উৎসাহিত হবে। দল, মতের ঊর্ধ্বে আমরা দক্ষ প্রশাসক চাই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ প্রশাসক দিয়ে পরিচালিত করে সমাজের উন্নতি করা যায়। বসে বসে বেতন নেওয়া এবং সার্টিফিকেটে সই করে টাকা নেওয়া এসব যেন না হয়— তা নিশ্চিত করবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমানে শিক্ষক সমাজ নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায় কী?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে আমাদের যে মর্যাদা পাওয়ার কথা, বর্তমানে সেই মর্যাদায় আমরা নেই। আমরা দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির জন্য সঠিক কথা বলা ভুলে গেছি। অনেক শিক্ষক উপাচার্য হওয়ার পর আত্মীয় স্বজনের চাকরি দেওয়ার লোক হিসেবে পরিণত হন। এটি যদি কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যের মূল উদ্দেশ্য হয় তাহলে আমি মনে করি তার ‘কন্ট্র্যাক্টর’ হওয়া উচিত। আমি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় তাদের যে কর্মকাণ্ড দেখেছি, সেগুলো দেখে আমার লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে আসে।
আরো পড়ুন: সাবেক চেয়ারম্যানসহ ইউজিসির ১৩ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এআইইউবি শিক্ষার্থীর মামলা
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে দাবি তুলছেন। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিকাশে রাজনীতির বাইরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর করণীয় কি?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: ছাত্ররা আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করবে। যদি আজকে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে দেশটি নেতৃত্বহীন হয়ে যাবে। ডাকসু নির্বাচন এবং বাংলাদেশের সকল ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। এটি বন্ধ হলে সে পথ রুদ্ধ হতে পারে।
ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতি দুটোই থাকবে। তা যেন লেজুড়বৃত্তিক না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাজনীতি একটি ভালো বিষয়— এটি সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে, মানুষকে পরোপকারী করে, ভালো কাজকে তারা গ্রহণ করে। আমাদের সমাজটা এমন হয়েছে, আমরা খারাপটাকে আগে গ্রহণ করি। গত ১৭ বছরে অনিয়মটা নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমি দেখেছি নিয়মটাকে মানতে পারি না। এখানে অনিয়মটি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, মিথ্যাকে সত্য বানানো হয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: তাহলে শুদ্ধ রাজনীতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কিভাবে সম্পৃক্ত করা যায়?
অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম: খারাপ কাজ করতে করতে আমাদের ভেতরটা পুরো ক্যান্সারের মতো হয়েছে। সেখান থেকে মানুষ রাজনীতি বিমুখ হতে চাই। কিন্তু আমি মনে করি আমাদের রাজনীতি শুদ্ধ করার দাবি তোলা উচিত। রাজনীতি ছাড়া মানুষের চিন্তা চেতনার মুক্তি মিলবে না। খারাপ মানুষগুলো সামনে আসবে। বর্তমানে সমাজে এবং ক্যাম্পাসগুলোতে যে রাজনীতি আছে তা কলুষিত; এটি বাদ দিয়ে মুক্ত এবং শুদ্ধ রাজনীতি করতে হবে। রাজনীতিতে যেন দুর্বৃত্তায়ন না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে এবং খারাপ মানুষগুলো যাতে রাজনীতিতে না আসে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।