সাক্ষাৎকারে বুয়েট উপাচার্য
‘ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েট এখনও প্রথম’
- ইরফান হক
- প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০১৮, ১১:০৫ AM , আপডেট: ২৭ অক্টোবর ২০১৮, ০২:১৭ AM
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম। বুয়েটে তিনি চার দশকেরও বেশি সময় বুয়েটে শিক্ষকতা করছেন। ২০১৬ সালের ২৩ জুন তিনি ৪ বছরের জন্য বুয়েটের ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। বুয়েটের নানা দিক নিয়ে নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
টিডিসি: বুয়েটের ইতিহাস সম্পর্কে কিছু বলবেন?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: ১৮৭৬ সালে ঢাকা সার্ভে স্কুল নামে যাত্রা শুরু করে বুয়েট। পরবর্তী সময় ১৯১২ সালে আহসানউল্লাহ স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং নামে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষালয় হিসেবে এটি প্রসার লাভ করে। তৎকালীন নবাব আহসানউল্লাহ এটার জায়গা দেন এবং তার অবদানে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর ১৯৪৭ সালে এটি আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হিসেবে যাত্রা শুরু করে। পাকিস্তান আমলে ১৯৬২ সালে এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করে নাম দেওয়া হয় পূর্ব পাকিস্তান প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর এর নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম, অর্থাৎ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) রাখা হয়। সেই থেকে বুয়েট এগিয়ে চলেছে, রয়েছে বিভিন্ন অর্জন। এটি প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
টিডিসি: প্রকৌশল শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বুয়েটের অবদান কেমন?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: বুয়েট হচ্ছে ‘দি প্রিমিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটি’ অর্থাৎ দেশের ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল, এখনও আছে। ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে একমাত্র ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটি ছিল বুয়েট। এরপর দেশের আরও চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনির্ভাসিটি (কুয়েট+রুয়েট+চুয়েট+ডুয়েট) প্রতিষ্ঠিত হয়। এরপর আরও সর্বসাকুল্যে ৪৪টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, এসব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে। কিন্তু বুয়েট শুধু ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায়। আজ অবধি দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রথমে রয়েছে বুয়েট। এর একটা বড় কারণ হচ্ছে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থী এখানে পড়ান এবং পড়ে।
টিডিসি: প্রতি সেশনে কত শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পেয়ে থাকে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: বুয়েটে দেশের সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভর্তি হয়ে থাকে। এবার আমরা ১২ হাজার শিক্ষার্থীকে ভর্তি পরীক্ষায় বসতে দিয়েছি। এদের মধ্য থেকে ১ হাজার ৫০ জনকে ভর্তির জন্য সুযোগ দেওয়া হবে।
টিডিসি: শিক্ষা কার্যক্রমে নতুন পরিকল্পনা রয়েছে কি না?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: আমাদের ১৮টি টিচিং ডিপার্টমেন্ট এবং ১৬টি ডিগ্রী অ্যাওয়াডিং ডিপার্টমেন্ট রয়েছে। এসব আমাদের জন্য যথেষ্ট। আর নতুন বিভাগ খোলার আপাতত দরকার নেই। আমি মনে করি, নতুন বিভাগ খুললে শিক্ষার মান ভালো থাকবে না। নতুন কোনো ফিল্ড তৈরি হলে আগের সাবজেক্টগুলোতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে বলে মনে করি।
টিডিসি: বুয়েটে সেশনজট রয়েছে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: এখনও কিছু সেশনজট রয়েছে। তবে বেশি নয়। এটা দেশের রাজনৈতিক কারণে হয়ে থাকে। আমার সময়ে দুটি ঝামেলা হয়েছে। তবে আমরা যথেষ্ট চেষ্টা করেছি এসব থেকে বেরিয়ে আসার।
টিডিসি: ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন করা এ সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। সেক্ষেত্রে বুয়েটে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া কতটুকু লেগেছে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: বুয়েটের বিভিন্ন কর্মকান্ডে ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের ওয়েবসাইট আগের চেয়ে অনেক বেশি ডাইনামিক, রয়েছে উচ্চগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম। তাছাড়া আমাদের ভর্তি প্রক্রিয়া পুরোটাই অনলাইনে সম্পন্ন হয়। আমাদের শিক্ষকরা তাদের গবেষণার জন্য ‘প্রপোজাল’ অনলাইনে সম্পন্ন করে থাকে।
টিডিসি: বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অনুপাত কেমন?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: স্নাতকে পাঁচ হাজার এবং স্নাতকোত্তরে পাঁচ হাজারের মতো শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত ১ : ১২। আমাদের ৪৬৫ জন শিক্ষক রয়েছে। তবে বিদেশে পড়াশোনা করছে এরকম কিছু শিক্ষক রয়েছে। এসব মিলে সর্বমোট ৬০০ এর মতো হবে।
টিডিসি: শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটা কীভাবে করা হয়?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: যেসব শিক্ষার্থীরা প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয় তাদের আমরা শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে থাকি। পরে তারা স্কলারশিপ নিয়ে উচ্চতর ডিগ্রির জন্য বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমান। আমাদের জাপান, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের ডিগ্রিধারী শিক্ষক রয়েছেন। বর্তমানে ১০০ এরও বেশি শিক্ষক বিদেশে পড়াশোনা করছেন। তারা পড়াশোনা করে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসছেন। আবার অনেকে বিদেশ যাচ্ছেন।
টিডিসি: বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থীদের সংখ্যা কেমন?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: এক সময় নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মালেশিয়াসহ এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশ থেকে বুয়েটে পড়তে আসত। বর্তমানে এসব দেশে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে ওঠায় বুয়েটে পড়তে আসে না। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যেও এখন অত্যাধুনিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, এজন্য আসে না। এজন্য বিদেশি শিক্ষার্থী পাওয়া আমাদের জন্য কঠিন। তবে এটা হতে পারে যে, বিদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ‘একচেঞ্জ প্রোগ্রাম’ চালু করা যেতে পারে। এ বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও এ ব্যাপারে আন্তরিক।
টিডিসি: বুয়েটে যারা পড়তে আগ্রহী তাদের উদ্দেশে আপনার বার্তা কি থাকবে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: আমাদের শিক্ষার্থীদের বলা এবং লেখার দক্ষতাটা ধরে রাখতে হবে। দেশের বাইরে পড়তে গেলে প্রতিযোগিতা করে তাদের এগিয়ে যেতে হবে। তাছাড়া ওয়ার্ল্ড ক্লাস লিডার হতে যে গুণ দরকার তা নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে হবে। তাদের কালচারাল চিন্তার যাতে বিকাশ ঘটে সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে। আমি একজন শিক্ষক ও প্রকৌশলী, তবে আমার গানের প্রতি, সিনেমার প্রতি, ফটোগ্রাফির প্রতি আকর্ষণ থাকতে হবে। তাছাড়া পরস্পরের প্রতি সহানুভুতিশীল, সম্মানবোধ দরকার। আমরা অনেক সময় যান্ত্রিক হয়ে যাই, তাই এসব বিষয় খেয়াল রাখতে হবে।
টিডিসি: বৈশ্বিক র্যাঙ্কিংয়ে বুয়েটের অবস্থান কেমন?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: র্যাঙ্কিংয়ের অনেকগুলো ক্যাটাগরি রয়েছে। আমরা অক্সফোর্ড কিংবা ক্যামব্রিজের সমতুল্য হতে চাইলে সে পরিমাণ প্রচেষ্টা ও অর্থ প্রয়োজন রয়েছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় যে পরিমাণে স্কলারশিপ দেয় তা আমরা দিতে পারব না। র্যাঙ্কিংয়ের একটা বড় জিনিস বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটা দেশের বাইরে যেতে হবে। এটার অন্যতম একটা কারণ হচ্ছে বিদেশের শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসা। আমরা তো সেটা পারিনি। তবে যেভাবে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, সে দিন বেশি দূরে নয়। আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের স্কলারশিপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে পারব। তবে বৈশ্বিক র্যাঙ্কিং অনেকগুলো রয়েছে। আমাদের এ অঞ্চলে কিউএস র্যাঙ্কিং সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য রয়েছে। আমি ২ বছর আগে যখন ভিসি হিসেবে যোগ দিই, তখন এ অঞ্চলে আমাদের র্যাঙ্কিং ১৭৫ এর মতো ছিল, বর্তমানে ১৩৪ এ আমরা।
টিডিসি: সরকার যে বাজেট বরাদ্দ দেয় তা কি পর্যাপ্ত নাকি?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: আমাদের যে বাজেট বরাদ্দ দেওয়া হয় তার একটি বড় অংশ পেনশন ও বেতন-ভাতায় চলে যায়। তারপরও আগের অবস্থা থেকে এখন অনেক ভালো অবস্থানে রয়েছি আমরা। আমাদের আধুনিক গবেষণাগার-ক্লাসরুম রয়েছে। এতে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের হেকেপ প্রজেক্ট বেশি সহায়তা করেছে।
টিডিসি: গবেষণার জন্য কি ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে? কোনো সীমাবদ্ধতা রয়েছে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: বুয়েটে এক সময় গবেষণা অনেক কম হতো। ’৭০ দশকের দিকে গবেষণা করতে চাইলেও সম্ভব হতো না, সুযোগ-সুবিধা অনেক কম ছিল। তখন ইন্টারনেট ছিল না। বিদেশি জার্নাল কেনার মতো টাকাও ছিল না। আজকাল ইন্টারনেটের যুগ। সহজেই ইন্টারনেটে বসে নানা জ্ঞান আহরণ করতে পারছি। বাইরের বিভিন্ন কনফারেন্সে আমাদের শিক্ষকরা পেপার লিখছেন, অংশ দিচ্ছেন। এতে করে তাদের দক্ষতা আরও বাড়ছে। আমাদের শিক্ষার্থীরাও বিদেশের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করছে। তারা যখন বিদেশে গিয়ে নতুন জ্ঞান আহরণ করে আসছে, সেটা এখানে আমাদের কাজে লাগছে। তাই আমরা জ্ঞানের দিক থেকে অনেক সমৃদ্ধ। আমাদের শিক্ষকরা বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্সে যোগ দিয়ে অনেক সহযোগিতামূলক গবেষণা, কাজ করার সুযোগ আসছে। বিদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সঙ্গে সহযোগিতারও ইচ্ছা প্রকাশ করছে। মোট কথা, জ্ঞান আদান-প্রদানে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালগুলো আগ্রহ দেখাচ্ছে আর আমরাও সে সুযোগটা লুফে নিচ্ছি। আমাদের সুনামটা বাইরে পোঁছানোর কারণে এসব হচ্ছে।
টিডিসি: ক্যাম্পাসে সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা কেমন অংশগ্রহণ করছে?
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: টেকনোলজির শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকায় তারা সহ-শিক্ষা কার্যক্রমে কিছুটা হলে কম মগ্ন থাকে। তারপরও প্রায় বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এটি ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের দপ্তর বিষয়টি দেখে।
টিডিসি: আপনাকে ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম: আপনাকেও ধন্যবাদ।