০৪ নভেম্বর ২০২৩, ১৪:৪৮

আরব রাষ্ট্রগুলোর অনৈক্য স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অন্তরায়

ড. এ. টি. এম. সামছুজ্জোহা  © টিডিসি ফটো

ড. এ. টি. এম. সামছুজ্জোহা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে চীনে পিএইচডির সাবেক শিক্ষার্থী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ে বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ পূর্ব এবং পশ্চিম এশিয়া ড. জোহার আগ্রহের বিষয়। দেশি-বিদেশি গবেষণা জার্নালে এই অধ্যাপকের ৩০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক সামছুজ্জোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষ উপলক্ষে আয়োজিত "গবেষণা উৎসবে" বিশ্ববিদ্যালয়টির কলা অনুষদের "শ্রেষ্ঠ গবেষক" হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছেন। 

ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট, যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কসহ বিশ্ব রাজনীতির নানা ইস্যু নিয়ে ড. এ. টি. এম. সামছুজ্জোহা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. জামিন মিয়া। সঙ্গে ছিলেন হাসিবুল হাসান শান্ত

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আবারো ইসরায়েল গাজার নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিদের উপর হামলা জোরদার করেছে। এই ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট সমাধান হচ্ছে না কেন?
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট বহু পুরোনো। আমি মনে করি, এটি ফিলিস্তিনের সংকট নয় বরং এই সংকট ইসরায়েলের। তারা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করে ফিলিস্তিনিদের ঘরবাড়ি দখল করে অবৈধ বসতি নির্মাণ করে যাচ্ছে। মূলত ফিলিস্তিনিদের ভূমিতে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের বৈধতা নিয়েই বিতর্ক রয়েছে। এখন আবার দেখছি, দ্বি-রাষ্ট্র তত্ত্ব বেগবান হয়েছে। বিশ্বের অনেক নেতা দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র নির্মাণে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ইসরায়েল বেপরোয়া হয়ে উঠছে, মনে হচ্ছে পুরো ফিলিস্তিন তারা দখল করে নেবে!  আরব দেশগুলোর অনৈক্য স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের অন্যতম বাধা বলে প্রতীয়মান হয়। ট্রাম্প আমলে আব্রাহাম অ্যাকর্ড এবং সম্প্রতি সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি দ্বি-রাষ্ট্র ভিত্তিক তত্ত্বের কথা বললেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের আমলে জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। 
অধ্যাপক ড.সামছুজ্জোহা: প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সরকার আন্তর্জাতিক আইনের ধার ধারেনি। সে সময় তো মার্কিন দূতাবাস জেরুজালেমে স্থানান্তর করা হয়েছিল, কিন্তু বেশিরভাগ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই একতরফা সিদ্ধান্তকে সমর্থন করেনি। কৌশলগত কারণে ওয়াশিংটন তেলআবিবকে নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে আসছে। এই বারতো সংঘাতের পর বাইডেন নেতানিয়াহুর সাথে সাক্ষাৎ করতে ইসরায়েল ছুটে গেলেন এবং নিরীহ ফিলিস্তিনিদের নিশ্চিহ্ন করতে নিয়মিতভাবে অর্থ ও অস্ত্রের যোগান দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন: দিনে দুটি রুটি খেয়ে বেঁচে আছে গাজার মানুষ: জাতিসংঘ

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংকট শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্র, চীনকে ভূমিকা রাখার আহবান জানিয়েছিলো। এ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: দেখুন, চীন এখন দিন দিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। ইউক্রেন যুদ্ধেও আমরা এর প্রতিফলন দেখেছি। চীন, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল ইস্যুতে আরব লীগকে সমর্থন দিয়েছে। চীনের বক্তব্যে তারা যে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধান চায় ইতিমধ্যে তা স্পষ্ট করেছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মধ্যপ্রাচ্যে ও আফ্রিকার রাজনীতিতে চীনের উত্থানকে কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে চীনের ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কৌশল বহুদিনের। আর এ কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সাথে চীন আন্তঃসম্পর্কীয় যোগাযোগ শক্তিশালী করার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। কিছুদিন আগে সবাইকে চমকে দিয়ে চীন চুক্তির মাধ্যমে রিয়াদ-তেহরানের সম্পর্ককে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। আবার আফ্রিকার ফিজিতে তারা সামরিক ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। সুতরাং এ অঞ্চলে রাশিয়ার পাশাপাশি চীনও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিশ্বে দ্বিতীয় স্নায়ু যুদ্ধ শুরু হয়েছে।এর পিছনে কে দায়ী বলে মনে করেন?
অধ্যাপক ড.সামছুজ্জোহা: এই ধারণাটি নিয়ে আসলে দ্বিমুখী বক্তব্য রয়েছে। ২য় বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হবার পর মূলত স্নায়ু যুদ্ধের বিষয়টি আমাদের কাছে এসেছে। পরবর্তীকালে সোভিয়েত রাশিয়া ভেঙে যাওয়ায় স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটে। ইদানিং বিশ্বে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উত্থান ঘটছে। এ কারণে চীনকে রুখতে আমেরিকা মরিয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আমেরিকা মিত্র হিসেবে পাশে পেয়েছে সকল পশ্চিমা দেশগুলো এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নকে। অন্যদিকে চীন এই লড়াইয়ে পাশে পাচ্ছে রাশিয়াকে। সুতরাং বর্তমান বাস্তবতায় বিষয়টি অস্বীকারের সুযোগ নেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ইউরোপিয়ান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের পরিচালক মার্ক লিউনাট বলেছেন, আজকের দিনে পশ্চিমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে চীন। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
অধ্যাপক ড.সামছুজ্জোহা: মার্ক লিউনাট তিনি একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কীয় সম্পর্ক বিষয়ে তিনি গবেষণা করে থাকেন। তিনি এখানে আসলে চীনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে আমেরিকান দৃষ্টিভঙ্গিকে তুলে ধরার মুখে তুলে ধরেছেন। আপনি হয়তো জেনে থাকবেন, চীনের অর্থনৈতিক উন্নতি ২০১৪ সালে আমেরিকার মোট দেশজ উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়। আফ্রিকার দেশসমূহের বাজার আজ  চীনের দখলে। ইউরোপ এমনকি খোদ আমেরিকার বাজারেও চীনা পণ্যের বিশাল একটা অবস্থান তৈরি হয়েছে। মার্ক সম্ভবত এখানে চীনের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক যুদ্ধের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছেন।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: অনেক পশ্চিমা বুদ্ধিজীবী এবং রাজনীতিবিদ দাবি করেন, চীনের আজকের সাফল্যের পিছনে পশ্চিমের বুদ্ধিভিত্তিক সম্পদ চুরির ভূমিকা আছে। বিষয়টি কতটুকু সত্য?                                  
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: এটা আসলে তদন্তের ব্যাপার। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা দাবি করেছে তারা গেন চেন নামে একজনকে চীনের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছে। পরবর্তীকালে আরো কিছু ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পরে দেখা গেছে যে তারা হয়তো কেউ কেউ চীনের সামরিক বাহিনীতে কাজ করতো। দেখুন, একটা রাষ্ট্রের 'স্টেট পলিসি' থাকে। সেই পলিসির জায়গা থেকে বেইজিং এগুলো করতেই পারে। আমাদের পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, CIA, Mossad,  SVR, FSB, FSO, GUSP, অথবা IPA প্রত্যেকেই এই কাজগুলো করে যাচ্ছে। হয়তো নিজের দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তারা এসব করছে। সেক্ষেত্রে চীন কতটুকু করছে? আমি আবারও বলছি এটি খুবই তর্ক সাপেক্ষ ব্যাপার।

আরও পড়ুন: গাজায় হামলা অব্যাহত থাকলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ ছড়িয়ে যাবে: হিজবুল্লাহ প্রধান

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি জানেন আফ্রিকায় ঘন ঘন সেনা অভ্যুত্থান হচ্ছে এর মাধ্যমে রুশ সমর্থনপুষ্ট সরকার ক্ষমতায় আসছে। তাহলে কি পশ্চিমারা আফ্রিকাতেও ধরাশায়ী হচ্ছে?
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: একটা লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে আফ্রিকাতে মূলত চারটি উপনিবেশিক শক্তির উপনিবেশ ছিলো। দেশগুলো হচ্ছে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, স্পেন, ও পর্তুগাল। এই দেশগুলো সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে আফ্রিকার বিভিন্ন রাষ্ট্রশাসন করেছে। তবে ঐসব দেশের জনগণ তাদের প্রত্যাখান করায় তারা লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। অন্যদিকে এই ইউরোপ সম্পর্কে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদীদের মনে আগে থেকেই নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবেই ইউরোপ যেহেতু আমেরিকার মিত্র সেহেতু আমেরিকাকেও তাদের কাছে সুবিধাবাদী বা ঝাঁকের কই মনে হবে। তাছাড়া দেশে দেশে আমেরিকা কর্তৃক খনিজ ও সম্পদ হাতানোর ঘটনা এখন ওপেন সিক্রেট। এসব কারণেই হয়তো আফ্রিকা ইউরোপ-আমেরিকার বিকল্প হিসেবে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো দেশগুলোর প্রতি আস্থা রাখছে। মজার বিষয় হলো, সাম্প্রতিককালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর সেখানে জনগণকে রাশিয়ার পতাকা উড়াতে দেখা যাচ্ছে যা স্বাভাবিকভাবে ঐ দেশগুলোতে রাশিয়ার প্রভাবকেই নির্দেশ করে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: রুশ-ইউক্রেন বিষয়ে আসা যাক। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র কিয়েভকে অস্ত্র দিচ্ছে, কিন্তু অন্যদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে হামলায় ইউক্রেনকে নিরুৎসাহিত করছে। এর পিছনে কি কারণ আছে বলে আপনি মনে করেন?
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, কোন দুটি দেশ যুদ্ধে লিপ্ত হলে তৃতীয় কোন দেশের ঐ যুদ্ধে সরাসরি যুক্ত হবার সুযোগ নেই। এজন্য আমেরিকা এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র দিচ্ছে কিন্তু তারা ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে যাচ্ছে না। আমার মনে হয়, ওয়াশিংটন কৌশলগত কারণে রাশিয়ার ভিতরে আক্রমণের জন্য নিরুৎসাহিত করছে। কেননা যদি ইউক্রেনকে আমেরিকা এক্ষেত্রে প্রকাশ্য উৎসাহিত করে তাহলে রাশিয়া ব্যাপকভিত্তিক যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে আর সেটি হলে আমেরিকা ও তাঁর মিত্রদেশগুলোর সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পরার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের সময় দেবার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
অধ্যাপক ড. সামছুজ্জোহা: আপনাদেরও ধন্যবাদ।