২৩ জুন ২০২৩, ০০:০৫

শিক্ষা এখন সামাজিক বিভাজনে সহায়তা করছে

অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী  © ফাইল ছবি

তিনি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন কার্ল মার্ক্স, শ্রেণি সংগ্রাম, মানব মুক্তি, সামাজিক সাম্য ও মানবের কল্যাণে অকপটে সত্য উচ্চারণে। অন্য সব পরিচয়কে ছাপিয়ে তিনি স্বস্তিবোধ করেন একজন সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিতে। সমাজতন্ত্রের প্রতি তার অপার দুর্বলতার পাশাপাশি রয়েছে প্রশ্নহীন পক্ষপাতও। তিনি সবসময়ই সরব শিক্ষা, সংস্কৃতি, বাকস্বাধীনতা, মানবাধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধেও। তিনি সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আজ ৮৮তম জন্মদিন তার।

বয়স, বার্ধক্য আর সময়ের হিসেবকে পাশ কাটিয়ে চেতনা আর বুদ্ধিজীবীতার প্রশ্নে এখনো চির তারুণ্য ছুঁয়ে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে। জন্মদিনে পাঁচ দশকের বাংলাদেশ, শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক উন্নতি এবং সামাজিক নানা পরিবর্তনসহ বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা, শিক্ষাঙ্গন ও তারুণ্যের গল্পে সাজানো পূর্ণাঙ্গ নিউজ-পোর্টাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। পাঠকদের জন্য সে গল্প-আলাপ তুলে ধরেছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের নিজস্ব প্রতিবেদক খাঁন মুহাম্মদ মামুন-

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর পাঁচ দশকে শিক্ষার হার ৭৪.৬ শতাংশকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: শিক্ষার হার তো শতভাগ হওয়া দরকার ছিল; এটি ৭৪.৬ শতাংশ হয়েছে—ভালো খবর। কিন্তু, এটি শতভাগ হওয়ার দরকার ছিল। দ্বিতীয়ত, যে সংখ্যা প্রকাশ করা হয়, তা অক্ষরজ্ঞান সম্পন্নতার; এটি তারা নিয়মিত চর্চা না করার কারণে আবার ভুলেও যায়। এখন আমাদের শতভাগ শিক্ষা নিশ্চিত করা দরকার এবং চর্চা অব্যাহত রাখা দরকার।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষার পরিমাণগত পরিবর্তন হয়েছে, গুণগত কতটুকু পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটা তো জানা কথা শিক্ষার গুণগত উন্নতি হচ্ছে না। এই যে ভর্তি পরীক্ষাগুলো হয়, সেখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী পাশ করতে পারে না। তারা আসন পাবে বা না পাবে—তা পরের বিষয়; তাদের পাশ না করা তো জরুরী। আর কর্মসংস্থান না হওয়ার বিষয়টি বিচ্ছিন্ন নয়। শিক্ষার পর কর্মসংস্থান নিশ্চিত না হলে শিক্ষার্থীরা আগ্রহ হারাবে। শিক্ষার্থীরা যখন দেখে শিক্ষা তাদের কর্মসংস্থান, জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করতে পারছে না, তখন তারা শিক্ষা বিমুখ হবে এবং তখন শিক্ষার গুনগত মান অর্জন করা যাবে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সাম্প্রতিককালে পাঠ্যপুস্তকে ভুল, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে বিতর্ক, প্রাথমিকের বৃত্তির ফলাফল নিয়ে দায়িত্বশীলদের উদাসীনতা-শিক্ষা আসলে কতটা পরিকল্পিত পথে এগোচ্ছে?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এখন আমাদের শিক্ষায় আমরা সামনে এগিয়ে না গিয়ে বরং আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এখানে এখন তিন ধারার শিক্ষা চলমান রয়েছে। এখন এখানে নতুন শিক্ষাক্রম শুধু একটি মাধ্যমে (বাংলা মাধ্যম) পরিবর্তন আনবে। ইংরেজি মাধ্যম এবং মাদ্রাসায় এটি কোনো পরিবর্তন আনবে না। এখন বাংলা মাধ্যমে এসব বিশৃঙ্খলা এটি খুব অন্যায়। দ্বিতীয়ত, পরীক্ষা বাহুল্য কমানো দরকার। কেন এতো বেশি পরীক্ষা নেওয়া হয়—দুটো পাবলিক পরীক্ষা বাদ দেওয়া হয়েছে; যেগুলোর আদৌ কোনো দরকারই ছিল না। পাবলিক পরীক্ষা তো হওয়া দরকার শুধুমাত্র স্কুল শেষ করার পর।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আমাদের স্বাধীনতার অন্যতম মূল মন্ত্রই ছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার—পাঁচ দশকের বাংলাদেশে এখনো আমরা সকলকে শিক্ষার আওতায় আনতে পারিনি। তাহলে, আসলে সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার কতটুকু নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে?

আমাদের মুক্তির অন্যতম আকাঙ্ক্ষাই ছিল সামাজিক একটি রূপান্তর ঘটবে, সমাজে গণতান্ত্রিক ধারা শুরু হবে। রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হবে—যেখানে মানুষের সাথে অধিকার এবং সুযোগের সমন্বয় থাকবে। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটবে এবং প্রকৃত জনপ্রতিনিধিদের হাতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ থাকবে—তা হয়নি। বরং অধিকার এবং সুযোগ; অধিকারের কথা সংবিধানে উল্লেখ করা হয়েছে, কিন্তু সমাজ অসম্ভব বৈষম্য পূর্ণ হয়েছে। এর কারণ যে ধারাটি ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তান আমলে ছিল—সে ধারাটিই এখন আরও প্রকট হয়েছে; সেটি হচ্ছে উন্নয়নের ধারা এবং সে ধারাটি হচ্ছে পুঁজিবাদী ধারা। এই পুঁজিবাদী ধারা বৈষম্য সৃষ্টি করবে, এই পুঁজিবাদী ধারা বেকারত্ব সৃষ্টি করবে। একই সাথে এই পুঁজিবাদী ধারা দেশপ্রেমের যে চর্চা তা বাড়াবে এবং বিচ্ছিন্নতা তৈরি করবে। কাজেই এই পুঁজিবাদী উন্নয়ন আমাদের জন্য অভিশাপ; এজন্য আমরা স্বাধীনতা অর্জন করিনি। আমাদের স্বাধীনতা ছিল আমরা গণতান্ত্রিক একটি সমাজ কাঠামো চাইবো, যার লক্ষ্য হবে একটি সমাজতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: না, সেটি আসলে করা সম্ভব হয়নি। আমাদের মুক্তির যে স্বপ্ন সেটি কেবল পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসা না, কেবল স্বাধীনতা না। সে লক্ষ্যে না গিয়ে আমরা ঐ আগের পথেই চলছি। বাংলাদেশ এক সময় ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল, এরপর পাকিস্তানিদের উপনিবেশ হলো—এখন বাংলাদেশ নব্য ধনীদের উপনিবেশ হয়েছে। যেখান থেকে ধনীরা আমাদের পূর্ব উপনিবেশে টাকা পাঠাচ্ছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: উচ্চশিক্ষিত বেকার বাড়ছে, তাহলে আমার উচ্চশিক্ষা কতটা পরিকল্পিত পথে রয়েছে? যেখানে বিদেশে থেকে এক্সপার্ট আনতে হচ্ছে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: বিশেষজ্ঞ তৈরি করতে হবে—এটি অবশ্যই ঠিক। নিয়োগের ক্ষেত্রে দেশীয়দের প্রাধান্য দিতে হবে এবং আমাদের লোকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে; এটি দেশপ্রেমের অংশ। এখন বাইরে থেকে এক্সপার্ট আনা সহজ এবং এর সাথে আর্থিক বিষয়ও জড়িত থাকে। আর আরেকটি বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশের লোকদের মধ্যে অনেক দক্ষ লোক আছে বাইরে। তাদের আনতে উৎসাহ দেওয়া হয় না। এখন দেশপ্রেম জিনিসটা কমে গেছে। ১৯৪৭ এর দিকে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংকট ছিল, তখন বাইরে থেকে খুঁজে খুঁজে শিক্ষক নিয়ে আসা হয়েছে—এখন তা করা হচ্ছে না।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বা উন্নতি তার কতটুকু পরিবর্তন হয়েছে এবং সর্বস্তরে মাতৃভাষা যে দাবিতে ভাষা আন্দোলন হয়েছে, তার কতটুকু প্রভাব আমরা ধরে রাখতে পেরেছি?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: এটি খুব অন্যায় এবং অপ্রত্যাশিত। আমরা তো মাতৃভাষার মাধ্যমে এক ধারার শিক্ষা নিশ্চিত করবো—এটি আমাদের আকাঙ্ক্ষা ছিল। তিন ধারার শিক্ষা ব্রিটিশ আমলে ছিল, পাকিস্তান আমলে বেড়েছিল; কিন্তু বাংলাদেশ সময়ে এসে এটি আরও প্রকট হবে তা প্রত্যাশিত ছিল না। শিক্ষায় বৈচিত্র‌্য থাকবে, বিভিন্ন ধারা থাকবে—কিন্তু কোনো বৈষম্য থাকবে। এখন যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে তা মূলত শ্রেণি বৈষম্য; এটি হওয়ার কথা ছিল না এবং সে শ্রেণি বৈষম্যকে সহায়তা করছে শিক্ষা। তার মানে সমাজে শ্রেণি বিভাজন কমেনি বরং বেড়েছে। শিক্ষার মাধ্যমে আমরা সামাজিক ঐক্য না এনে সামাজিক বৈষম্য তৈরি করছি; এটি  খুব হাস্যকর এবং করুণও বটে। তারপরও এটি বাস্তব; সে বাস্তবতা হচ্ছে, অর্থনৈতিক বাস্তবতা। এখন আমরা অর্থনৈতিক বিভাজন দেখছি এবং সে বিভাজনে সহায়তা করছে শিক্ষা।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: সামগ্রিক মূল্যায়নে দেশের শিক্ষা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাধান এবং দেশের শিক্ষা নিয়ে আপনার স্বপ্ন কী?

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: পরিবর্তনের জন্য সংঘটিত কোনো আন্দোলন আমি দেখতে পাচ্ছি না। আশার কথা হচ্ছে, মানুষ বুঝতে পারছে। এই সমস্যা বা যে সংকট তা শুধু বাংলাদেশের না—এটি এখন একটি বৈশ্বিক সংকট। সম্পদের মালিকানা ব্যক্তি মালিকানায় থাকবে নাকি সামাজিক মালিকানায় থাকবে—সে প্রশ্নের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। সামাজিক মালিকানার ইতিহাস হচ্ছে সভ্যতার ইতিহাস; হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের সভ্যতার যে অগ্রগতি—আদি, সামন্ত, দাস ব্যবস্থা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে ব্যক্তি মালিকানার ইতিহাস তা পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে। এখন যত উন্নয়ন, তত বৈষম্য বৃদ্ধি এবং যেসব সংকট আসে, যুদ্ধ বলি, মহামারী বলি—সেখানে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা অস্ত্র বিক্রি করে, মাদক ব্যবসায়ীরা মাদক বিক্রি এবং তারা ধনী হয়। সমাজে বৈষম্য বাড়ে। কাজেই পুরো বিশ্বব্যাপীই এখন এটি দেখার বিষয় যে, তারা কোন দিকে যাবে— পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গিয়ে পৃথিবীকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে? নাকি সামাজিক মালিকানায় গিয়ে সকলের অধিকার প্রতিষ্ঠা করবে? আমার মনে হচ্ছে, পৃথিবীর সকল সমাজকেই এই একই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে হবে।  

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনাকে ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ।