‘আমাদের শিক্ষকদের আর্থিক স্বচ্ছলতা ছিলোনা কিন্তু সম্মান ছিলো আকাশচুম্বী’
‘শিক্ষকদের হাত ধরেই শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর শুরু’ এই প্রতিপাদ্যকে কেন্দ্র করে আজ সারাদেশে প্রথমবারের মতো জাতীয়ভাবে উদযাপন করা হচ্ছে ‘শিক্ষক দিবস’। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর দিবসটি উদযাপনে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করছেন। প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে শিক্ষক দিবস উদযাপনে উচ্ছ্বাসিত দেশের শিক্ষকরা। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের নানা সংকট ও সমস্যার যুগপৎ সমাধান হবে বলে ভাবনা তাঁদের।শিক্ষক দিবসে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষকতার সেকাল-একাল নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছিলেন রাজধানীর সবুজবাগ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক শামিম আরা বেগম। আলোচনার চুম্বক অংশ তুলে ধরেছেন প্রতিবেদক— রাকিবুল হাসান তামিম।
প্রথমবারের মতো সারাদেশে জাতীয়ভাবে শিক্ষক দিবস পালনের উদ্যোগে আমরা শিক্ষকরা আনন্দিত, উদ্বেলিত এবং গর্বিত। সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই। এর মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের সামাজিক অবস্থান আরো সুদৃঢ় হবে। শিক্ষকদের হাত ধরেই শুরু হবে আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার রূপান্তর। বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় সবকিছু হাতের মুঠোয় চলে এসেছে। কিন্তু আমরা যখন শিক্ষার্থী ছিলাম তখন পড়াশোনা এতটা সহজ ছিলোনা। আমাদের শিক্ষকদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ত্যাগ-তিতিক্ষার ফলেই জ্ঞানের আলোয় নিজেদের উদ্ভাসিত করতে পেরেছি।
শিক্ষকতার সেকাল আর একালের মধ্যে পার্থক্য কতটুকু এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, শিক্ষকতার সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে বিরাট একটি পার্থক্য তৈরি হয়েছে। তখন আমরা শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদেরকে যে পরিমাণ শ্রদ্ধা করতাম এখন তেমনটি নেই বললেই চলে। শিক্ষকরা সবসময় আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। তাঁদের নিয়ে কখনোই সমালোচনার প্রশ্নই আসতো না। সব ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করতাম। তাঁরা সঠিক অথবা ভুল তা নিয়ে আমাদের কোন প্রশ্ন ছিলোনা।
সে সময় শিক্ষকদের আর্থিক দৈন্যদশা থাকলেও সম্মানের জায়গায় তাঁরা আপোষহীন ছিলেন উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আগে শিক্ষকদের বেতন বা আর্থিক স্বচ্ছলতা তেমন ছিলোনা কিন্তু তাঁদের মধ্যে সততা ন্যায়-নিষ্ঠা অগাধ ছিল। বর্তমানে আমাদের বেতন সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলক বেড়েছে। স্বচ্ছলতাও এসেছে। কিন্তু আগের সেসব শিক্ষকদের মতো জায়গা আমরা করে নিতে পারিনি। আমাদের শিক্ষকরা সামাজিকভাবে সর্বজনের কাছেই শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। অবশ্য তখন এত আধুনিক ব্যবস্থাপনা না থাকলেও সময় এবং প্রেক্ষাপট সবকিছুই সুন্দর সমৃদ্ধ ছিল। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের জীবন সহজ সরল ছিল।
ছোট সময়ের একটি স্মৃতি আমার মনে দাগ কেটে আছে। সময়টা ১৯৭৭ সাল।তখন আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। প্রাইমারি স্কুলে আমার যে সকল শিক্ষকরা ছিলেন তাঁরা সবাই অত্যন্ত আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই আর্থিকভাবে অসচ্ছল ছিল। তখন আমি সহ আমার কয়েকজন সহপাঠী একজন শিক্ষকের কাছে বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং করতাম। স্যার এতই দরিদ্র ছিলেন অধিকাংশ সময়ই তাঁর দুপুরের খাবারের বন্দোবস্ত হতোনা। তখন আমাদের খাবার থেকে হয়তো স্যারকে একটি বা দুটি রুটি দিতাম। স্যার সেই খাবারটুকুই হয়তো দুপুরের খাবার হিসেবে গ্রহণ করতেন। অনেক সময় উপোস থাকতেন। আমাদের শিক্ষকরা এতটা কষ্ট করেছেন। সে তুলনায় বর্তমানে আমরা অনেক ভালো আছি।
অধ্যক্ষ শামিম আরও বলেন, এখন শিক্ষার্থীরা শিক্ষকদের বিভিন্ন ভাবে মূল্যায়ন করেন যা আগে ছিল না। আমাদের সময় কেউ যদি কম পড়াতে পারতেন অথবা ভালো নাও পড়াতেন তবুও আমরা তাঁকে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধার চোখে দেখতাম। অনেক শিক্ষক ছিল যারা বেশি বকাঝকা করত অথবা শাস্তি দিতো। তবে কখনও আমরা কিছু মনে করতাম না। ধরে নিতাম এইগুলো সব আমাদের ভালোর জন্য করা হচ্ছে। অপরদিকে এখন শিক্ষার্থীদের শাসন করলে অভিভাবকরা যেমন শিক্ষকদের কাছে কৈফিয়ত খোঁজেন তখন সেই সুযোগও ছিল না। মোটকথা তখন আর্থিক দৈন্যতা থাকলেও সম্মান অনেক বেশি ছিল। কিন্তু এখন আমরা স্বচ্ছল হয়েছি অপরদিকে সম্মান কমেছে।
বর্তমান সময়ে রাষ্ট্রের কাছে আপনাদের (শিক্ষকদের) কি প্রত্যাশা এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, যদি বলি এখন এমন একটা সময় এসেছে মানুষ মূল্যায়ন করার ক্ষেত্রে তাঁর আর্থিক বিষয়টি প্রাধান্য দেয়। এক্ষেত্রে অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় আমরা সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার অনেক পিছিয়ে। আগে মানুষজন শিক্ষকতায় পেশা হিসেবে নয় বরং নেশা হিসেবে আসতো। কিন্তু বর্তমানে সে প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। এখন বেঁচে থাকার সাথে সামাজিক মর্যাদা ও অর্থনৈতিক বিষয়টিও সমানভাবে জড়িত। সে হিসেবে বলতে পারি বর্তমানে শিক্ষকরা অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। শুধুমাত্র শিক্ষা ক্যাডারই নয় বরং প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের সাথে যে সকল শিক্ষকরা জড়িত তাঁদেরও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। তাই সুন্দর ও সমৃদ্ধ দেশ গড়তেন এবং কোয়ালিটি এডুকেশন নিশ্চিত করতে সরকার, শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী এই তিন পক্ষকেই একই চিন্তা ভাবনার মধ্যে আসতে হবে।