০৬ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৩৪

ছোটবেলায় পুলিশকে ভয় পেতাম, এখন পুলিশ ক্যাডারেই সুপারিশপ্রাপ্ত

মো. সুজনুর ইসলাম সুজন  © টিডিসি ছবি

মো. সুজনুর ইসলাম সুজন। সদ্য প্রকাশিত ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাবেক এই শিক্ষার্থী। তিনি ২০১৩-১৪ সেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স এন্ড ক্লাইমেট রেসিলেন্স বিভাগে ভর্তি হয়ে পরবর্তীতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে একই বিভাগ থেকে ২০১৮ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। 

বর্তমানে সুজন দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। এর আগে তিনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ-এ কর্মরত ছিলেন। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন, পরামর্শ ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফাতেমা-তুজ-জিনিয়া—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কখন থেকে বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করেছিলেন?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: মূলত স্নাতক সম্পন্ন হওয়ার পরেই প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। স্নাতকোত্তরের মাঝামাঝি সময়ে এসে ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স কেনার মাধ্যমে আমার বিসিএস এর যাত্রা শুরু হয়।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এটা আপনার কততম বিসিএস ছিল?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: ৪১তম বিসিএস আমার দ্বিতীয় বিসিএস ছিল। ৪০তম বিসিএসে আমি নন-ক্যাডারে ছিলাম। ৪৩তম এবং ৪৪তম বিসিএস লিখিত দিয়েছি রেজাল্ট এখনো হয়নি। আর ৪৫তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। এখন যেহেতু ৪১তম বিসিএসের পুলিশ ক্যাডার উত্তীর্ণ হয়েছি আর অংশগ্রহণ করা হবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রিলি, ভাইভা ও রিটেন নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা বলুন?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: ৪০ তম বিসিএসেই খুব ভালো প্রিপারেশন থাকার কারণে আমার ৪১তম বিসিএস প্রিলি এবং রিটেন পরীক্ষা নিয়ে খুব একটা টেনশন করতে হয়নি। আত্মবিশ্বাস ছিল আমি ভালো করব এবং আলহামদুলিল্লাহ আমি ভালো করেছি। এই আত্মবিশ্বাসটা আসলে খুব প্রয়োজন ছিল যে আমি পারবো। অবশ্য ভাইবাটা আশানুরূপ হয়নি। সম্পূর্ণ ভাইবা ইংরেজিতে হয়েছিল এবং আমার ইংরেজি ফ্লুয়েন্সি একটু কম থাকার কারণে নিজের কছে ভাইবা খুব একটা সন্তোষজনক হয়নি। তবে স্যাররা যা জিজ্ঞেস করেছেন সহজ বোধগম্য ইংরেজি ভাষায় ব্যাখ্যা করেছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এমন কোনো অভিজ্ঞতা আছে যা আপনাকে সফল হতে প্রেরণা দিয়েছিল?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: তেমন অভিজ্ঞতা বলতে, ডিপার্টমেন্টে আমার একজন বন্ধু ছিল, তারেক নাম। আমরা একসাথেই বিসিএস জার্নি শুরু করেছিলাম। কিন্তু মাঝপথে একটা দুর্ঘটনায় হঠাৎ আমার বন্ধু পৃথিবীর ছেড়ে চলে যায়। ওর খুবই ইচ্ছে ছিল বিসিএস ক্যাডার হবার, কিন্তু  মাঝপথেই ওর যাত্রা শেষ হলো। সেখান থেকে আমার মনে একটা অনুপ্রেরণা ছিল ওর অদম্য স্বপ্নটা আমার মাধ্যমে পূরণ করি। আর এছাড়া বাবা-মা আমার ভাইদের অনুপ্রেরণা তো ছিলই। তবে আমি নিজেকে এখনই সফল বলতে চাই না শুধু সফলতার একটি ধাপ অতিক্রম করেছি মাত্র। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই বিশ্বাসটা সর্বসাধারণের মাঝে নিয়ে আসে এবং সম্পূর্ণরূপে নিজেকে জনসেবায় নিয়োজিত করতে পারলেই নিজেকে সফল হিসেবে মেনে নিতে পারব।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: চাকরি আর বিসিএসের প্রস্তুতি একইসময়ে কিভাবে সামলেছিলেন?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: চাকরির পাশাপাশি বিসিএস এর প্রিপারেশন নেওয়া একটু কঠিন। তবে কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সফল হওয়া সম্ভব। চাকরিকালীন আসলে দিনের একটা বড় সময় আপনি বাসার বাহিরে থাকবেন। সে ক্ষেত্রে আপনি খুব একটা সময় পাবেন না প্রস্তুতি নেওয়ার। সে ক্ষেত্রে আমি ছোট ছোট যে সময়গুলো পাওয়া যেত সেগুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করতাম। যেমন বর্তমানে আমি দুদকের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত থাকলেও, ৪১তম বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি চলাকালীন সময়ে আমি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের সহকারী পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। বাসা থেকে অফিস কিছুটা দূরে হওয়ায় অফিসে যাবার এবং আসার সময় গাড়িতে যে সময়টা পাওয়া যেত ওই সময়টাতে আমি ওইদিনের পত্রিকা পড়ে ফেলতাম যার কারণে আমি সাম্প্রতিক বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকতাম। তাছাড়া বিসিএস সহায়ক ছোট ছোট হ্যান্ডবুক যেমন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, সংবিধান এইগুলো সব সময় আমার সাথে রাখতাম। সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে বাসায় আসার পর যতই টায়ার্ড লাগুক এক ঘন্টা হলেও আমি পড়াশোনা করতাম। বিসিএসে সিলেবাস অনেক বড় হওয়ায় নিয়মিত চর্চা না থাকলে ভুলে যাবার একটা সম্ভাবনা থাকে। তাই নিয়মিত কমপক্ষে এক ঘন্টা পড়ার কারণে আমি নিয়মিত চর্চার ভিতরে থাকতে পারতাম, যা আমাকে সফল হতে সাহায্য করেছে বলে আমি মনে করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: জীবনের মূলমন্ত্র/ লক্ষ্য কী ছিল আপনার? 
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: জীবনের মূলমন্ত্র বা লক্ষ্য যে বিসিএস ক্যাডার হওয়াই ছিল এরকমটা বলব না। ছোটবেলায় অন্য দশ জনের মতই আমারও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু মেডিকেল বা বুয়েটে কোথাও সুযোগ হয়নি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় এসে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছা ছিল তবে সেখানেও পর্যাপ্ত সিজিপিএ ছিলো না। তারপরে মূলত বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করার মাধ্যমে জনসেবায় নিজেকে নিয়োজিত করার একটা লক্ষ্য ঠিক করি। আলহামদুলিল্লাহ ৪১তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হওয়ার মাধ্যমে সেই লক্ষ্যের একটি ধাপ পূরণ হলো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে কোনো স্মৃতি আছে কী?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে তো অনেক ধরনের স্মৃতিই আছে, কিন্তু সেগুলো বিসিএস রিলেটেড নয়। তবে একটা মজার বিষয় হলো, ছোটবেলায় কিন্তু আমি পুলিশ একটু ভয় পেতাম। আমি একটু দুষ্টু প্রকৃতির ছিলাম তাই ছোটবেলায় কোন দুষ্টুমি করলেই মা এবং পরিবারের সদস্যরা পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার একটা ভয় দেখাতো। অথচ এখন আমি নিজেই পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কখনও কোনো কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়েছিলেন? হতাশাগ্রস্ত হলে সেই হতাশা কাটিয়ে উঠতে কি করতেন?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: জীবনে তো অনেক কারণেই হতাশাগ্রস্থ হয়েছি। সবাই হয়।  কিন্তু আমার একটা বিষয় হচ্ছে আমি কখনো হতাশা পুষে রাখি না। অতীত নিয়েও খুব একটা ভাবি না। ছোট্ট একটা জীবন। এতটুক জীবনে অতীত ,হতাশা ভেবে সময় নষ্ট করাটা আমার জীবনদর্শনে নাই। জীবনকে উপভোগ করা, সব সময় হাসি-খুশি থাকা পছন্দ করি। জীবনে খারাপ-ভালো যাই ঘটুক তা অভিজ্ঞতা হিসেবে মাথায় রাখি এবং আলহামদুলিল্লাহ বলে ভবিষ্যতে মনোযোগ দেই।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএসে একাডেমিক ফলাফল কিংবা স্নাতকের সাবজেক্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ বলো মনে হয়?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: বিসিএস প্রিলি বা রিটেন পরীক্ষায়  স্নাতকের ফলাফল খুব একটা প্রভাব রাখে না‌। বিসিএস সার্কুলারে বর্নিত ন্যূনতম ফলাফল থাকলেই অংশগ্রহণ করা যায়। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত, স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ভালো ফলাফল বিসিএস ভাইবাতে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়ায়। আর তাছাড়াও নিজের সাবজেক্ট সম্পর্কে ভালো নলেজ থাকলে, বিসিএস ভাইবা বোর্ডেও একটা ভালো ইমপ্রেশন ক্রিয়েট করা যায়, যা আপনাকে ভাইভাতে ভালো মার্ক পেতে সহায়তা করবে। তাই স্নাতক পর্যায়ে নিজ বিষয়ে ভালো ফলাফল এবং নিজ বিষয় সম্পর্কে ভালো জ্ঞান থাকা খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? 
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: যেহেতু আমি বিসিএস পুলিশ ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি এখন আমার পরিকল্পনা নিজেকে একজন আদর্শ পুলিশ ‌কর্মকর্তা হিসেবে গড়ে তোলা। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই‌ বিশ্বাস আরো দৃঢ়ভাবে জনগণের মাঝে স্থাপন করা। অপরাধ দমন ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার মাধ্যমে জনসেবায় সর্বদা নিজেকে উজাড় করে দেওয়াই আমার একমাত্র ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস দিতে ইচ্ছুকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কি?
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখা যতটা সহজ; এ স্বপ্ন পূরণ ততটা বন্ধুর । এর জন্য পরিশ্রমের যেমন প্রয়োজন রয়েছে তেমনি কৌশলীও হতে হয়। তাই আপনার জীবনের লক্ষ্য যদি হয় বিসিএস, তবে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান আর বাংলার দুর্বলতাগুলো সর্বোচ্চ শ্রম দিয়ে হলেও কাটাতে হবে, কারণ এগুলোই বিসিএসের নির্ধারণী বিষয়। 

নিয়মিত পত্রিকা পড়া, বিশেষ করে সম্পাদকীয়, উপ-সম্পাদকীয়, অর্থনীতি ও বিশ্ব রাজনীতি বিষয়ক আর্টিকেল। খেলা দেখা, মুভি দেখা, ঘুরতে যাওয়া, সমসাময়িক বিভিন্ন ইস্যুতে বন্ধুদের সাথে আলোচনা করার অভ্যাস রাখা উচিত। মানসিক দক্ষতা বাড়ানোর জন্য  পড়াশোনা ও এক্সটা-কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির অভ্যাস রাখার বিকল্প নেই।

বিসিএস পরীক্ষার জন্য অনেকেই কোচিং করে থাকেন, তবে আমার পরামর্শ কোচিং না করে নিজে নিজেই প্রস্তুতি নেয়া। কোচিংয়ে আসলে সবাইকে এক মাপকাঠিতে পড়ানো হয়। কিন্তু সবার একরকম দুর্বলতা  নাও হতে‌ পারে। তাই আপনি যে বিষয়ে দুর্বল সে বিষয়ের জন্য আপনার বেশি সময় এবং পরিকল্পনা রাখা উচিত। নিজেকে যদি সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে প্রস্তুত করা যায় তাহলে অনেক সময় বেঁচে যাবে। আমি নিজেও কোচিং করি নি যা আমাকে নিজের মত গুছিয়ে  পড়ার অনেক সুযোগ দিয়েছে। তবে আপনার যদি একান্তই মনে হয় পারবেন না সে ক্ষেত্রে কোচিং করতে পারেন। 

আর বিসিএস প্রস্তুতির জন্য গ্রুপ স্টাডি বেশ সহায়ক হতে পারে। তবে গ্রুপ স্টাডির ক্ষেত্রে কাদের নিয়ে গ্রুপ করবেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ। গ্রুপ স্টাডি করতে গিয়ে আপনি যাতে লক্ষ্যচ্যুত না হন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ভালো একটা গ্রুপ করতে পারলে প্রস্তুতি অনেক নিখুঁত এবং সহজ হবে। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো অপশনসহ ভালোমতো পড়তে হবে। আমি এই কাজগুলো করার কারনেই বোধহয় আজকে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে যোগদানের সুযোগ পেয়েছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে অসংখ্যা ধন্যবাদ।
মো. সুজনুর ইসলাম সুজন: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভকামনা। ধন্যবাদ।