সাক্ষাৎকারে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
‘উন্নত বিশ্বে গ্রন্থাগারের কদর অনেক বেশি’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ০৯ জুন ২০১৮, ০১:১২ PM , আপডেট: ১২ জুন ২০১৮, ০৪:৫০ PM
গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন সরকারি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে এ প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন সরকারের অতিরিক্ত সচিব আশীষ কুমার সরকার। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য, চলমান অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন তিনি।
- দেশে লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার সেক্টরের বর্তমান চিত্রটি তুলে ধরবেন?
সমাজ নিরক্ষরতা দূরীকরণ, স্বশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি, সামাজিক ও গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধের বিকাশ এবং সর্বোপরি আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গ্রন্থাগারের ভূমিকা অপরিসীম। উন্নত বিশ্বে গ্রন্থাগারের কদর অনেক বেশি, সে তুলনায় আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। দেশে একটা সময় এ সেক্টরটি অবহেলিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে। এ সেক্টরকে এগিয়ে নিতে মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিব শুরু করে সবাই খুবই আন্তরিকভাবে কাজ করছেন। এ সেক্টরের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আলোকিত বাংলাদেশ গড়া।
- বিভিন্ন ধরনের গ্রন্থাগার সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেবেন?
গ্রন্থাগার বেশ কয়েক ধরনের থাকে। যেমন- জাতীয় গ্রন্থাগার, গণগ্রন্থাগার, একাডেমিক গ্রন্থাগার প্রভৃতি। একেকটি গ্রন্থাগারের কাজ একেক ধরনের। যেমন- জাতীয় গ্রন্থাগারে আর্কাইভস সংরক্ষণ করা হয়। সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলও সেখানে সংরক্ষিত থাকে। তাই সেখানে এমন কিছু উপকরণ আছে, যা সবাইকে দেওয়া যায় না। আর আমাদের গ্রন্থাগারটি হচ্ছে গণগ্রন্থাগার। যেখানে শিক্ষার্থী-গবেষকরা পড়াশোনা করতে আসে আর তাদের প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা থাকে।
- গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেবেন?
গণগ্রন্থাগারের সর্বোচ্চ পর্যায় হচ্ছে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। এটি রাজধানীর শাহবাগে অবস্থিত। পুরোপুরি সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী পরিচালিত হয়। এটি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এখান বিভাগ, জেলা ও উপজেলাভিত্তিক গণগ্রন্থাগারগুলো পরিচালিত হয়। এটার পাশেই রয়েছে সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার।
- সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগার সম্পর্কে সংক্ষেপে ধারণা দেবেন?
সারা দেশে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ৭০টি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান গণগ্রন্থাগার এটি। এখানে সব বয়সের মানুষের আসার অধিকার রয়েছে। এখানে ব্যবহারকারীদের জন্য আলাদা আলাদা কর্নার রয়েছে। কারও কোনো তথ্যের প্রয়োজন হলে গ্রন্থাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সহযোগিতা করে থাকেন।
- গণগ্রন্থাগারে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়ার অগ্রগতি কেমন?
ডিজিটালাইজেশনের প্রক্রিয়াধীন রয়েছে গণগ্রন্থাগার। আমাদের মুদ্রিত যে বইগুলো আছে তা আমরা ই-বুকে রূপান্তরিত করব। ফলে পৃথিবীর যে কোনো জায়গা অনলাইনে বই পড়তে পারবে। এ বিষয়ে আমরা প্রকল্প হাতে নিয়েছি, যার নাম অনলাইন লাইব্রেরি ম্যানেজমেন্ট প্রকল্প। এটা সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে, আগামীতে বাস্তবায়ন হবে। আমরা আরও বড় প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছি। চট্টগ্রামের মুসলিম ইনস্টিটিউটে সমন্বিত প্রকল্পের (বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার, অডিটরিয়াম, শহীদ মিনার নিয়ে) আওতায় মাল্টিপারপাস কালচারাল প্রজেক্ট নামে একনেক কর্তৃক অনুমোদন গেছে। যাতে ব্যয় হবে ২৩৩ কোটি টাকা। শিগগির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হবে।
- বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারগুলোর বর্তমান অবস্থা কেমন?
বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারগুলো আগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং খুলনায় চারটি বিভাগে ছিল। তাছাড়া নতুন বিভাগ হওয়ার পর সিলেট এবং বরিশালে যথারীতি বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার চালু রয়েছে। সর্বশেষ রংপুর এবং ময়মনসিংহ বিভাগ হয়েছে। এর মধ্যে রংপুর গণগ্রন্থাগারের অনুমোদন গেছে। অচিরেই কার্যক্রম শুরু হবে। তাছাড়া ময়মনসিংহে জনবল সৃষ্টি করা হয়েছে, এখন সচিব কমিটিতে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
- জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের বর্তমান অবস্থা কেমন?
দেশের সব জেলায় সরকারি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। তবে ছয়টি জেলায় নিজস্ব ভবনে গণগ্রন্থাগার ছিল না। তবে বর্তমানে এসব জেলায় নিজস্ব ভবন করার লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তিবায়িত হচ্ছে, যা চলমান। এ বছরের মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
- শিক্ষানীতির আলোকে দেশের প্রতিটি উপজেলায় গণগ্রন্থাগার থাকার কথা রয়েছে, সেটার কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
দেশের উপজেলা পর্যায়ে বর্তমানে দুইটি গণগ্রন্থাগার রয়েছে। উপজেলায় গণগ্রন্থাগার করার জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটির নাম ‘উপজেলা সংস্কৃতি কেন্দ্র’। শিল্পকলা একাডেমি আর গণগ্রন্থাগার একসঙ্গে হবে। জায়গার সংকট হওয়ার কারণে দ্ুইটি একসঙ্গে হবে। এ প্রকল্পটি শুরুর পর্যায়ে।
- বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি কর্মসূচি কি গণগ্রন্থাগারের অধিদপ্তরের অধীনে?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের তত্ত্বাবধানে শুরু হওয়ার পর বর্তমানে এ কর্মসূচি গ্রহণযোগ্য ধারায় চলে এসেছে। এটা পরিচালনা করার জন্য অনেক টাকা দরকার। তাই সরকারের অধীনে চলে এসেছে। এজন্য প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যেটির যাচাই-বাছাইও শেষ পর্যায়ে। এখন অনুমোদনের অপেক্ষায়। এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন সংস্থা হবে গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর।
- এ বছর প্রথমবারের মতো জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস পালিত হবে। দিবসটি উদযাপনের প্রেক্ষাপট তুলে ধরবেন?
এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতো পালিত হল জাতীয় গ্রন্থাগার দিবস। ১৯৫৮ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবলিক লাইব্রেরি নামে প্রথম যে লাইব্রেরিটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে, এ বিষয়টি সামনে রেখে এবং লাইব্রেরির কর্মকান্ডের সঙ্গে যেহেতু ভাষার সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাই ফেব্রুয়ারি মাসে দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। দিবসকে সামনে রেখে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও নানা কর্মসূচি পালন করেন।
- গ্রন্থাগার ব্যবহারে জনগণের সচেতনতা নিয়ে কোন কর্মসূচি নেয়া থাকে?
সচেতনতার জন্য আমরা নানা কর্মসূচি পরিচালিত করি। আমাদের ওয়েবসাইটে অনুপ্রেরণামূলক বার্তা দিয়ে থাকি, ফেইসবুকেও প্রচার করি, বিভিন্ন জেলায় গিয়ে পাঠকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি, সভা-সেমিনার করি। নিজেই যখন বিভিন্ন গণগ্রন্থাগারে যাই, তখন পাঠকদের কাছে গিয়ে কী চায় তারা তা জানতে চাই। তাছাড়া বিভিন্ন জাতীয় দিবসে শিশুদের চিত্রাংকন প্রতিযোগিতারও আয়োজন করি।
- গ্রন্থাগার পেশা সম্পর্কে মানুষের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে? সে বিষয়ে আপনার অভিমত কী?
গ্রন্থাগার পেশা সম্পর্কে আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকেই প্রফেশনাল লাইব্রেরিয়ান বা গ্রন্থাগারিক আর বাজারে বই বিক্রেতাদের একই মনে করে থাকেন। এটা ঠিক না। আবার দেখা যায়, বাংলাবাজার বা নীলক্ষেতের বই বিক্রির দোকানে লাইব্রেরি লেখা থাকে। ওটা তো লাইব্রেরি না, লাইব্রেরিতে কি বই বিক্রি হয়? এটা হবে বই বিক্রির দোকান। আমরা নিজেরাই আলোচনা করে দেখছি, লাইব্রেরি শব্দটি বই বিক্রির দোকানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা ঠিক না। মন্ত্রণালয় যাতে কোন কোন ক্ষেত্রে লাইব্রেরি শব্দটা ব্যবহার করা যাবে, সেটা ঠিক করে দেয়, সেজন্য আলোচনাও করেছিলাম। এটার জন্য প্রয়োজন কেন্দ্রীয়ভাবে নীতিমালা করা। এটা করে নির্দেশনা জারি করতে হবে। বই ব্যবসায়ীরা যখন জানবে এটি নীতিবিরুদ্ধ, তখন তারা এটি আর ব্যবহার করবে না। এ নীতিমালা করলে গ্রন্থাগার পেশায় যারা জড়িত তারা স্বস্তি পাবেন আর জনগণও সঠিক তথ্যটি জানবেন, বিভ্রান্ত হবেন না।
- সব প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে কর্মরতদের লাইব্রেরিয়ান বলা হয়, সেক্ষেত্রে কে নো বিভ্রান্তি রয়েছে কিনা?
স্কুল লাইব্রেরিতে যিনি চাকরি করেন তাকে লাইব্রেরিয়ান বলি, আবার সরকারি কলেজে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা রয়েছেন তাদেরও লাইব্রেরিয়ান বলি। এতে সাধারণ মানুষ স্বাভাবিকভাবে বিভ্রান্ত হবে। আমি তো প্রশাসন ক্যাডারের লোক এবং বাংলা সাহিত্যের ছাত্র। এখানে আসার আগে নিজেও বুঝতাম না, কে কোন পদের লাইব্রেরিয়ান। আমার মতে, লাইব্রেরিয়ান পেশায় যারা রয়েছেন, বিশেষ করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের পদের নামের শেষে কর্মকর্তাটি সংযুক্ত করা দরকার। যেমন- কেন্দ্রীয়ভাবে হলে সেটা হবে গ্রন্থাগার কর্মকর্তা, জেলায় হলে জেলা গ্রন্থাগার কর্মকর্তা এবং উপজেলায় হলে উপজেলা গ্রন্থাগার কর্মকর্তা হবে। বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি।