০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১৭:০৬

শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্ক পবিত্র হওয়া উচিত

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান  © টিডিসি ফটো

১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর পালিত হয়ে থাকে বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এদিন বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশে এবারেই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হতে যাচ্ছে। শিক্ষক দিবসে শিক্ষকবৃন্দের চাওয়া-পাওয়া, নানা অর্জন ও চিন্তা ভাবনার বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ফাইন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ শামীম উদ্দিন খান। তিনি অধ্যাপক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়টির সিন্ডিকেটের নির্বাচিত সদস্য। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ বছর শিক্ষকতা করছেন তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিয়ে তার ভাবনাগুলো শুনেছেন চবি প্রতিনিধি সুমন বায়জিদ-   

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এবারের বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ।’ প্রতিপাদ্যটি কি সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক? আপনার মন্তব্য কি?

ড. শামীম উদ্দিন: আসলে শিক্ষক কারা হবেন? যে কাউকে তো আর  শিক্ষক বানানো যায় না। শিক্ষক হতে হলে তার জ্ঞানের গভীরতা থাকতে হবে। শিক্ষক হওয়ার জন্য নীতি-নৈতিকতা, আন্তরিকতা, পড়াশোনা ও গবেষণার প্রতি আকাঙ্খা থাকতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রতিপাদ্যটি বিশ্লেষণ করলে দেখি, শিক্ষক নিয়োগের সময় প্রার্থীর দলকে প্রাধান্য দেওয়া। তার পিতা, ভাই কোন দল করে এসব দেখা হয়। এমন যদি হয় তাহলে কখনো ভালো মানের শিক্ষক পাওয়া যাবে না এবং জাতি গঠনে এসব শিক্ষক কোন ভূমিকা রাখতে পারবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষকদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা হয়—আমাদের শিক্ষকরা সেই বহুল কাঙ্ক্ষিত আলোকিত মানুষ তৈরি করতে পারছেন কিনা?

ড. শামীম উদ্দিন: আমাদের দেশে এখন ব্রেইন ড্রেইন হচ্ছে। কারণ আমরা প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে তাকালেই দেখি সেখানে কিন্তু ছাত্র রাজনীতি নেই। আমাদের বর্তমান সরকার সবসময় ভারতের পক্ষে কথা বলেন। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সরকার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করছে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ভারত যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে আমরা সেটা করছি না। আমাদের দেশে অনেকসময় সামান্য মাস্টার্স-ডিগ্রী পাশ করলেই তাকে দলীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তাহলে তারা কিভাবে শিক্ষার্থীদের চতুর্মুখী শিক্ষা দিয়ে জাতি গঠনে ভূমিকা রাখবে? এটাই আমার কাছে ভাবতেই আশ্চর্য লাগে। আমাদের শিক্ষার মান এজন্যই দিন দিন কমে যাচ্ছে। আমরা কাঙ্ক্ষিত আলোকিত জাতি গঠনে ভূমিকা রাখতে পারছি না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দেশের শিক্ষকরা বেতন-মর্যাদায় পিছিয়ে আছে বলে শোনা যায়-সেটা কতটুকু প্রাসঙ্গিক? এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য কি?

ড. শামীম উদ্দিন: অবশ্যই প্রসঙ্গিক। আমি মনে করি পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কিল করা উচিৎ। মেধাবীরা দেশে থাকতে  চাচ্ছেন না। শিক্ষকতায় আগ্রহী হচ্ছেন না, তারা বাহিরে চলে যাচ্ছেন। কারণ দেখা যায় আমারই ছাত্র একটা কোম্পানি সিইও হলে তার বেতন ৫ লাখ টাকা। আর আমাকে যদি সামান্য বেতন দিয়ে চলতে হয়। একটা গাড়ি আমরা ৫০ জন মিলে ব্যবহার করি।অন্যদিকে একজন ইউএনও ৭০ লক্ষ টাকার গাড়ি ব্যবহার করে আরও আনুষাঙ্গিক সুযোগ সুবিধা পায়। আর আমরা অপেক্ষা করি কখন গাড়ি আসবে, কখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবো- এ নিয়েই থাকি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চবিকে আপনি ভীষণ ভালোবাসেন। ঢাবি ছেড়ে চবিকে শিক্ষকতার জন্য বেঁচে নিয়েছেন।  এক্ষেত্রে চবিতে বিশেষ কি রয়েছে?

ড. শামীম উদ্দিন: আসলে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই এর প্রতি আলাদা এক ধরনের টান রয়েছে। আমি চুয়েটে ও রাবিতেও শিক্ষকতা করেছি। যখন ঢাবিতে যোগ দেওয়ার সুযোগ এলো তখন আমি ভাবলাম আমার আসলে কোন দিকে যাওয়া উচিৎ। তখন চবির সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম চৌধুরীর অনুরোধে চলে আসি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দীর্ঘ সময় চবিতে শিক্ষকতা করছেন। বেশিরভাগ শিক্ষকগণ ক্যাম্পাসের বাহিরে থাকেন। মূল কারণ কি? এখানে শিক্ষকদের আবাসনের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আছে কিনা? 

ড. শামীম উদ্দিন: এখানে ছাত্র-ছাত্রীদের যেমন আবাসিক সংকট তেমনি শিক্ষক, কর্মকর্তা কর্মচারীদের আরও মারাত্মক আবাসিক সংকট রয়েছে। কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় একটা দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো যে, এটা একটা সম্পুর্ণ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হবে। দুঃখজনকভাবে আমরা এখনো পর্যন্ত আমাদের লক্ষ্য তা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। অথচ আমাদের সম্পদ রয়েছে। 

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে যারা আসেন তারা বিভিন্ন কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন কিন্তু এদিকে মনোনিবেশ করতে পারেন না। অনেক আর্থিক প্রতিষ্ঠান আছে যারা আমাদেরকে টাকা দিতে প্রস্তুত। শুধুমাত্র আমাদের চেষ্টা এবং উদ্যোগের অভাবেই আমরা আবাসিক সংকটের মধ্যে আছি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার মতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত?

ড. শামীম উদ্দিন: আমি মনে করি, একজন শিক্ষক-ছাত্রদের সম্পর্কটা পবিত্র হওয়া উচিৎ। একজন শিক্ষক দ্বারা একজন ছাত্র ক্ষতিগ্রস্থ হবে এটা আমি কখনো চিন্তাও করতে পারি না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে যে যেকোনো পর্যায়ে ছাত্রদের সহযোগিতা করা। আমরা যদি তা করতে পারি অবশ্যই একজন ছাত্র আমাদের তার পিতা-মাতার মতোই সম্মান করবেন  বলে মনে করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি দীর্ঘসময় আছেন,এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনকে কতটুকু শিক্ষার্থীবান্ধব মনে হয়েছে?

ড. শামীম উদ্দিন: আমি তো প্রথমেই বলেছি যে প্রশাসনে যে বা যারা আসেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক গ্রুপ, সাব গ্রুপ মেনেজ করতেই জীবন শেষ। ডেভেলপমেন্টের কাজে, গবেষণার কাজে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নেওয়ার মতো ফুরসত কই। আমি তো দেখিনা। কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা টেন্ডার যদি দেওয়া হয় সেখানে ১০টা গ্রুপ এপ্লাই করে। এই টেন্ডার পাওয়ার জন্যে এক গ্রুপ আরেক গ্রুপের লোকদের মেরে ফেলতেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন এগুলো সামলাবে নাকি শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করবে? 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন শিক্ষক হিসেবে পাঠদান করানোকে কতটুকু উপভোগ করেন?

ড. শামীম উদ্দিন: আমার কাছে সবথেকে ভালো লাগে ছাত্রদের ক্লাস রুমে অথবা ক্লাসের বাহিরে তাদেরকে যেকোনো সময় বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করা। আমার ডিপার্টমেন্টের ৯৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর রেফারি হিসেবে আমি কাজ করি এবং সকল শিক্ষার্থী আমার কাছে আসেন। আমি চেষ্টা করি তাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার। এটা আমি উপভোগ করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন শিক্ষক হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা শুনতে চাচ্ছি।

ড. শামীম উদ্দিন: একজন শিক্ষক হিসেবে যদি দায়িত্বের সহিত, গবেষণার সহিত শিক্ষকতা শেষ করতে পারি তাহলেই আমার জীবনটা সার্থক হবে বলে মনে করি। কোনরকমের অন্যায়ের পথে যেন জড়িয়ে না পড়ি এটাই আমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি একজন সিন্ডিকেট সদস্য, বর্তমানে চবিতে শিক্ষার্থীদের খাবারের মান ও দাম লাগামহীন। এক্ষেত্রে আপনার পর্যালোচনা এবং কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা আছে কিনা যা আপনি তুলে ধরতে চান? না থাকলে, এবিষয়ে আপনার মতামত?

ড. শামীম উদ্দিন: আমি মনে করি যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভোস্ট, হাউজ টিউটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তাদেরকে নিয়মিত হলে যাওয়া দরকার। শিক্ষার্থীদের খাবারের মান লেখাপড়ার মান নিশ্চিত করা দরকার। কিন্তু আমার কাছে অনেক অভিযোগ আছে হলের শিক্ষার্থীরা ঠিকমতো প্রভোস্ট, হাউজ টিউটরদের পান না। খাবারের মান নিয়ন্ত্রণ করার মতো কেউ নেই। এরকম হওয়া উচিৎ না। আমরা যদি খাবার মান নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে তাদের সুশিক্ষা কিভাবে নিশ্চিত করবো, গবেষণা কিভাবে নিশ্চিত করবো, আমাদের অবশ্যই এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে। আর হলে অছাত্র অনেকে থাকে তাদের বের করে মেধার ভিত্তিতে হলে বরাদ্দ দেওয়া হোক এবং সকল প্রয়োজন নিশ্চিত করা হোক।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন শিক্ষক কিভাবে আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে পারেন?

ড. শামীম উদ্দিন: একজন আদর্শ শিক্ষক হওয়ার জন্য যে গুণাবলিগুলো রয়েছে যেমন, সত্যবাদিতা, সময়নিষ্ঠ, মনোযোগী এ বিষয়গুলোকে আমাদের চরিত্রে আনতে হবে। আপাদমস্তক একজন শিক্ষক হতে হবে। আমরা যেন পার্টটাইম শিক্ষক না হয়। সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল তাদেরকে যদি আদর্শ শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করি এবং অনুসরণ করি তাহলে একজন আদর্শ শিক্ষক হয়ে উঠতে আমাদের সাহায্য করবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চবি শিক্ষার্থীদের বিশ্বমানের শিক্ষার্থী হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায় কি হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. শামীম উদ্দিন: বাধা হচ্ছে যে ছাত্র-ছাত্রীরা এক অজ্ঞাত কারণে লেখাপড়ার প্রতি গবেষণার প্রতি যে পরিমাণ ডিভোশন থাকা দরকার তা একেবারেই দেখি না। তারা যদি তাদের লক্ষ্যকে ঠিক করতে পারেন, টার্গেট ঠিক করতে পারেন এবং সেই অনুযায়ী কাজ করেন তাহলে বিশ্বমানের শিক্ষার্থী হওয়ার কোন বাধা আমি দেখছি না। মেধার দিক থেকে আমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবসময় এগিয়ে রাখি।আমি দেখেছি তারা পৃথিবীর যেখানেই গিয়েছে সেখানেই অনন্য উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। সুতরাং মেধার দিক থেকে কোন সমস্যা নেই। শুধু তাদের ইচ্ছা এবং সঠিক গাইড যদি করতে পারি তাহলে তারা ভালো করতে পারবে বলে মনে করি। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের জন্য আপনার পক্ষ থেকে একটি পরামর্শ শুনতে চাই?

ড. শামীম উদ্দিন: আমি শিক্ষার্থীদের একটাই অনুরোধ করবো যে, ইন্টারন্যাশনাল সিটিজেন হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। শিক্ষার্থীর আদর্শ যে গুণাবলি রয়েছে সেই বিষয়গুলো যদি রপ্ত করতে পারে তাহলে কোন সমস্যা হওয়ার কথা না। ছাত্রদের একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা হওয়া উচিৎ জ্ঞান অর্জন।  আর কোন দিকে মনোযোগ দেওয়াই উচিৎ না। আমি শিক্ষার্থীদের একটাই উপদেশ দিতে চাই- সুশিক্ষায় শিক্ষিত হও, তবেই সুনাগরিক হতে পারবে। 

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষক হিসেবে ব্যক্তিগতভাবে আপনার স্বপ্ন কী, প্রাপ্তি কতখানি?

ড. শামীম উদ্দিন: আমার প্রত্যাশা যতটুকু ছিলো তা পূরণ হয়নি। মনে করেছিলাম যে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে আন্তর্জাতিক অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে পারবো। কিন্তু সেটি সম্ভব হয়নি। আমি আমার পাঠদানের ক্ষেত্রে, পরামর্শের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেছি বলে মনে করি এবং এক্ষেত্রে আমি সফল। আর পুরো বিশ্ববিদ্যালয়কে যেভাবে কল্পনা করি সেটা এখনো বাস্তবায়ন হয়নি, তাই এক্ষেত্রে আমি বিফল।