১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:০০

শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে ভিসিদের ভিশন থাকতে হবে

ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ  © টিডিসি ফটো

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) ষষ্ঠ চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৬তম উপাচার্য। দীর্ঘ সাত বছর সফলতার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। সর্বশেষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক সংস্থা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। এরপর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার পরিবেশ ফিরিয়ে আনা এবং শিক্ষার্থীদের যুগোপযোগী ও আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে কীভাবে গড়ে তোলা যায়- তা নিয়ে পরিকল্পনা কষছেন। সম্প্রতি দেশের উচ্চশিক্ষাঙ্গনের পড়াশোনা, পরিবেশ, শিক্ষার্থীদের নানা দাবি এবং আগামীর পরিকল্পনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে। গল্প-আলাপে পাঠকদের জন্য তার চুম্বক অংশ তুলে ধরছেন সিনিয়র রিপোর্টার শিহাব উদ্দিন। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান, এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, এখন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান, কোন পদটি আপনার কাছে বেশি স্বাচ্ছন্দ্যের মনে হচ্ছে?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: খুব সম্ভবত আমি পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সর্বকনিষ্ঠ চেয়ারম্যান ছিলাম। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। আমি কোনো পদের জন্য কখনো তদবির করিনি। যারা কোনো পদে বসার জন্য তদবির করে, আমি মনে করি- তাদের সে আসনে বসার যোগ্যতা নেই। দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি। যারা দেশের সেবা করবে। পরবর্তীতে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হলাম তখন অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। বিশেষ করে ওয়ান ইলেভের পর চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি ছিল। তবে আমি তা উপভোগের চেষ্টা করেছি। দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে কাজ করেছি। 

ইউজিসির সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ চেয়ারম্যান সম্ভবত আমিই। এখানেও কাজ করতে ভালো লাগছে। আমাদের মানসম্পন্ন শিক্ষা দরকার। এটা আমাদের নতুন দেশ। এত শিক্ষার্থী মারা গেছে, আহত হয়েছে, তবুও তারা দমে যাননি। তরুণদের এমন সাহস দেখে সত্যি অবাক হয়েছি। শিক্ষার্থীদের প্রতি সম্মান রেখে শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করার চেষ্টা করব। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক নিয়োগ রাজনৈতিক বিবেচনায় হয় বলে অভিযোগ শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের। সাংবাদিকদের অনুসন্ধানেও তাই দেখা যায়। এ অভিযোগ থেকে বের হতে ইউজিসি কোনো উদ্যোগ নেবে কিনা? 

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: যারা লবিং করে নিয়োগ পেতে চান, তাদের কোনো ভাবেই উপাচার্য কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন, এমন শিক্ষক-প্রশাসকদের আমাদের খুঁজে বের করে আনতে হবে। শিক্ষা ও গবেষণার মান উন্নয়নে ভিসিদের মধ্যে ভিশন থাকতে হবে। আপনি যে কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী হতে পারেন। তাতে কারো কোনো আপত্তি নেই। তবে আপনি চেয়ারে বসার পর আপনার রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতিফলন যেন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দলমতের ঊর্ধ্বে গিয়ে শিক্ষার্থীদের শিক্ষার্থী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নিজের বিবেকের কাছে জবাবদিহিতা করতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হল খুলে দেওয়া হয়েছে। তবে একাডেমিক কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি। একাডেমিক কার্যক্রম শুরুর ক্ষেত্রে ইউজিসি কোনো ভূমিকা রাখবে কিনা?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: গণঅভ্যুত্থানের সময় তরুণরা যেভাবে আন্দোলনে যুক্ত ছিল, সেটি পুরোপুরি ব্যক্ত করার ভাষা আমার জানা নেই। তাদের আত্মত্যাগের কারণেই আমরা নতুন বাংলাদেশ পেয়েছি। এখন ছাত্র-ছাত্রীদের ক্লাস শুরুর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে হবে। শিক্ষার্থীরা হলে থাকছে, ফলে শিক্ষা কার্যক্রমও খুব দ্রুত শুরু হতে যাচ্ছে বলেই আমার মনে হয়। তবে আমাদের তাড়াহুড়ো করা যাবে না। আবার খুব বেশি দেরিও করা যাবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি লাঘবে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়। এ পদ্ধতিতে দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় আসলেও বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও আসেনি। নতুন বাংলাদেশে ভর্তি পরীক্ষাটা কেমন হবে? আগের পদ্ধতিতে সবাইকে যুক্ত করবেন, নাকি নতুন কোনো নিয়মে পরীক্ষা হবে? 

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: শিক্ষার্থীদের চাহিদা এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি খুব গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চিন্তাভাবনাও আমাদের শুনতে হবে। শিক্ষার্থী এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যেটি ভালো হয়, আমরা সেভাবেই এগিয়ে যাব।

আমাদের পরীক্ষা পদ্ধতির উদ্দেশ্যই হচ্ছে, যে বেশি মেধাবী তাকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া। এটি সবচেয়ে ভালোভাবে যাচাই করতে হবে। এজন্য আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ইউজিসিতে সদস্যরা যোগদানের পর ছাত্ররা যদি আলোচনায় বসে, তাহলে আমরা তাদের স্বাগত জানাব। সবার কথা শোনার পর আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া দরকার আমরা করব।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‍দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ প্রসঙ্গে আপনার অভিমত কী?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো করে চলার জন্য তাদের নিজস্ব আইন রয়েছে। দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন একজন উপাচার্য নিয়োগ হয়েছে। তিনি অনেক উচ্চ যোগ্যতাসম্পন্ন । আশা করছি, তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেবেন। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেক শিক্ষার্থী ও তার স্বজনেরা ট্রমায় কিংবা মানসিক অস্থিরতায় আছেন। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক ও সামাজিকভাবে করণীয় কী?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাত্র একমাস হয়েছে। শিক্ষার্থীরা একটা ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য শিক্ষার্থীদের প্রতি মনোযোগী হতে হবে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক খুব ভালো জায়গায় আসতে হবে। একইসঙ্গে শিক্ষার্থীদের অনুভূতিগুলো আমাদের ধারণ করতে হবে। তাদের চিন্তাভাবনা গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে। শিক্ষকরা পান্ডিত্য অর্জন করা অভিজ্ঞ, জ্ঞানী; আমাদের শিক্ষার্থীরাও কিন্তু জ্ঞানী। তাদের ভাবনাগুলো খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস:  বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনিক কাজে পুরোনো সনাতনী পদ্ধতির কারণে ভর্তি কার্যক্রম থেকে শুরু করে ফলাফল প্রকাশ এবং সনদপত্র দিতে ভোগান্তি ও সময় অপচয়ের কথা আমরা জানি। নতুন বাংলাদেশে কি এটি দূর হবে?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: এটি দূর করতে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সনাতনী পদ্ধতি থেকে বের হয়ে আসতে পারব বলে আমার মনে হয়। শিক্ষার্থীদের চাহিদাগুলোকে ধারণ করতে হবে। তবেই না নতুন বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

আরো পড়ুন: রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্লাস বন্ধ, ঘটনার নেপথ্যে

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মুক্তিযুদ্ধের পরে ও নব্বইয়ে স্বৈরাচার আন্দোলনের পরে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনকি প্রশাসনিক বিভিন্ন স্তরে ছাত্রনেতা ও সংগঠনের সঙ্গে অনেক শিক্ষকের শ্রদ্ধাপূর্ণ ও সহজ সম্পর্কের অবনতি ঘটে বলে শোনা যায়। তখনকার পত্রিকায় কিছু চ্যালেঞ্জের কথাও জানা যায়। এবার এমন একটি আন্দোলনের ও গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে মনোযোগী করতে চ্যালেঞ্জ আছে কিনা? থাকলে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পরিকল্পনা কী? 

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: নতুন বাংলাদেশে বিষয়গুলো নিয়ে সাবাইকে ভাবতে হবে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে দেশের উন্নয়নে এগিয়ে আসতে হবে। আমরা একটা ভিন্ন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এখানে শিক্ষার্থীদের জায়গা থেকে তাদের অবদান রাখতে হবে। একইসঙ্গে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে সমাজের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের শিক্ষার্থীরা সনদ নিয়ে বের হচ্ছে। কিন্তু মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন মানুষ ও দক্ষ কর্মী হিসেবে পরিণত হচ্ছে না বলে অভিযোগ নিয়োগকর্তাদের। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী? কী করতে পারে সরকার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকরা?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: বাংলাদেশের তরুণরা কী করতে পারে, তা সবাই দেখেছে। বিশ্ব এখন বাংলাদেশের তরুণদের আইডল হিসেবে দেখছে। কাজেই আমি আমাদের তরুণদের নিয়ে খুবই আশাবাদী। তারা ভালো করছে, ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে বলেই আমার মনে হয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষা, গবেষণা, শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা ও উদ্যোগে দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আপনার। কোন দর্শন ও ভিশন নিয়ে এগিয়ে যেতে চান? কোন বিষয়গুলো সংস্কারে ও গঠনে অগ্রাধিকার?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: আমি যেটা ভাবছি, সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। অন্যরা কী ভাবছেন, সেটা আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে। একে অপরের কাছ থেকে জানতে হবে, শিখতে হবে। সবার প্রত্যাশা ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইউজিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ অনেকদিনের। যে কারণে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েও সুশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। এ ক্ষেত্রে কী ব্যবস্থা নেবেন?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: পিএসসি কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন আমি কখনো অন্যায়ের সঙ্গে আপস করিনি। ইউজিসিতেও করব না। ইউজিসির কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠলে সেটি তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: করোনার সময় অটোপাসের রেফারেন্স টেনে সে ব্যাচগুলোর অনেক শিক্ষার্থীর মধ্যে কোর্স শর্টকাট, সিজিপিএ বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কিছু দাবি উঠছে কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিন্তু এতে শিখন ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা শিক্ষকদের। বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: করোনার মধ্যে আমাদের বেঁচে থাকাই চ্যালেঞ্জের ছিল। ফলে তখন অটোপাস দেওয়ার যুক্তিযুক্ত কারণ রয়েছে। তবে এখন যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো, সেটি নেওয়ার আগে আমাদের আরও চিন্তাভাবনা করার দরকার ছিল। তবে এটিও মাথায় রাখতে হবে, সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর তা আর তুলে নেওয়া কঠিন। কাজেই যা হয়েছে, সেটি সময়ের বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকেও ধন্যবাদ।