০৯ জুন ২০১৮, ১৩:০১
‘শিশুদের আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে কাজ করছি’
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি) ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল এনডিসি। তিনি সরকারের অতিরিক্ত সচিব এবং বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডারের সপ্তম ব্যাচের কর্মকর্তা। প্রতিষ্ঠানটির সাফল্য, চলমান অগ্রগতি ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
- প্রাথমিক শিক্ষাকে সরকারীকরণের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বলবেন?
ড. মো. আবু হেনা মোস্তফা কামাল : শিক্ষা জাতির সার্বিক উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির চাবিকাঠি। এ উপলব্ধি থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক করে নিরক্ষরমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে তিনি দক্ষ ও মেধাসম্পন্ন সুশিক্ষিত জাতি গড়ার লক্ষ্যে প্রায় ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে প্রথম সরকারীকরণ করেছিলেন। সেই থেকে পথ চলা। তবে স্বাধীনতাপূর্বকালীন এ ভূখন্ডে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা সম্পূর্ণ বেসরকারিভাবে পরিচালিত হতো।
- বর্তমান সরকারের আমলে সরকারীকরণে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
বঙ্গবন্ধু সুদূরপ্রসারি দৃষ্টিভঙ্গি থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে একদিকে যেভাবে সাংবিধানিকভাবে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করেছেন, বঙ্গবন্ধুর পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার মেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও ২০১৩ সালে একসঙ্গে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারীকরণ করেছেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নব উদ্যোগে এগিয়ে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে এ দুটি ঘটনা অত্যন্ত যুগান্তকারী।
- প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে আপনার ব্যক্তিগত মতামত কী?মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রাথমিক ক্ষেত্রে কাজ করছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। আমি বিশ্বাস করি, শিক্ষাকে যদি বলা হয় জাতির মেরুদ- তাহলে প্রাথমিক শিক্ষাকে বলা হবে শিক্ষার মেরুদন্ড। এ জায়গা থেকে আমরা সমগ্র জাতিকে আলোর পথ দেখাব। এজন্য আমরা আমাদের অধিদপ্তরের স্লোগান দিয়েছি ‘উন্নয়নের বাতিঘর প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’। এ স্লোগানটির সঙ্গে প্রায় চার লাখ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং দুই কোটি শিশু ও তাদের দুই কোটি অভিভাবকও আছেন। আমরা সবাই এ স্লোগানকে সামনে রেখে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছি।
- সব শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে কী কাজ করছে সরকার?
আমাদের উদ্দেশ্য দেশের প্রতিটি শিশু যাতে শিক্ষার আওতায় আসে এবং তারা মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হয়ে নিজেদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলে। এজন্য আমরা দীর্ঘমেয়াদি ভিশন নিয়ে কাজ করছি। আর সেটা হলো আমাদের শিক্ষার্থীদের সত্যিকারের অর্থে উপযোগী করে তুলতে তাদের আনন্দঘন পরিবেশের মধ্য দিয়ে স্কুলে পাঠদান করতে পারি সেজন্য অনেক কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। আমাদের দর্শন হচ্ছে প্রতিটি শিশু ঘুম ভেঙে তার মায়ের কাছে প্রথম যে আবদারটি রাখবে-আমি স্কুলে যাব।
- প্রাথমিক শিক্ষায় আধুনিকায়নে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
২০০৯ সাল থেকে সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ বির্নির্মাণে এগিয়ে যাচ্ছে। বিষয়টি মাথায় রেখে আমরা প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক আদলটি ডিজিটালাইজড করার চেষ্টা করছি। শিক্ষাজীবনের প্রথম থেকেই শিশুদের আধুনিক পদ্ধতিতে শিক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ইন্টারনেট সংযোগসহ ল্যাপটপ এবং মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরবরাহ করা হচ্ছে। ২০০৮ সালের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যাবে তখন প্রাথমিক স্তরে ডিজিটাল ডিভাইসের কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না কিন্তু ২০১৮ সালে এসে বলতে পারি বিদ্যালয়ে ৯ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম করা হয়েছে। বর্তমানে আরও ৫০ হাজার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরির প্রক্রিয়া চলমান।
- বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বলবেন কী?
সর্বশেষ জরিপে প্রাথমিক স্তরে দেশে বিদ্যালয়ের সংখ্যা ১ লাখ ৩০ হাজারের মতো, এর মধ্যে সরকারি ৬৫ হাজারের মতো। এখানে দুই কোটি শিক্ষার্থী অধ্যয়ন করছে, এদের ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী সরকারি বিদ্যালয়ে রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি মিলে প্রায় ছয় লাখ শিক্ষক রয়েছেন, শুধু সরকারি শিক্ষক রয়েছেন পৌনে চার লাখের মতো। এ বিশাল কর্মযজ্ঞ আমরা পরিচালনা করছি তাতে একটি দর্শন রয়েছে। সেটা হলো প্রাথমিক স্তরে যে দুই কোটির মতো কোমলমতি শিশু রয়েছে তাদের এমনভাবে গড়ে তুলতে চাই যাতে তারা বড় হয়ে দেশকে যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারে।
- শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নেওয়াটা কতটা যৌক্তিক?
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের শৈশবেই একটি আস্থার জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের ভেতরে ভবিষ্যতে বড় বড় পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার মানসিক প্রস্তুতি সৃষ্টি করছে এবং তাদের মধ্যে আশা ও আস্থার সঞ্চার করছে। এ প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় যারা বেশি ভালো করছে তাদের উৎসাহিত করতে চেষ্টা করছি।
- প্রাথমিকের শতভাগ শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির প্রকল্প সম্পর্কে বলবেন?
প্রাথমিকের শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় নিয়ে আসার লক্ষ্যে সরকারের উপবৃত্তির যে প্রকল্পটি রয়েছে সেটিকে সরকার নতুন করে অনুমোদন দিয়ে বর্ধিত করা হয়েছে। আগে শুধু গ্রামীণ এলাকার শিক্ষার্থীরা এটা পেত, এখন থেকে শহরের শিক্ষার্থীরাও এটা পাবে। নতুনভাবে প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য এ প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে। এ উপবৃত্তিটি স্বচ্ছ করার জন্য আমরা এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় নিয়ে এসেছি।
- স্কুল ফিডিং কার্যক্রমে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে?
দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় আমরা স্কুল ফিডিং কার্যক্রম চালু করেছি। উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন প্রায় ৭৫টি গ্রাম ওজনবিশিষ্ট সুস্বাদু প্যাকেট বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। বর্তমানে স্কুল ফিডিং প্রকল্পের আওতায় ৯৩টি উপজেলার ১৫ হাজার ৭০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩০ লাখ ৭৫৮ শিক্ষার্থীর মধ্যে এ বিস্কুট সরবরাহ করা হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা শিগগিরই জাতীয় স্কুল ফিডিং কার্যক্রম নীতিমালা প্রণয়ন করতে যাচ্ছি। যেটি চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।
- বছরের প্রথম দিন নতুন বই প্রদান কি জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে?
আমরা বছরের প্রথম দিনে নতুন ঝকঝকে বই দিয়ে আসছি শিক্ষার্থীদের। এটি সারা বিশ্বে একটি বিরল ঘটনা। বিশ্বের অন্য কোনো দেশে বছরের প্রথম দিন এত শিক্ষার্থী নতুন বই নিয়ে আনন্দে মেতে ওঠে না। এটি এখন বাঙালির সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। একইসঙ্গে এটি জাতীয় উৎসবও। এ কাজটি আমরা নিরলসভাবে করে যাচ্ছি। এরই ধারবাহিকতায় এ বছরের প্রথম দিনও সব শিশুকে নতুন বই দেওয়া হয়েছে।
- শিশুদের সহশিক্ষা কার্যক্রমে কি কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে?
শিশুদের পড়াশোনার পাশাপাশি দৈহিক ও মানসিক বিকাশের জন্য চারুকারুকলায় মনোনিবেশ করতে উৎসাহিত করছি। শিশুরা চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দেশ-বিদেশে সুনাম অর্জন করছে। তাছাড়া তাদের খেলাধুলা ও সংগীতের ক্ষেত্রেও উদ্বুদ্ধ করার জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছি। আমাদের আরেকটি বিরাট অর্জন রয়েছে বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গমাতার নামে ফুটবল টুর্নামেন্ট চালু করা। এতে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করে। এটিও একটি জাতীয় উৎসবে রূপ নিয়েছে।
- ১ ঘণ্টায় ‘গাছের চারা রোপণ’ কর্মসূচি কি এ বছরও রয়েছে?
২০১৭ সালের ২৩ জুলাই একটি অনবদ্য ঘটনা ঘটিয়েছি আমরা। প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই ওই দিন সারা দেশে দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ১ ঘণ্টা ৪ লাখ ৭৬ হাজার ৫৭৭টি গাছ লাগিয়েছি। এটি রেকর্ড করেছি আমরা। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একদিনে ১ ঘণ্টার মধ্যে এ চারা রোপণ করা হয়েছে। আমার মতো একজন ক্ষুদ্র ব্যক্তির আহ্বানে সাড়া দিয়ে সবাই অংশগ্রহণ করেছেন। এ বছর আমাদের ইচ্ছা, একই দিন একই সময়ে ৩০ লাখ শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে ৩০ লাখ চারা রোপণ করব। এটি হবে বিশ্বের মধ্যে বিরল ঘটনা। এর মধ্যে আমরা গিনেজ বুকে স্থান করে নিতে সক্ষম হব।
- অবকাঠামো নির্মাণে কি কি কাজ পরিচালিত হয়েছে?
প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে ২০০৯ থেকে সর্বশেষ অর্থবছর পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ বিদ্যালয় নির্মাণ করেছি ১ হাজার ১৫১টি, পুনর্নির্মাণ করেছি ৭ হাজার ৭৪২টি, সিডর-সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করেছি ৩৮২টি, অতিরিক্ত শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ করেছি ৪০ হাজার ৫৬৫টি, বড় ধরনের মেরামত করেছি ৫ হাজার ৪৭১টি এবং অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করেছি ১ হাজার ৬১৪টি। নতুনভাবে পিটিআই নির্মাণ করেছি ১১টি এবং আরেকটি ঢাকায় নির্মাণাধীন। এছাড়াও শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আমরা ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে সদ্যসমাপ্ত ২০১৬-১৭ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৬৯ হাজার ৬২৫ শিক্ষক নতুনভাবে নিয়োগ করেছি। সম্ভবত সরকারের অন্য কোনো খাতে এত বেশি জনবল নিয়োগ হয়নি।
- ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানদের মাতৃভাষায় বই প্রদানের উদ্দেশ্য কী?
পৃথিবীতে আমরাই একমাত্র জাতি, যারা মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি। সে দরদের জায়গা থেকে দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সন্তানদের মাতৃভাষায় পাঠদানের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এরই মধ্যে চাকমা-মারমা-গারোসহ পাঁচটি ভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করে তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে, পাঠদানও করা হচ্ছে। সাঁওতালদের জন্যও আরেকটি করতে যাচ্ছি। সেটার যাচাই-বাছাই চলছে।
- বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনে অভিযোগ নিরসনে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে?
প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শনের ক্ষেত্রে আগে বেশকিছু অভিযোগ পাওয়া যেত। এক্ষেত্রে আমরা একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আমরা এ ক্ষেত্রে ই-মনিটরিং নামে নতুন একটি ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি চালু করেছি। এটি পরীক্ষামূলক চলছে, খুব দ্রুত এটি শতভাগ বিদ্যালয়ে চালু করার চেষ্টা করছি। এটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, কোনো পরিদর্শনকারী সরেজমিন বিদ্যালয়ে পরিদর্শনে না গিয়ে থাকে তাহলে তার ডিভাইসটি লগইন করতে পারবে না। বিদ্যালয়ে সরেজমিন গেলে এটি লগইন হবে এবং পরে পরিদর্শন ফরমে ফরমেটটি পূরণ করতে পারবে।