শিখনের ঈদ নামাজ পড়ে রান্না করা, আশিকের ছুটির দিন যাবে আরামেই
বাংলাদেশে ঈদ মানেই শিক্ষার্থীদের দীর্ঘ ছুটি আর বাড়ি ফেরার পালা। ঈদুল আজহায় থাকে কোরবানির পশু কিনতে হাটে যাওয়া আর সেই পশুকে ঘিরে নানা খাতির-যত্নের আয়োজন। কিন্ত জীবনের তাগিদে আর উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা থেকে দূরদেশে পাড়ি জমানো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ঈদ কতটা আনন্দঘন? কিংবা কতটা মলিন? বিদেশে অবস্থানরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের ঈদ অনুভূতি জানাচ্ছেন তৌফিকুল ইসলাম আশিক।
সাউথ অস্ট্রেলিয়ার ফ্লিন্ডারস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আহসানুল আবিদ শিখন এবারের ঈদও কাটবে পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব ছাড়া। ঈদের দিন গ্রামের বাড়ি যাওয়া থেকে শুরু করে বন্ধুদের সাথে ঘুরতে যাওয়া, কোরবানির গরু কেনা, কোরবানি করা পর্যন্ত সাহায্য করা শিখনের এবারের দূর দেশে ঈদ পরিকল্পনা শুধু নামাজ পড়ে রান্না করা আর একটু ঘুরতে যাওয়া।
বিদেশের মাটিতে ঈদ অনুভূতি নিয়ে শিখন বলেন, সামনে হয়ত আগের মতো আনন্দঘন ঈদ উদযাপন করতে পারবো, সেই আশাতেই কষ্ট করে হলেও দিন গুনছি। এ দেশের মুসলিম কমিউনিটি কোরবানি করে। বুচার সপ, মসজিদ, মুসলিম কমিউনিটি সেন্টার অথবা কেউ কেউ খামারে গিয়ে তাদের পক্ষে কোরবানি করে থাকেন।
তিনি বলেন, আমি গতবছর এখানে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের সাথে ঈদ উদযাপন করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রদেশ ভিন্ন হওয়ায় এবার আর সময় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। তবে এখানের অনেক স্টুডেন্ট ও তাদের পক্ষে কোরবানিতে অংশ নিচ্ছে।
দেশে অবস্থানরত বন্ধুদের ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে শিখন বলেন, দেশে পরিবার বন্ধু বান্ধবদের কথা সবসময়ই মনে পড়ে। তাদের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলোও অনেক মিস করি। আমাদের এই ত্যাগগুলোও যেন কোরবানির মতোই হয়, এজন্য সবার কাছে দোয়া চাই।
এবারের ঈদ যুক্তরাজ্যের সাপ্তাহিক ছুটিতে (রবিবার) হওয়ার কারণে লন্ডন সাউথ ব্যাংক ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী শাখাওয়াত উল্লাহ আশিকের ঈদ একটু আরামেই কাটবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাংলাদেশের ট্র্যাডিশনাল পাঞ্জাবিতে নামাজ পড়ে এসে বোনের বাসায় অন্যান্য আত্মীয় স্বজনদের সাথে একত্রিত হয়ে সময় কাটানোই তার ঈদের দিনের পরিকল্পনা। আশিক জানান, আমাদের ঈদ মূলত একদিনই। পরের দিন থেকে সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।
কোরবানির বিশেষ স্মৃতি মনে করতে গিয়ে আশিক বলেন, কোরবানির ঈদে গরু কোরবানি দেয়াই সবচেয়ে বিশেষ স্মৃতি। ছোটবেলা থেকেই আব্বাকে সবসময় প্রেশার দেয়া হতো যেন ঈদের কয়েকদিন আগে গরু কেনা হয়। এরপরে গরুকে ঘিরেই যতো ব্যস্ততা। ঘাস, ভুসি খাওয়ানো, পানি পান করানো এসব জিনিস আমার কাছে খুবই স্পেশাল। শেষে ঈদের দিনে গরু কোরবানি দেয়ার পরে গরুর প্রতি মায়া থেকেই একটা খারাপ লাগা কাজ করতো।
দূরদেশে মা-বাবাকে সবচেয়ে বেশি মিস করবেন আশিক। এরপরে বেশি মিস করার পালা আসে মায়ের হাতের ফ্রেশ গরুর মাংস রান্না, তেলে ভেজে পরোটা দিয়ে খাওয়া। শাখাওয়াত উল্লাহ আশিক বলেন, পৃথিবীর সব মাংস একদিকে আর কোরবানির ঈদের গরুর মাংসের স্বাদ অন্যদিকে। তাছাড়া কোনো কারণ ছাড়া আব্বার বকা খাওয়া, বন্ধুদের সাথে বিকেলে সময় কাটানো অনেক বেশি মিস করব।
যুক্তরাজ্যে বাঙালি এলাকায় থাকায় বাঙালি কমিউনিটির আয়োজনে বিশাল করে পার্কে ঈদগাহের মতো করে নামাজের আয়োজন করা হয়। আশিকের মতে, নিজের দেশের সবাইকে একসাথে ঈদের দিনে দেখতে পেলে আলাদা একটা আনন্দ কাজ করে। ঈদ উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পার্কে বাচ্চাদের জন্য মেলার আয়োজন করা হয়।
ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়ে আশিক বলেন, সবাই আনন্দের সাথে পরিবার ও বন্ধু বান্ধবের সাথে ঈদ পালন করুক এটাই চাই। আল্লাহ সবার কোরবানি কবুল করুক। আর আমরা যারা বিদেশে ঈদ করি শুধু তারাই হয়তোবা উপলব্ধি করতে পারি, পরিবার ছেড়ে দূরে প্রবাসে ঈদ পালনের অনুভূতি কি! সারাজীবন হট্টগোল পরিবেশে পরিবার বন্ধুদের সাথে ঈদ করে, হঠাৎ একা একা ঈদ করা আসলেই কষ্টের। এইটুকুই চাই আল্লাহ সকলের আশা পূরণ করুক।
লিথুনিয়ার মিকোলাস রোমেরিস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী রিদিতা আমিনের ঈদ পরিকল্পনা নামাজ শেষে পরিবারের সাথে ভিডিও কলে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা। ঈদের বাকিটা সময় যাবে জবের পেছনেই। রিদিতার কাছে ঈদুল আজহার বিশেষ স্মৃতি বলতে নানুর বাড়িতে সবাই মিলে কোরবানির পশু কেনা এবং সেটা নিয়ে বাড়িতে আসা।
সকালে ঈদের নামাজের পড়ে কোরবানি দিয়ে মাংস ভাগ করে বিতরণ করাটা এখন কেবলই স্মৃতি রিদিতার কাছে। বিকেলে আত্মীয়-স্বজনদের বাড়ি বেড়ানোও ছিলো ঈদের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রিদিতার ঈদে সবচেয়ে মিস করার তালিকায় আছে পরিবারের সান্নিধ্য, মায়ের হাতের রান্না করা খাবার, সবাই মিলে একসাথে হয়ে নতুন ড্রেস পরা আর নামাজ শেষে ঈদ মোবারক বলে সবাইকে জড়িয়ে ধরা।
লিথুনিয়ায় ঈদ উদযাপন করা সম্পর্কে রিদিতা বলেন, এখানে আমি নতুন। তবে যতদূর জানি, এখানকার বাঙালি কমিউনিটি কোরবানি করে এবং একসাথে ঈদ উদযাপন করে। সবাই মিলে কোরবানি দেওয়ার পরে মাংস ভাগ করে নেয়া হয় এবং বিকেলে একসাথে খাওয়া-দাওয়াও করা হয়।
দেশে পরিবার, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয় স্বজনদের উদ্দেশ্যে ঈদ শুভেচ্ছা জানিয়ে রিদিতা বলেন, দেশের বাইরে থেকেও তোমাদের সাথে হৃদয়ের সম্পর্কে আছি। তোমাদের সবার জন্য অনেক ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা। ঈদটা তোমাদের সাথে কাটানোর সুযোগ না পেলেও, তোমাদের স্মৃতি সবসময় আমার সাথে আছে। দোয়া করি তোমরা সবাই ভালো থাকো এবং ঈদটা আনন্দময় কাটাও।
রিদিতার মতে, বিদেশে থাকা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ঈদ একটি মিশ্র অনুভূতির দিন। পরিবারের থেকে দূরে থাকা এবং দেশের বিশেষ দিনগুলোতে একাকিত্ব অনুভূত হওয়াই স্বাভাবিক। তবে, প্রবাসে থাকা অন্যান্য বাংলাদেশিদের সাথে মিলিত হয়ে সেই অনুভূতি কিছুটা হলেও ভাগাভাগি করা সম্ভব হয়। একসাথে নামাজ পড়া, খাওয়া-দাওয়া করা এবং আনন্দ ভাগাভাগি করে ঈদের দিনটা বিশেষ করে তোলার প্রয়াস থাকে সবারই।