সুস্থ প্রাণির পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রেখে হোক এবারের কুরবানি

ড. কে.বি.এম. সাইফুল ইসলাম
ড. কে.বি.এম. সাইফুল ইসলাম  © টিডিসি ফটো

প্রাণিচিকিৎসা, শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ এ পর্যন্ত এগার বার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত ড. কে.বি.এম. সাইফুল ইসলাম বাংলাদেশের প্রানিচিকিৎসা সেবার এক সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব; বর্তমানে তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের(শেকৃবি) মেডিসিন অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কমর্রত আছেন। শেকৃবিতে যোগদানের আগে তিনি বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে কমর্রত ছিলেন। তিনি ঈদুল আজহা উপলক্ষে সুস্থ ও সবল কুরবানির প্রাণি নির্বাচন এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এড়াতে কুরবানি পরবর্তী করনীয় বিষয় নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস কে একটি সাক্ষাৎকার দেন। আর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস র পক্ষে কথা বলেন শেকৃবি প্রতিবেদক মো.আরাফাত রহমান অভি

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কয়েক বছর যাবত অসদুপায়ে প্রাণি মোটাতাজাকরণ নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। অসদুপায়ে প্রাণি মোটাতাজাকরণ নিয়ে আপনার মতামত কি এবং এ কারণে পশু কেনা-বেচার ক্ষেত্রে ক্রেতা-বিক্রেতাকে কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়?

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: সারা বছর আমাদের দেশে যে পরিমাণ গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া জবাই হয় তার প্রায় ৫০ ভাগ জবাই হয় কুরবানির ঈদের সময় । ফলে বেড়ে যায় প্রাণির চাহিদা। অনেক মুনাফা লোভী অসাধু ব্যবসায়ী এই চাহিদাকে পুঁজি করে অসদুপায় অবলম্বন করে অবৈজ্ঞানিক উপায়ে প্রাণি মোটাতাজা করতে নানা অবৈধ পদ্ধতি অবলম্বন করে। এসব ক্ষেত্রে অসাধু ব্যবসায়ীরা ওজন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন ধরনের স্টেরয়েড জাতীয় ট্যাবলেট খাওয়ায় কিংবা হরমোনাল ইনজেকশন দেয়।

তবে আশার বিষয় হচ্ছে বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপ এবং মিডিয়াতে ব্যাপক প্রচারের ফলে স্টেরয়েড ব্যবহার করে প্রাণি মোটাতাজাকরণের প্রচলন অনেকাংশে কমে গিয়েছে। খুব কম খামারীই এখন এই কৌশল অবলম্বন করে থাকেন।

আমরা জানি স্টেরয়েড জীবন রক্ষাকারী ঔষুধ হিসেবে পরিচিত। মানুষসহ সকল প্রাণির চিকিৎসায় স্টেরয়েডের স্বীকৃত ব্যবহার রয়েছে। তবে মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড প্রয়োগের ফলে প্রাণির রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া এসব প্রাণির কিডনি খুব দ্রুত অকার্যকর হয়ে যায় এবং রেচনতন্ত্র স্বাভাবিকভাবে কাজ না করায় প্রাণির কোষের মধ্যে পানির পরিমাণ বেড়ে যায়। তাই এসব প্রাণি অন্যসব প্রাণির চেয়ে ফোলা দেখায়। কিন্তু বাস্তবে এর মাংসপেশির ওজনের কোন তারতম্য ঘটে না। আর এ ধরনের ক্ষতিকর স্টেরয়েড ও হরমোনের অবশিষ্টাংশ প্রাণির মাংসে থেকে যেতে পারে, যা মানুষের স্বাস্থ্যে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। এতে ক্রেতারা ভীত থাকেন এবং মোটাতাজা পশু দেখলেই মনে করেন পশুটি বুঝি হরমোন বা ঔষধ প্রয়োগ করে মোটা করা হয়েছে। আর ক্রেতাদের এমন ভীতিতে বৈধ খামারিরাও ন্যায্যমূল্য না পাওয়া সহ নানা বিড়ম্বনার শিকার হন।

আবার ব্যবসায়ীরা অনেক দূর-দূরান্ত থেকে ট্রাকে, ট্রলারের সাহায্যে পশু হাটে নিয়ে আসেন। ট্রাকে, ট্রলারে গরু এমনভাবে বাঁধা হয়, যাতে নড়তে-বসতে না পারে। তাছাড়া হাটেও পশুকে সবসময় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়। কারণ ক্রেতারা দাঁড়ানো পশুই ক্রয় করতে বেশি আগ্রহী হন। তাই বিক্রেতা পশুকে বসতে দিতে চান না। ফলে একজন ক্রেতা যখন হাট থেকে পশু কিনে বাড়ি নিয়ে যান, তখন ওই গরু একবার বসলে আর দাঁড়াতে চায় না। কোনো কিছু খেতেও আগ্রহ প্রকাশ করে না। তখন অনেকেই মনে করে পশু বোধহয় অসুস্থ। প্রকৃত অর্থে পশুটি তখন বেশ ক্লান্ত থাকে। তাই কেনার পরে প্রাণিটিকে বাসায় নিয়ে গিয়ে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেয়া উচিৎ। এ সময় স্যালাইন পানি সরবরাহের পাশাপাশি কুরবানির প্রাণির জন্য পর্যাপ্ত খাবার সংস্থান করাও জরুরি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এসব হরমোন ও স্টেরয়েড কি মানব দেহে কোন ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে ?

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: প্রতিটি ঔষধের মত হরমোন ও স্টেরয়েড এর একটি নির্দিষ্ট প্রত্যাহার কাল রয়েছে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পশুর দেহে এর সরাসরি প্রভাব থাকে। আর এই সময় যদি কেউ ঐ পশুর মাংস অথবা দুধ গ্রহণ করে তাহলে সেটি তার জন্য স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে । তবে এসব পশুর মাংশ খাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও এটি ধীরে ধীরে মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়।

ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হয়। এসব পশুর মাংসের মাধ্যমে গ্রহণকৃত অতিরিক্ত স্টেরয়েডের প্রভাবে কিডনি ও লিভার নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া শিশু অল্প বয়সে মুটিয়ে যায় এবং অনেক ক্ষেত্রে তাদের চিরবন্ধ্যত্ব বরণ করতে হয়। অনেক সময় এসব ঔষধের প্রভাবে হরমোন পরিবর্তন হয়ে যায় এবং চর্ম জনিত রোগও হয়ে থাকে। কিছু কিছু ঔষধ এতটাই ক্ষতিকর যে, মাংস রান্না করার পরও তা নষ্ট হয় না। এমনকি তাপে পরিবর্তিত হয়ে জটিল রাসায়নিক পদার্থে পরিণত হয়ে স্বাস্থ্যের জন্য আরও মারাত্মক ক্ষতির কারণ হতে পারে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কুরবানির জন্য সুস্থ-সবল পশু নির্বাচনের ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ?

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: দিনের আলো থাকতে থাকতেই পশু কিনে ফেলা উচিত তাহলে পশুর সুস্থতা যাচাই করতে সুবিধা হবে। খেয়াল রাখতে হবে মোটা পশু মানেই কিন্তু সুস্থ পশু নয়। আর অস্বাভাবিক মোটা পশুতে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করেও মোটাতাজা করা হতে পারে। স্টেরয়েড ট্যাবলেট খাওয়ানো বা ইনজেকশন দেয়া পশু ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারবে না। অধিকাংশ সময় পশু ঝিমাবে। অতিরিক্ত হরমোনের কারণে পুরো শরীরে পানি জমে মোটা দেখাবে। ফলে আঙ্গুল দিয়ে পশুর শরীরে চাপ দিলে সেখানে দেবে গিয়ে গর্ত হয়ে থাকবে। পশুর মুখের সামনে খাবার ধরলে খাবার খেতে চাইবে না। আর সুস্থ পশুর চোখ বড় ও উজ্জ্বল থাকবে, লেজ দিয়ে মাছি তাড়াবে, কান নাড়বে, অবসরে পান চিবানোর মতো সবসময় চিবাবে। পশুকে বিরক্ত করলে সহজেই রেগে যাবে। গোবর স্বাভাবিক থাকবে, পাতলা পায়খানা করবে না। আর মুখের সামনে খাবার ধরলে যদি জিহবা দিয়ে টেনে নেয় এবং নাকের ওপরটা ভেজা ভেজা থাকে এবং সুস্থ গরুর পিঠের কুঁজ হবে মোটা ও টান টান।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: হাটে পশু কেনার সময় পশু থেকে মানব দেহে রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা কতটুকু এবং প্রতিকারের উপায় কি ?

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: আমাদের দেশের পশুহাট গুলোতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পশু আসে। ফলে এক অঞ্চলের পশুর রোগ বালাই অন্য অঞ্চলের পশুতে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। কেননা হাটে যে পশুগুলো আসে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো কোন ধরণের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াই হাটে প্রবেশ করছে। আর রোগবালাই যে শুধু প্রাণি থেকে প্রাণি তে ছড়ায় সেরকম নয়। কিছু কিছু রোগ-ব্যাধি আছে যা প্রাণি থেকে মানুষে ছড়ায় যা জুনোটিক ডিসিস নামে পরিচিত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে যক্ষা, এন্থ্রাকক্স, ব্রুসেলোসিস ইত্যাদি।

এসব রোগ প্রতিকারের জন্য নিজস্ব স্বাস্থ্য সচেতনতা জরুরী। যেমন আমরা অনেকেই প্রাণি কিনতে গেলে অযথাই প্রাণির শরীরে হাত বুলাই। আবার অনেকে পশুর বয়স নির্ধারণের জন্য পশুর দাঁত বের করে দেখে। এসময় দাঁতের জন্য হাত কেটে গেলে অথবা আগে থেকেই হাত কাটা থাকলে ওই কাটাস্থান দিয়ে বিভিন্ন রোগের জীবাণু মানবদেহে দেহে প্রবেশ করতে পারে। আবার হাঁচি কাশির মাধ্যমেও দেহে নানা ক্ষতিকর রোগজীবানু প্রবেশ করতে পারে।

তাই হাটে গ্লাভস ও মাস্ক ব্যবহার করা উচিত। যতটা সম্ভব দূরে দাঁড়িয়ে থেকে প্রাণি পর্যবেক্ষণ করা উচিত। এবং হাটে ছোট বাচ্চাদের না নিয়ে যাওয়াই উত্তম। হাট থেকে ফিরে ভাল ভাবে গোসল করতে হবে। এবং সাথে কাপড় গুলো ধুয়ে ফেলতে হবে। সম্ভব হলে হাট থেকে কিনে আনা প্রাণিকেও গোসল করাতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জনস্বাস্থ্য রক্ষার্থে কুরবানির পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আপনি কি পরামর্শ দেবেন?

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: বর্তমানে সুস্থতা বলতে আমরা বুঝি নিজের, অন্যান্য প্রাণীর এবং আশেপাশের পরিবেশের সুস্থতা । আমরা এখন নিজের এবং অন্যান্য প্রাণীর স্বাস্থ্যের ব্যাপারে সচেতন। তবে পরিবেশ সুস্থ রাখার ব্যাপারে আমরা এখনও অনেকটাই উদাসীন। তাই কুরবানির পরবর্তী কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রথমেই আমাদের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সে জন্য সরকার নির্ধারিত স্থানে কুরবানি দিতে হবে।

পশুর জবাইয়ের শেষে ৫-৬ ফুটের একটি গভীর গর্ত করে শিং, খুর, রক্ত, বিষ্ঠা সহ অব্যবহৃত সকল উপাজাত মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে যেন বৃষ্টির পানি অথবা শেয়াল, কুকুর এগুলোকে তুলতে না পারে। মাছের খাদ্য হিসেবে অনেকেই এগুলো পুকুরে অথবা নদীতে ফেলে দেয় যেটি জলজ বাস্তুতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব সৃষ্টি করে। কোন অবস্থাতেই আবদ্ধ কোন জলাশয়ে প্রাণির ভুড়ি পরিষ্কার কিংবা মল, মুত্র, রক্ত এবং পরিত্যাক্ত অংশ ফেলা যাবে না। এতে মারাত্মক পানি দূষণ হয় যা পরবর্তীতে মাছসহ অন্যান্য জলজ প্রাণি এবং কৃষিজাত পণ্যের ক্ষতিসাধন করে জনস্বাস্থ্যে বিপর্যয় ডেকে আনে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্যার, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আমাদের সময় দেওয়ার জন্য।

ড.কে.বি.এম. সাইফুল: তোমাকও ধন্যবাদ।

 

 


সর্বশেষ সংবাদ