কৃষি অর্থনীতিবিদ ড.মো.মিজানুল হক
ফলের উৎপাদন বেশি মানেই কৃষির উন্নতি নয়
কৃষিতে বাংলাদেশের তাৎপর্যময় সাফল্য নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। কৃষির উৎপাদন ভালো হলে জাতীয় অর্থনীতি যেমন হয়ে ওঠে সবল ও সমৃদ্ধ ঠিক তেমনি কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশে নেমে আসে অভাব ও দুর্যোগ। কৃষির উন্নতি একটি বিস্তর বিষয়। যেখানে উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ প্রতিটি বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু কৃষির উন্নতি বলতে আমরা সাধারণত উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধিকেই বুঝি। যার ফলে দেশের মাথাপিছু আয় প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পেলেও ঠিক সেই অনুপাতে বাড়েনি কৃষকদের জীবনযাত্রার মান। সম্প্রতি কৃষির এদিক সেদিক নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সাথে কথা বলেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) এগ্রিবিজনেস ম্যানেজমেন্ট অনুষদের ডীন কৃষি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড.মো.মিজানুল হক কাজল। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন শেকৃবি প্রতিনিধি আরাফাত রহমান অভি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দেশের অর্থনীতিতে কৃষির ভূমিকা কতটুকু ?
ড.কাজল: দেশের অর্থনীতি ও কৃষির সম্পর্ক অনেকটা প্রদীপ ও জ্বালানির মত। কৃষির উন্নতির সাথে সাথে জাতীয় অর্থনীতি যেমন হয়ে ওঠে সবল ও সমৃদ্ধ হয়ে তেমনি কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশে নেমে আসে অভাব ও দুর্যোগ। বর্তমানে জিডিপিতে কৃষির অবদান ক্রমশ নিম্ন গামী দেখা গেলেও অন্যান্য খাতের উন্নতি নির্ভর করে কৃষির ওপর। তাই প্রত্যক্ষ ভাবে না হলেও এখনও পরোক্ষভাবে কৃষিই বাংলার অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের দেশের কৃষির প্রধান সমস্যা কি বলে আপনি মনে করেন ?
ড. কাজল : কৃষির উৎপাদন ও গবেষণার দিক থেকে আমরা অনেক এগিয়ে গেছি। তবে কৃষির উন্নতি বলতে শুধু আমরা উৎপাদন বৃদ্ধিকে বুঝি। তবে কৃষির উন্নতি বলতে উৎপাদন থেকে শুরু করে প্রক্রিয়াজাতকরণ, সংরক্ষণ ও বাজারজাতকরণ প্রতিটি বিষয়েই উন্নতিকে বুঝায়। সেই দিক থেকে আমাদের কৃষির সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজারজাতকরণ। সরকার কৃষি খাতকে তরান্বিত করার জন্য বিনামূল্যে সার,পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ, রোগ মুক্ত বীজ সরবরাহ করার চেষ্টা করছে কিন্তু অব্যবস্থাপনার বেড়াজাল থেকে কোনভাবেই বের হতে পারছে না কৃষি পণ্যের বাজার ব্যবস্থাপনা। কৃষির বাজার ব্যবস্থাপনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ট্রাক ভর্তি করে আসা পণ্য বিক্রি করতে হয় স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে। এর জন্য দালালদের কমিশনও দিতে হয়। কমিশনের টাকা ব্যাপারীরা তুলে নেয় খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে। খুচরা বিক্রেতারা ওই দামের ওপর ৮-১০ টাকা মুনাফা ধরে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে। মাঝে মধ্যেই যখন দেশের উত্তপ্ত সবজি বাজার ঘামিয়ে তুলে সাধারণ ক্রেতাদের ঠিক সেই সময় ওই উত্তাপের হাসি হাসতে পারেন না এদেশে সবজি উৎপাদনকারী প্রান্তিক কৃষকরা। সবজি চাষের প্রধান প্রধান এলাকা থেকে পাওয়া তথ্য এবং রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে উৎপাদন ও খুচরা পর্যায়ের দামের মধ্যে দেখা যায় বিস্তর ফারাক। ক্রেতাদের কাছে নানা অজুহাতে পাইকারি ও খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা পকেট কাটলেও ন্যায্য দাম থেকে বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছে প্রান্তিক কৃষকরা। আড়তদারসহ বিভিন্ন মধ্য স্বত্বভোগী সকলেই অধিক মুনাফালোভী যার ফলে কৃষক যেমন তার ন্যায্য দাম পাচ্ছে না ঠিক একইভাবে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ ক্রেতারা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস : কৃষির বাজার ব্যবস্থাপনার এমন সমস্যা সমাধানে করণীয় কি?
ড. কাজল : প্রথমত কোন সমস্যা সমাধানের জন্য চাই সদিচ্ছা। আমাদের দেশে আইনের কোন অভাব নেই। তবে সেটার বাস্তবায়ন অনেক কম। তাই প্রথমত নিজের ইচ্ছাকে ঠিক করতে হবে। এরপর যেটা দরকার তা হল আপনি সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব কার ওপর দিচ্ছেন। অবশ্যই যে যেই বিষয়ে বিজ্ঞ, দায়িত্ব তার কাছেই আপনাকে হস্তান্তর করতে হবে। এদিক থেকে আমরা এখন অনেক পিছিয়ে আছি। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের নতুন নতুন উদ্ভাবনের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন না থাকলেও কৃষি বিপণি কর্মকর্তাদের অনভিজ্ঞতা এবং কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে পারদর্শী এমন লোকবলের অভাবই এই সমস্যার উল্লেখযোগ্য কারণ। ফলে এই জায়গাগুলোতে উপযুক্ত লোকবল নিয়োগ অতীব জরুরী। আপনারা দেখবেন দ্রব্য মূল্য বেড়ে গেলে রাজপথে নামে জনগণ। ব্যবসায়ীদের দাবী আদায়ে তো অনেক আগে থেকেই গড়ে উঠেছে নানা ব্যবসায়ী সংগঠন, এদিকে মাঠ পর্যায়ে পাইকার এবং ফড়িয়াদের রয়েছে শক্ত সিন্ডিকেট। কিন্তু বাংলার কৃষকদের, না আছে তাদের কোন সিন্ডিকেট না আছে তাদের দাবী আদায়ে কার্যকারী কোন সংগঠন। যার ফলশ্রুতিতে মধ্য স্বত্বভোগীদের যাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছে মাটিতে সোনা ফলানো এই প্রান্তিক কৃষকরা।
কৃষি পণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ এবং কৃষিকে ভবিষ্যততে আরও তরান্বিত করতে সরকারের সঠিক বাজার পর্যবেক্ষণ, ক্রেতা বিক্রেতাদের মধ্যে সমন্বয় এবং কৃষি বিপণিতে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতক অর্জনকারীদের নিয়োগ যেমন সুনিশ্চিত করতে হবে, ঠিক তারই সাথে প্রান্তিক পর্যায়ে গড়ে তুলতে হবে কৃষক সিন্ডিকেট। তা না হলে দেশের সাধারণ জনগণ যেমন দুর্ভোগে পড়বে ঠিক তেমনি ভাবে অন্ধকারে নিমজ্জিত হবে দেশের কৃষি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস : স্যার আপনাকে ধন্যবাদ ।
ড. কাজল : আপনাদের জন্যও শুভকামনা রইল।