সাক্ষাৎকারে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী
‘এখন সব শিশুই স্কুলে যাচ্ছে’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৯ জুন ২০১৮, ০১:৪০ PM , আপডেট: ০৯ জুন ২০১৮, ০৬:৪৩ PM
রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব অ্যাডভোকেট মোস্তাফিজুর রহমান ফিজার। ১৯৮৬ সাল থেকে তিনি দিনাজপুর-৫ আসন থেকে টানা ৬ বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি থেকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষামন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। মন্ত্রণালয়ের সাফল্য, চলমান অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
- প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত বলবেন?
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই’। সোনার মানুষ তৈরির মূল শর্ত মানসম্মত শিক্ষা। এ সত্যটি উপলব্ধি করে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ এবং ১ লাখ ৫৭ হাজার ৭৪২ শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করেন। তারই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। পর্যায়ক্রমে ১ লাখ ৩ হাজার ৮৪৫ শিক্ষকের চাকরি সরকারীকরণ করা হয়।
- শিশুদের বছরের প্রথম দিন নতুন বই প্রদান করে কতটুকু সাড়া পেয়েছেন?
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে বছরের প্রথম দিন নতুন বই প্রদান করা একটি উৎসবে পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকার ৯ বছরের মধ্যে একবারও তা দিতে ব্যর্থ হয়নি। আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধের মধ্যেও বই দেওয়া বন্ধ হয়নি। আমরা কোনো কিছুর অজুহাত দেখাইনি। শিক্ষা নিয়ে সরকারের যে ভাবনা সেখানে একটা পরিবেশ তৈরি করার জন্য, অর্থাৎ সরকার যে আন্তরিক সেটা জাতিকে বোঝানোর জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছি প্রতিনিয়তই।
- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানদের মাতৃভাষায় বই প্রদানের উদ্দেশ্য কী?
পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। সেজন্য দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। চাকমা-মারমা-গারোসহ পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, পাঠদানও করা হচ্ছে। সাঁওতালদের জন্যও আরেকটি করতে যাচ্ছি। সেটার যাচাই-বাছাই চলছে।
- শিক্ষানীতিতে প্রাথমিক শিক্ষাকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা রয়েছে, সেটা কবে বাস্তবায়ন হবে?
শিক্ষানীতিতে বলা আছে, অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে গণ্য হবে। এর মধ্যে প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত আট বছর। এর আগে আরেকটা থাকবে প্রাক-প্রাথমিক, যা এক বছর। সব মিলিয়ে ৯ বছরের। যখন সেটা একটা নীতিমালার মধ্যে এসেছে সেটা বাস্তবায়ন অবশ্যই হবে। অতএব ভরসা রাখতে পারেন।
- শিশুদের ঝরে পড়ার চিত্রটা কেমন?
আমি এখানে আসার আগে শুনেছিলাম আমাদের শিশুদের ঝরে পড়ার হার ছিল শতকরা ৫০ শতাংশের নিচে। ২০০৬ সালে সেটা ছিল ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ। বর্তমানে বলা হচ্ছে ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশের নিচে। কিন্তু বাস্তবে আমি তা আরও কম মনি করি। এখন যেসব শিশু জন্ম নিচ্ছে সবাই স্কুলে যাচ্ছে, তাই ঝরে পড়ছে না। কামার-কুমার-জেলে-নাপিতসহ নিম্ন আর মধ্যম আয়ের পরিবারের সবাই চাচ্ছে তারা অশিক্ষত হলেও তাদের সন্তানকে শিক্ষিত করতে। কারণ আমি কামার-কুমার হলেও সন্তান যেন শিক্ষিত হয়- এ বোধ থেকে। অর্থাৎ লেখাপড়া না করা মানুষের দুঃখ-বেদনাটা এ জাতি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এক সময় আমরা অশিক্ষা-কুশিক্ষার মধ্যে ছিলাম, এখন সেখান থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের যে সূর্যোদয় তথা বাংলাদেশ হয়েছে। বাংলাদেশ হয়ে জাতির জনক আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন। আমরা এখন অনাগত উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছি।
- শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?
একটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা চিরস্থায়ী করতে গেলে সে দেশের সব জনগণকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করে মানবসম্পদে যদি পরিণত করা না যায়, তাহলে স্বাধীনতা ছিনতাইও হয়ে যেতে পারে যে কোনো সময়। কাজেই লাখ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা সেটাকে অর্থবহ করার জন্য এবং অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে ত্বরান্বিত এবং শক্তিবৃদ্ধির জন্য একটি বিজ্ঞান-প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক সুশিক্ষিত জাতি গঠনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে উদ্যোগ ছিল সেটাকে আমরা প্রাণপণে এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছি। এভাবে সোনার বাংলা তৈরি হওয়া সম্ভব।
- পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, সেটা আপনি কী মনে করেন?
হ্যাঁ, এটা ঠিক। আমাদের তো অনেককিছু নিয়ে বিতর্ক আছে। বিতর্ক রয়েছে আমরা সা¤প্রদায়িক না অসা¤প্রদায়িক, ধর্মান্ধতা না ধর্মনিরপেক্ষতা। এরকম সব বিষয়ে বিতর্ক আছে। আমি গ্রামের মানুষ হিসেবে বলছি, গ্রামে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে এধরনের বিতর্ক হয় না। হয় শুধু শহরে-বন্দরে। যারা করে তারা হয়তো কোনো একটা চিন্তাভাবনার একটা জায়গা থেকে করেন। আগেও তো বৃত্তি পরীক্ষা ছিল পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে।
- আগামী শিক্ষা আইনে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে কোনো আইনের কথা ভাবছে সরকার?
আগামীতে যে শিক্ষা আইন হতে যাচ্ছে, সেটাতে হয়তো থাকতে পারে, যদি হয় তাহলে আপনারা দেখবেন। তবে আমরা কোচিংয়ের ব্যাপারে সবাইকে নিরুৎসাহিত করি। ক্লাসের শিক্ষকরা ক্লাসের মধ্যেই সব বুঝিয়ে দেবেন।
- ঢাকা শহরে নামিদামি স্কুলে শিশুদের ভর্তি করাতে অভিভাবকরা নানা প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হন, সেটা নিয়ে আপনি কী করেন?
আমাদের অভিভাবকদের মাইন্ড সেট করতে হবে। এক সময় সরকারি প্রাথমিকে যারা পড়েছেন বর্তমানে তারাই তো দেশ পরিচালনা করছেন। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়া হয় না তা নয়। অভিভাবকরা তাদের ছেলেমেয়েদের সরকারি প্রাথমিক স্কুলে বিনা বেতনে পড়ালে অনেকেই বিষয়টি অন্য চোখে দেখেন। তবে এখন ধীরে ধীরে আমাদের জ্ঞান বাড়ছে, আমরাও বুঝতে পারছি।
- শিক্ষাব্যবস্থায় পাঠ্যক্রম প্রণয়নের অন্যতম উদ্দেশ্য কী?
আমরা একটা আধুনিক, বিজ্ঞানমনস্ক ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করেছি। এসবের সঙ্গে কোনো মন্ত্রী বা সচিব জড়িত ছিলেন না। একদল বিশেষজ্ঞ মিলে এটা এমনভাবে করেছেন, যাতে ছেলেমেয়েরা মুক্তবুদ্ধির মানুষ হয়ে উঠতে পারে। যাতে তারা পুরোপুরি বিকশিত হয়ে ওঠে।
- সহ-শিক্ষামূলক কার্যক্রমের মধ্যে কী কী কার্যক্রম চালু রয়েছে?
আমাদের ছেলেমেয়েরা শুধু কেন পড়াশোনার মধ্যে থাকবে। এজন্য সহ-শিক্ষামূলক অনেক কার্যক্রম চালু রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, খেলাধুলা, ডিবেট এবং নানা ধরনের বিনোদন। তাছাড়া আমাদের ছেলেমেয়েদের হারিয়ে যাওয়া খেলাধুলাগুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য চেষ্টা করছি। অর্থাৎ আমাদের ছেলেমেয়েদের আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার জন্য পরিবেশ তৈরি করে দিচ্ছে। আমাদের স্কুলগুলোতে সেভাবে অবকাঠামোগত উন্নতি করার চেষ্টা করছি। যেখানে আমাদের ছেলেমেয়েরা তাদের স্কুলকে যেন বাড়ির চেয়েও আনন্দের এবং শেখার জায়গা মনে করে।
- প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির প্রদান সম্পর্কে বলবেন?
প্রাথমিক শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রকল্পের আওতায় বর্তমানে শতভাগ শিক্ষার্থীকে বিবেচনায় আনা হয়েছে। এরই মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের পিইসির সভায় উপবৃত্তি প্রকল্পটি ২০২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। ১ কোটি ৩০ লাখ উপকারভোগীর সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৭৮ লাখ। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাকে প্রকল্পের আওতায় আনা হয়েছে। তাছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা ২০১৫ এর ফলের ওপর ভিত্তি করে বৃত্তির সংখ্যা ৫৫ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৮২ হাজার ৫০০ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। অথচ ২০০৬ সাল দেশের ৪৫ শতাংশ গরিব মেধাবী শিক্ষার্থীকে (সিটি করপোরেশন এবং পৌরসভা ব্যতীত) উপবৃত্তি প্রদান করা হতো।
- বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর উদ্দেশ্য কী?
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুভর্তির হার বৃদ্ধিকরণ, উপস্থিতির হার বাড়ানো, ঝরে পড়ার হার হ্রাসকরণ এবং শিক্ষার গুণগতমান বৃদ্ধির লক্ষ্যে মিড ডে মিল চালুর ব্যাপারে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের আর্থিক সহায়তায় মিড ডে মিল চালু করা হয়েছে। আগামীতে এটা সব বিদ্যালয়ে চালু করার জন্য পদক্ষেপ নেব, এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অভিভাবকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা প্রয়োজন।
- জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য আপনাদের লক্ষ্য কী থাকবে?
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) এবং সবার জন্য শিক্ষার (ইএফএ) লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২ অনুযায়ী ২০১৫ সালের মধ্যে সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার ঘোষণা থাকলেও ২০১৪ সালের মধ্যেই সরকার এ লক্ষ্য অর্জনে প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ছিল। সে প্রতিশ্রæতি অনুযায়ী ২০১১ সালের মধ্যে স্কুল গমনোপযোগী শতভাগ শিশুর স্কুলে ভর্তির নিশ্চিত করা হয়েছে। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের পর জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০৩০ সালের মধ্যে সব ছেলেমেয়ের জন্য সম্পূর্ণ অবৈতনিক, যথার্থ ও মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।