অনার্স-মাস্টার্স নয়, শিক্ষক নিয়োগে গুরুত্ব দিতে হবে গবেষণা-অভিজ্ঞতায়
দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়লেও সেই তুলনায় গবেষণা বাড়ছে না। দেশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সঠিক ভূমিকা পালন করছে না দেশের বিশ্ববিদ্যলয়সমূহ। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থও ফিরে যাচ্ছে। গবেষণায় বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের অবস্থা, বরাদ্দকৃত অর্থ ফিরে আসার কারণ এবং এতে আরও আগ্রহী করতে করণীয় সম্পর্কে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কথা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নবনিযুক্ত সদস্য প্রফেসর ড. হাসিনা খান। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিজস্ব প্রতিবেদক আব্দুল কবীর ফারহান-
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বর্তমান সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণার অবস্থা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কি?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মেধাবী শিক্ষক-শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকারও গবেষণার বিষয়ে যথেষ্ট আন্তরিক। তবে গবেষণা উপযোগী পরিবেশের অভাব রয়েছে। যেমন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে থাকা ওয়ার্কশপে দক্ষ জনবল এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি সারানোর উপকরণের অভাব রয়েছে। এছাড়া আমাদের গবেষণাগারের যন্ত্রপাতি সময়ের সাথে আরও আধুনিক হচ্ছে, সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও দক্ষ জনবল প্রয়োজন, কিন্তু এতেও দক্ষ লোকবলের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ফলে এইসব যন্ত্রপাতি খুব দ্রুত কার্যক্ষমতা হারায়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দৈনন্দিন পরিকল্পনায়ও গবেষকদের বিষয়টা উপেক্ষিত। যেমন: এখানে শিক্ষকদের জন্য শুধু ক্লাস-পরীক্ষার কথা চিন্তা করে সকাল-বিকাল পরিবহন দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাজ শুধু ক্লাস নেওয়া নয়। ল্যাবের কাজসহ গবেষণার সংশ্লিষ্ট নানা ধরনের কাজ করতে হয়। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে গবেষণামুখী পরিবহন সুবিধা নেই। এছাড়া ল্যাবে কাজ করতে কেমিক্যালসহ গবেষণা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কোন কিছু শেষ হলে সেটি কিনতে গেলেও নানামুখী সমস্যা পোহাতে হয়। ক্রয় নীতিমালা অনুযায়ী এসব জিনিস কিনতে ন্যূনতম ছয় সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হয়। কোন কাজের একটা পর্যায়ে এসে এত সময় অপেক্ষা করতে গেলে অনেক সময় দেখা যায় কাজটি নষ্ট হয়ে যায় এবং আবার নতুন করে শুরু করতে হয়।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: গত কয়েকবছর ধরে দেখা যাচ্ছে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই গবেষণায় বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয় করতে পারছে না। আপনার মতে এর কারণ কি? শিক্ষকরা কি গবেষণায় আগ্রহ হারাচ্ছেন?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: গবেষণায় কেন অর্থ ব্যয় করতে পারছে না এর সঠিক কারণ আমার পক্ষে বলা কঠিন। তবে আমার যেটি মনে হয় শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের গবেষণায় অভিজ্ঞতায় গুরুত্ব দেওয়া উচিত। শুধুমাত্র স্নাতক-স্নাতকোত্তর শেষ করা প্রার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না দিয়ে যাচাই করা উচিত তার গবেষণায় দক্ষতা কেমন, সে কতটা ভালো গবেষক। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় মানে কিন্তু শুধুমাত্র বই পড়ানো নয়, বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান উৎপাদনের কেন্দ্র। আর জ্ঞান উৎপাদনের উপায় হল গবেষণা। তাই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে গবেষকদের গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: হায়ার এডুকেশন কোয়ালিটি এসিউরেন্স প্রজেক্টের (হেকাপ) অধীনে গবেষণায় গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু এই প্রকল্প শেষে আইএমইডির নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছেন তারা শিক্ষাজীবন শেষে গবেষণায় অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক নয়। এই নিরুৎসাহের কারণ কি?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: আমার বাস্তব অভিজ্ঞতায় আমি যতটা দেখেছি অধিকাংশ শিক্ষার্থীরই গবেষণায় আগ্রহ রয়েছে। এমনকি তারা সীমাবদ্ধতার মাঝেই গবেষণা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। এমনও হয়েছে কোনো একটি কেমিক্যাল বা ইকুয়েপমেন্টের অভাবে আমি যখন গবেষণা কাজ শেষ করতে পারবো কিনা এ বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলাম তখন তারাই বিকল্প উপায় বের করে বলেছে ‘ম্যাম কাজটা আমরা এই ইকুয়েপমেন্টগুলো দিয়েই এভাবে করতে পারি।’ তাই আমি বলবো শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহ আছে। তবে আমাদের দেশের চাকরির নিয়োগ পদ্ধতি, জব মার্কেটে চাহিদা এসব কারণে হয়ত তারা কিছুটা নিরুৎসাহিত হতে পারে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার্থীদের গবেষণায় আগ্রহী করতে কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: প্রথমত শিক্ষক নিয়োগসহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোয় গবেষকদের প্রাধান্য দিতে হবে। দ্বিতীয়ত আমাদের ইন্ড্রাস্ট্রি একাডেমিয়া লিংকেজ করতে হবে। আমাদের দেশে কি কি সমস্যা আছে সেগুলো নির্ণয় করে তার বিপরীতে গবেষণা আহ্বান করতে হবে এবং গবেষণার ফলাফল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাস্তবায়ন করতে হবে। যখন এগুলো আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো তখন শিক্ষার্থীরাও গবেষণায় আগ্রহী হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করতে করণীয় কি?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: আমি মনে করি দেশের গবেষণাখাতে আর্থিক সংকট খুব বড় বাঁধা নয়। সঠিক পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে পারলে দেশে গবেষণার ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করা সম্ভব। দেশে গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে আমি প্রথমেই বলবো শিক্ষক নিয়োগে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে এবং দেশি পিএইচডিকে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে। আমরা যে অর্থ দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিদেশে পিএইচডি করতে পাঠাই সেই অর্থ দিয়ে দেশেও অনেক ভালো মানের গবেষণা সম্ভব। আর দেশে পিএইচডি এ কারণেই জরুরি যে প্রতিটি দেশের সমাজব্যবস্থা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ এবং সমস্যা ভিন্ন। একজন যখন দেশে পিএইচডি করবে তখন সে এগুলো ভালোভাবে বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী গবেষণা করে সমাধান বের করতে পারবে। আরেকটি বিষয় হল ল্যাব ইকুইপমেন্ট ও কেমিক্যালের পর্যাপ্ততা। উন্নত বিশ্বে আমরা দেখতে পাই ল্যাব সরঞ্জামগুলো অত্যন্ত দক্ষতার সাথে রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা করা হয়। এ কাজের জন্য পর্যাপ্ত টেকনিশিয়ান থাকে। কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ে তেমন গুরুত্ব দেয়া হয় না। ফলে যে ইকুইপমেন্ট ১০ বছর যাওয়ার কথা সেটি আমাদের এখানে ২-৩ বছরেই অকেজো হয়ে যায়। এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। আমাদের অনেক গবেষণায় দ্রুত পচনশীল দ্রব্য ব্যবহা করতে হয়। বর্তমানে এসব কেমিক্যাল আমদানি জটিল ও সময়সাপেক্ষ এ প্রক্রিয়াকে সহজ করতে হবে। আর এই গবেষণাগুলো একজন গবেষকের নির্বিঘ্নে গবেষণার জন্য যাতাশাতসহ যা যা প্রয়োজন সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একজন প্রবীণ গবেষক হিসেবে গবেষণা সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। আপনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কোন অবস্থানে দেখতে চান এবং ইউজিসির একজন সদস্য হিসেবে এক্ষেত্রে কি ধরনের ভূমিকা রাখতে চান?
প্রফেসর ড. হাসিনা খান: আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আন্তর্জাতিক র্যাংকিংয়ে অত্যন্ত পিছিয়ে রয়েছে। র্যাংকিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসবে এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত হবে এটিই প্রত্যাশা। আর দায়িত্বশীল জায়গা থেকে আমার চেষ্টা থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এই অবস্থানে যেতে যথাসম্ভব সহযোগিতা করা। আমাদের দেশে গবেষণাখাতে যে সংকটগুলো রয়েছে সেই সংকটগুলো কাটিয়ে কাঙ্ক্ষিত গবেষণাবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলা।