বিস্তৃত চাকরির বাজার মার্কেটিং গ্র্যাজুয়েটদের, সুযোগ আছে পিএইচডিধারীরও
চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগে মার্কেটিং এর প্রভাষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন মো. বাইজীদ আহম্মেদ রনি। বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন তিনি। মার্কেটিংয়ের বিভিন্ন জানা-অজানা বিষয় নিয়ে সাক্ষাৎকার নিয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। তার কথাগুলো শুনেছেন এস এম মানজুরুল ইসলাম সাজিদ।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং-এর শিক্ষক হিসেবে আপনার অনুভূতি কেমন?
বাইজীদ আহম্মেদ: শিক্ষকতা এবং মার্কেটিং দুটোই আমার প্রিয়। শিক্ষকতা আমার প্যাশন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার জন্য ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হওয়া গ্রাজুয়েটদের স্বপ্ন থাকে। আমি বিবিএ এবং এমবিএ-তে ১ম স্থান অধিকার করে সরাসরি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার সুযোগ পেয়েছি বলে আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। শিক্ষা জীবনে সব সময় শিক্ষার্থীদের নিয়ে কাজ করার স্বপ্ন দেখতাম, এখন তা বাস্তবে পরিণত হয়েছে এবং দায়িত্বও অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছি, সামনের সময়গুলোতে আমার শিক্ষার্থীরা ভালো অবস্থানে গেলে আমি সবচেয়ে খুশি হবো। শিক্ষার্থীদের সফলতাই আমার সফলতা।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিং বিষয়টি কী, এ বিষয়ের প্রয়োজনীয়তা কী?
বাইজীদ আহম্মেদ: পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার পূর্বে কিছু কাজ যেমন: বাজার গবেষণা এবং পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে ক্রেতার নাগালে পণ্য বা সেবা পোঁছে দিতে গিয়ে যে সকল কাজ করতে হয় যেমন: প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট, লেভেলিং, প্যাকেজিং, পণ্য গুদামজাতকরণ, পণ্য সরবরাহ, কাস্টমারের সামনে উপস্থাপন ইত্যাদির পারস্পরিক প্রক্রিয়াই হলো মার্কেটিং।
মার্কেটিং(বিপণন) না জানলে ভোক্তার চাহিদা জানা যাবে না, চাহিদা না জানা গেলে পণ্যের পরিমিত জোগান নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না। মার্কেটিং ছাড়া ক্রেতার সন্তুষ্টি নিশ্চিত করার যে প্রক্রিয়া সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এক কথায় পণ্য বা সেবা উৎপাদনের আগে মার্কেটিং এর কাজ শুরু হয় এবং পণ্য বা সেবা ভোগ করার পরেও মার্কেটিং এর কার্যক্রম চলমান থাকে। তাই মার্কেটিং বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিং পড়তে চাইলে শিক্ষার্থীদের কেমন যোগ্যতা থাকা দরকার?
বাইজীদ আহম্মেদ: আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে একজন শিক্ষার্থী উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায় শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় সন্তোষজনক নম্বর নিয়ে বিবিএতে ভর্তি হতে পারে। বিবিএ পড়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞান, ব্যবসায় শিক্ষা এবং মানবিকের শিক্ষার্থীরা সুযোগ পাবে।
তবে ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র-ছাত্রীদের আসন অপেক্ষাকৃত বেশি থাকে। বিবিএ প্রোগ্রামে চান্সপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা মেজর হিসেবে মার্কেটিং বিষয় বেছে নিতে পারবে। এক্ষেত্রে যে সকল শিক্ষার্থী পরিশ্রম করতে সক্ষম, মানুষের সাথে সহজেই মিশতে পারে, যাদের চ্যালেঞ্জ নেয়ার মতো মানসিকতা আছে, যারা সৃজনশীল চিন্তা ভাবনার অধিকারী, যারা কর্মদক্ষ এবং চটপটে তাদের জন্যই মার্কেটিং বিষয়টি উপযুক্ত।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দেশের কোন কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং পড়ানো হয়?
বাইজীদ আহম্মেদ: প্রায় সকল সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ অধিকাংশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিষয়টি পড়ানো হয়। এছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও মার্কেটিং বিষয়টি পড়ানো হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিংয়ে কী কী বিষয় পড়ানো হয় বা শিক্ষার্থীরা কী শিখতে পারবে?
বাইজীদ আহম্মেদ: যে সকল শিক্ষার্থী তাদের মেজর মার্কেটিং নেয় তারা প্রায় ৪০টি থেকে ৪৪টি বই পড়ে থাকে। এর মধ্যে প্রিন্সিপালস অব মার্কেটিং, মার্কেটিং ম্যানেজমেন্ট, কনজিউমার বিহেভিয়ার, রিসার্চ মেথডোলজি, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট, সাইকোলজি, ম্যাথমেটিক্স, ইনট্রোডাকশন টু বিজনেস, সার্ভিস মার্কেটিং, ট্যুরিজম, স্ট্রাটিজিক মার্কেটিং, কম্পিটিটিভ অ্যানালাইসিস, ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য। মার্কেটিং বিষয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা উদ্যোক্তা হতে যে জ্ঞান প্রয়োজন তা পাবে। শিক্ষার্থীরা ভোক্তা সন্তুষ্টির বিভিন্ন কলাকৌশল শিখবে, ব্যবস্থাপকীয় গুণাবলি অর্জন করতে সক্ষম হবে। সর্বোপরি নিজেকে একজন স্মার্ট মানব সম্পদ হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে সক্ষম হবে। তবে এসকল গুনাবলি অর্জনের জন্য তাকে পরিশ্রম করতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিংয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের চাকরি ও কর্মসংস্থান কোথায় হবে?
বাইজীদ আহম্মেদ: মার্কেটিং গ্রাজুয়েটদের জব ক্ষেত্র বিস্তৃত। মার্কেটিং এর শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান সহ দেশীয় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে প্রোডাক্ট ডেভলাপমেন্ট বিভাগ, ব্রান্ড ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, পাবলিক রিলেশন বিভাগ, কাস্টমার সার্ভিস বিভাগে কাজের সুযোগ পায়, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংকে মার্কেটিং গ্রাজুয়েটদের সুযোগ অনেক বেশি। এছাড়া মার্কেটিংয়ে পড়ে অনেককেই সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশাতেও কাজ করতে দেখা যায়। বেসরকারি চাকরির পাশাপাশি মার্কেটিং পড়ে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির জন্যও নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে যেমন: ইপিজেড এর যে নিয়োগ হয় সেখানে সহকারী পরিচালক(বাণিজ্য) তে মার্কেটিং এর শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবে। তাই মার্কেটিংয়ে পড়ে শিক্ষার্থীরা সরকারি এবং বেসরকারি উভয় চাকরিতেই সুযোগ পাবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিংয়ে পড়াশোনার খরচ কেমন?
বাইজীদ আহম্মেদ: সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মার্কেটিং বিষয়ে বিবিএ এবং এমবিএ প্রোগ্রামে খুব অল্প খরচে পড়া যায়। প্রতি সেমিস্টারে কয়েক হাজার টাকা রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েই লেখাপড়া চালানো যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে টাকার অঙ্ক কম বেশি হয়। তবে খুবই সামান্য খরচ। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু ব্যক্তি মালিকানাধীন তাই সেখানে খরচ অপেক্ষাকৃত বেশি হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিংয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন?
বাইজীদ আহম্মেদ: মার্কেটিং গ্রাজুয়েটরা বিবিএ ও এমবিএ প্রোগ্রাম শেষ করে দেশে এবং দেশের বাইরে পিএইচডির মতো গবেষণাধর্মী ডিগ্রিতে ভর্তি হতে পারে। তাই গবেষণার সুযোগও এই বিষয়ে রয়েছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিং বিষয়ের উপর গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নে কী ধরনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে মনে করেন?
বাইজীদ আহম্মেদ: গুণগত শিক্ষা বাস্তবায়নের প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সংযোগ এর অভাব। আমরা যা শেখাচ্ছি এবং ইন্ডাস্ট্রিতে যা অনুশীলন হচ্ছে তার সমন্বয় প্রয়োজন। তাহলে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই দক্ষ হয়ে বের হবে। মার্কেটিং এর গ্রাজুয়েটরা শুধুমাত্র বই পড়ে ভালো করতে পারবে না, তাদের সফট স্কিল প্রয়োজন। সফট স্কিল বাড়ানোর জন্য শিক্ষার্থীদের পরিশ্রম করতে হবে। যেহেতু সফট স্কিল এর জন্য কোন নাম্বার বরাদ্দ নেই তাই অনেকেই আগ্রহী হয় না। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্য বিভিন্ন দক্ষতার বিকল্প নেই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মার্কেটিংয়ের চাকরি পেতে হলে লেখাপড়া পাশাপাশি একজন শিক্ষার্থীর কী করতে হবে?
বাইজীদ আহম্মেদ: মার্কেটিংয়ের চাকরি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই মার্কেটিং এবং সেলস এর পার্থক্য বুঝতে হবে। আমাদের দেশে সেলসকে আমরা মার্কেটিং বলে গুলিয়ে ফেলি। মার্কেটিং এবং সেলস এর কাজ আলাদা। মার্কেটিং এর কাজ হলো ক্রেতার নিকট পণ্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলা আর সেলিং হলো পণ্য বিক্রয় করা। মার্কেটিং প্রকৃতপক্ষে ক্রেতার সাইকোলজি নিয়ে কাজ করে। তাই মার্কেটিং করতে হলে একজন মার্কেটারকে হতে হবে অত্যন্ত দক্ষ এবং স্মার্ট। মানুষের পকেট থেকে টাকা বের করা সহজ কাজ নয় এজন্য মার্কেটিং এ মেধাবীদের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। চাকরির সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জব হয় মার্কেটিং সেক্টরে। তবে বেতন নির্ভর করে চাকরি প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং দক্ষতার উপর ।
মার্কেটিং ক্যারিয়ারে একজন চাকরি প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতার পাশাপাশি প্রার্থীর যে-সব গুণাবলি অবশ্যই যাচাই করা হয় তা হলো- প্রার্থী কতটা হাসিখুশি ও পোশাক-পরিচ্ছদে স্মার্ট, ব্যক্তিত্ব ও রুচিবোধ ফুটিয়ে তুলতে পারেন কিনা, কথাবার্তায় চটপটে স্বভাবের কিনা, গুছিয়ে কথা বলতে পারেন কিনা, বাচনভঙ্গি, উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা, সহজে যেকোনো মানুষের সঙ্গে মিশতে পারার ক্ষমতা, যেকোনো পরিবেশ-পরিস্থিতিতে অতি দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারার ক্ষমতা, মানুষকে বুঝানোর বা যুক্তি দাঁড় করানোর ক্ষমতা, দ্রুত শিখে নেওয়ার মানসিকতা কতটুকু, দেশের যেকোনো প্রান্তে কাজ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত কিনা, রসবোধ আছে কিনা ইত্যাদি।
পাশাপাশি প্রথম দর্শনেই প্রার্থীকে আত্মবিশ্বাসী মনে হয় কিনা, পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং বড় করে স্বপ্ন দেখতে পারেন কিনা তাও যাচাই করা হয়। শিক্ষাজীবন থেকেই এসকল সক্ষমতা অর্জনের জন্য মার্কেটিং বিষয়ের একজন শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনে কাজ করা উচিত, যোগাযোগের দক্ষতা বাড়াতে হবে, এছাড়াও শিক্ষানবিশ হিসেবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিপণন কর্মী হিসেবে কাজ করেও নিজের আগ্রহের জায়গাটি সম্পর্কে ধারণা নেওয়া যেতে পারে, নতুন কাজ শেখার আগ্রহ তৈরি করতে হবে, সব সময় আপডেট থাকতে হবে।