শিক্ষার্থীদের চোখে স্মৃতির বৈশাখ

  © টিডিসি ফটো

কালের গহ্বরে হারিয়ে যাচ্ছে আরেকটি বাংলা বছর। নতুন সূর্যোদয়ে বর্ষপঞ্জিতে যোগ হবে নতুন পাতা, ১৪৩১ সন। পান্তা-ইলিশ, মঙ্গল শোভাযাত্রা কিংবা বৈশাখী মেলায় মাতবে বাঙালি নতুন বছর বরণে। পুরনো স্মৃতি আর নতুন বছর নিয়ে সবারই রয়েছে স্বপ্ন আর আশা। পহেলা বৈশাখ উদযাপন নিয়ে কয়েকজন তরুণ শিক্ষার্থীদের মতামত জানাচ্ছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানজিদ শুভ্র।

পহেলা বৈশাখ বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব
জীর্ণ-পুরোনোকে পেছনে ফেলে  নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের মাধ্যমে প্রত্যেক বাঙালি পালন করে নববর্ষ। তবে দিন বদলের সাথে সাথে নববর্ষ উদযাপনেও এসেছে ভিন্নতা। শৈশবে পহেলা বৈশাখকে ঘিরে কয়েক দফায় চলত প্রস্তুতি। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে অবগাহন শেষে নতুন পোশাক পরিধান করা হতো। পোশাকেও থাকত পহেলা বৈশাখের ছোঁয়া। ততক্ষণে সরষের তেলে ভাজা ইলিশের সুগন্ধে মহ মহ করত গোটা বাড়ি। রাতে ভিজিয়ে রাখা পান্তা ভাত সাথে মায়ের হাতের ইলিশ ভাজা, কাঁচা পেয়াজ ও একটি কাঁচা মরিচ দিয়ে শুরু হতো সকালের নাস্তা। যা শেষ হতো হরেক রকমের ফলমূল দিয়ে। দুপুর থেকে বিকেল অবধি দোকানে চলত হালখাতার আয়োজন। বিকেলে পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে কয়েকদিন ব্যাপি বৈশাখী মেলায় ঘুরাঘুরি করে মুড়ি-মুরকি কেনা এবং নাগরদোলায় চড়ার আনন্দ ছিল অভাবনীয়।

বর্তমানে গ্রাম কিংবা শহরে সবখানেই বেড়েছে ব্যস্ততা। এখন আর আগের মতো ভোরে সরষে ইলিশের সাথে পান্তার আয়োজন কিংবা বিকেলে দলবেঁধে বৈশাখী মেলায় যাওয়া-কোনোটাই হয়ে উঠে না। আর নাতো দোকানে হালখাতা র আয়োজন করা হয়। প্রযুক্তি নির্ভর এই যুগে একজন অন্যজন কে মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠিয়েই ক্ষান্ত থাকতে অধিক পছন্দ করে। তবে গুটিকতক লোক এখনও রমনার বটমূলে পান্তা-ইলিশ এর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। যদিও পহেলা বৈশাখ উদযাপনে ভিন্নতা এসেছে তবুও এটি বাঙালিদের একটি সর্বজনীন প্রাণের উৎসব।

জাকিয়া আক্তার উর্মী
শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ, গাজীপুর

বাঙালি এক বন্ধনে সুখে সমৃদ্ধিতে থাকুক
ঈদের আমেজ মেতে উঠার রেশ কাটার আগেই আগমন ঘটলো বৈশাখের। বাঙালির সংস্কৃতিতে মাতিয়ে তুলতে ভেদাভেদ ভুলে সবাই বাঙালি পরিচয়কে ধারণ করে পহেলা বৈশাখ উদযাপন করে। বিশাখা নক্ষত্রের অনুসারে বৈশাখ বর্ষপঞ্জিরে প্রথম মাস। এই পহেলা বৈশাখের দিনটিকে রাঙাতে শহরে যেমন থাকে নানা আয়োজনের তেমনি গ্রামেও মেতে উঠে উৎসবে। ‘মাছে ভাতে বাঙালি’ দিনটির শুরু করে পান্তা-ইলিশ খেয়ে। হালখাতার প্রচলন অনেকটা কমে গেলেও বৈশাখী মেলার প্রতি এখনো টান কমে নি বাঙালির। মাটির তৈরি নানান তৈজসপত্রের পাশাপাশি বাঙালির ঐতিহ্যবাহী নানা প্রকার খাবারের পসরা সাজিয়ে বসে দোকানে। 

গ্রামাঞ্চলের পাশাপাশি নাগরিক ব্যস্ততার মাঝেও শহরেও হয় এই বর্ষবরণের উদযাপন। বাংলা গান আর আলপনায় সাজে শহরের পথঘাট। পাশাপাশি আলোকসজ্জায় হেসে ওঠে দালান কোঠা। এভাবেই উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে বাঙালি হৃদয়ে কিন্তু বয়সের পার্থক্যে ছোটবেলার মতো আর বায়না ধরে মেলায় যাওয়া হয় না, স্মৃতিতে ভাসে সেসব দিনের কথা। সব সময়ের মতোই প্রত্যাশা বাঙালি এক বন্ধনে সুখে সমৃদ্ধিতে থাকুক।

তামান্না আক্তার
শিক্ষার্থী, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজ, ঢাকা।

নবীনদের মাঝে বাংলা তারিখ ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করানো উচিত
সূর্যোদয় কিংবা সূর্যাস্ত চলমান প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে। তবুও যেন বছরের শেষ সূর্যাস্ত আমাদের আগের বারো মাসের হিসেব মনে করিয়ে দেয়। ক্যালেন্ডারের পাতা উলটে যায়। নতুন বছরের জন্য সবাই শুভেচ্ছা জানায়। হারিয়ে যাওয়া বছরে রয়ে যায় আমাদের সুখের কিংবা দুঃখের হাজারো স্মৃতি। প্রত্যেক বৈশাখে গ্রামে বিকেল গড়ালে নতুন বাঁশির সুরে ছেলেমেয়েদের ঘুরে বেড়ানো দেখতাম। মেলা থেকে মাটির খেলনা কিনে যেমন অনেকেই বাড়ি ফিরত তেমনি মুড়ি, জিলাপি, বাতাসা কিনে আনা হতো। করোনা মহামারি কাটানোর পর গ্রামগঞ্জে এখনো মেলা আগের মতো জমে উঠে না। নানা সীমাবদ্ধতায় মেলার আয়োজন গ্রামে অনেকটা কম চোখে পড়ছে এসময়ে এসে। 

পান্তা-ইলিশ ভোজনে অনেক বাঙালি বৈশাখ উদযাপনের শুরু করে। পুরো দিন মেতে থাকে বাঙালিয়ানায়। তবে বাংলা তারিখের ব্যবহার তুলনামূলক কম হওয়ায় আমাদের নবীন প্রজন্মের অনেকের কাছে বাংলা মাসের তারিখ মনে রাখা কঠিন হয়ে যায়। আমাদের এই প্রজন্ম এবং নবীনদের মাঝে বাংলা তারিখ ব্যবহারের গুরুত্ব অনুধাবন করানো উচিত। শুধুমাত্র বিশেষ দিনের বাংলা তারিখ না জেনে প্রতিটি দিনের চর্চা হোক প্রচলিত তারিখ গণনার পাশাপাশি বাংলা দিনপঞ্জিকার মতোও। সবশেষে একটাই প্রত্যাশা, সুখ ও সমৃদ্ধিতে কাটুক বাঙালির পুরো বছর।

তানজিদ শুভ্র
শিক্ষার্থী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর।

পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত
বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বন। বসন্তকে বিদায় জানাতে জানাতে বাঙালি প্রস্তুতি নিচ্ছে বৈশাখকে বরণ করার। গাছে গাছে দেখা আম, কাঁঠাল, লিচুসহ বিভিন্ন ফল ও ফুলের সমারোহ। আমাদের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পহেলা বৈশাখ ও চৈত্র সংক্রান্তি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাই একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি কল্পনা করা যায় না।

শৈশবে চৈত্র সংক্রান্তির দিনে মা কাক ডাকা ভোরে ডেকে দিত। ওঠেই স্নান সেরে, সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করতাম। এইদিনে অঞ্চল ভেদে ‘বোন ছাতু’ খাওয়ার রেওয়াজ রয়েছে। সকালে নতুন জামা পরে ছাতু, গুড়ের বাতাসা, চিনি দিয়ে তৈরি হাতি, ঘোড়া, দুধ, মিষ্টি, বিভিন্ন ফল, দই ইত্যাদি ভাইদের সামনে পরিবেশন করে খাওয়া হতো। এই দিনে সবাই ভাই-বোনদের বাড়িতে আসত। বিকেল হলে মার সাথে চৈত্র পূজায় যেতাম। সেখানে গিয়ে টেপা পুতুল মাটির খেলনাই থাকত প্রধান আকর্ষণ। মা বলতেন এই দিনে ভালো হয়ে চললে সারাবছর ভালো হয়ে থাকবে, সকল হিংসা বিদ্বেষ ভুলে যেতে বলতেন। এই দিনেই প্রথম আম খেতে পারতাম এর আগে মা কখনো আম খেতে দিতেন না। বিকেল হলে পাড়ার অনেকে মিলে আশেপাশে কোন গ্রামীণ মেলায় সমবেত হতাম সবাই। এভাবেই কেটে যেত আনন্দময় একটি দিন।

বর্তমান সময়ে মানুষের সাথে মানুষের সুসম্পর্ক ধীরে ধীরে কমেছে। কমেছে আসা যাওয়া। সবাই মিলে কোথাও ঘুরতে যাওয়াও এখন আর হয় না। সবাই যার যার কর্মজীবনে ব্যস্ত। এখন নতুন জামা বা নতুন কিছু কেনার আগ্রহ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। আনন্দ গুলো কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। তবুও আমরা এই কামনাই করি সকল হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে, সকল জড়তা দূর করে বৈশাখ আমাদের জীবনে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসুক। শুভ নববর্ষ।

অনুপ্রমা
শিক্ষার্থী, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ।

 

সর্বশেষ সংবাদ