২০ মার্চ ২০২১, ১৫:৫৪

পরিবেশবান্ধব সিমেন্ট তৈরির পদ্ধতি উদ্ভাবন চুয়েটের গবেষক দলের

  © টিডিসি ফটো

সিমেন্ট উৎপাদনের বিকল্প এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন চুয়েটের (চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) তিন সদস্যের গবেষক দল। প্রচলিত পদ্ধতিতে সিমেন্ট উৎপাদনের কারণে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। তাই এ থেকে রেহাই পেতে তাদের এই উদ্যোগ। তাদের এই পদ্ধতিতে সিমেন্ট উৎপাদন করা গেলে দূষণ থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ।

গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. জি এম সাদিকুল ইসলাম বলেন, প্রচলিত পদ্ধতিতে সিমেন্ট উৎপাদনে সাধারণত চুনাপাথর আর জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার করা হয়। এ পদ্ধতিতে সিমেন্ট উৎপাদনের কারণে সবচেয়ে বেশি গ্রিনহাউস গ্যাস বের হয়।

এই পদ্ধতি উদ্ভাবনে অধ্যাপক ড. জি এম সাদিকুল ইসলামের সঙ্গে ছিলেন একই বিভাগের শিক্ষার্থী নাসিমুজ্জামান ও শাহারিয়ার অয়ন।

ড. সাদিকুল ইসলাম বলেন, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির মাধ্যমে আবহাওয়ার প্রতিক্রিয়াকে গ্রিনহাউস ইফেক্ট বলা হয়ে থাকে। গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে বাধা দেয় না কিন্ত পৃথিবী থেকে বিকীর্ণ তাপ ফেরত যেতে বাধা দেয়। ফলে তাপ আটকে পড়ে পৃথিবীর উষ্ণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।

তিনি বলেন, যে সব গ্যাস গ্রিনহাউস প্রতিক্রিয়ার জন্য দায়ী তার মধ্যে কার্বন ডাইঅক্সাইড অন্যতম। এইদিকে সিমেন্ট তৈরিতে সিমেন্টের সমপরিমাণ কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয়ে থাকে যা পরিবেশে মিশে যায়। যার ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যায়, পাহাড়ের শীর্ষে ও মেরু অঞ্চলে জমে থাকা বরফ গলে গিয়ে সমুদ্রতলের উচ্চতা বেড়ে যেতে পারে। ফলে, সমুদ্র উপকূলবর্তী নিম্নভূমি নিমজ্জিত হতে পারে। বিগত ১০০ বছরে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা ০.০৭ ডিগ্রি বৃদ্ধি পেয়েছে। এভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস আমাদের জীবনে জলবায়ু পরিবর্তন, ঘুর্নিঝড় ও জলোচ্ছাসের মত ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে থাকে।

কার্বন নিঃসরণের পাশাপাশি প্রতি টন সিমেন্ট উৎপাদনের জন্য প্রায় ১০৫ কিলোওয়াট-ঘন্টা বিদ্যুৎ ও ৬০ থেকে ১৩০ কেজি জ্বালানি তেল প্রয়োজন হয়। সিমেন্ট শিল্প বিশ্বজুড়ে মোট কার্বন ডাই অক্সাইড নি:সরন এর ৫% অবদান রাখে। অপরদিকে বিভিন্ন শিল্পবর্জ্যর সুচারু ব্যবস্থাপনার জন্যও প্রচুর পরিমাণে জমি, শ্রম এবং ব্যয় প্রয়োজন। না হলে এটি পরিবেশের উপর মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এর সবটাই কি খারাপ কিছুর ইঙ্গিত? না।

এই দুটি সমস্যার সমাধানে প্রয়োজন প্রচলিত সিমেন্ট এর পরিবর্তে শিল্পবর্জ্য পদার্থ থেকে উৎপাদিত পরিবেশবান্ধব জিওপলিমার সিমেন্ট ব্যবহারে উৎসাহিত করা। এমনই এক ধারণা উপস্থাপন করে এবারের অ্যাডভান্সেস ইন সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং (আইসিএসিই’২০) সম্পর্কিত ৫ম আন্তর্জাতিক সম্মেলনে সেরা গবেষণাপত্র হিসেবে পুরস্কৃত হয়েছে।

গত ৪ থেকে ৬ মার্চ চুয়েটের তিনদিনব্যাপী এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের শেষে এই ফলাফল ঘোষণা করা হয়। স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ক্ষেত্রে উপস্থাপিত প্রায় ৬০টি গবেষণার মধ্যে এই ধারণাটি আন্তর্জাতিক পর্যালোচক এবং বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের গবেষকরা দেখিয়েছেন, কার্বন ফুটপ্রিন্ট হ্রাস এবং শিল্পবর্জ্য পুনর্ব্যবহারের ক্ষেত্রে পরিবেশগত সৃজনশীলতা কেবল এটিকে সাধারণ পোর্টল্যান্ড সিমেন্টের উপযুক্ত বিকল্প হিসেবেই তৈরি করবে না বরং নির্মাণক্ষেত্র শিল্প বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় টেকসই করতেও ভূমিকা রাখবে।

এই গবেষণাটিতে জিওপলিমার এর সাথে বালির বিকল্প পদার্থের কর্মক্ষমতা পরীক্ষামূলকভাবে মূল্যায়ন করা হয়। আমেরিকান সোসাইটি ফর টেস্টিং অ্যান্ড ম্যাটেরিয়াল দ্বারা প্রস্তাবিত বালুকে ইটের ক্ষুদ্র কনা (ইট থেকে খোয়া তৈরির সময়ে তৈরি ধূলিকণা), ফ্লাই এ্যাশ (কয়লাভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্র হতে উৎপাদিত) এবং বর্জ্য কাচ দ্বারা প্রতিস্থাপন করে জিওপলিমার মর্টারে তৈরি করা হয়েছিল। এসব নমুনার শক্তি তুলনা করা হয়েছিল ইউরোপীয় মানের বালুর সমন্বয়ে তৈরি মর্টারগুলোর সাথে।

বিকল্প সিমেন্ট (জিওপলিমার) ব্লাস্ট ফার্নেস স্ল্যাগ এবং সিলিকা ফিউম নামে লোহা ও সিলিকন শিল্পের বর্জ্য থেকে তৈরি করা হয়েছিল। এর সাথে খুব স্বল্পমূল্যের রাসায়নিক ওয়াটার গ্লাস এবং সোডিয়ামের হাইড্রোক্সাইড ব্যবহার করা হয়। অল্প তাপে (৬০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এ ১৮ ঘণ্টা রাখার পর জিওপলিমার মর্টারগুলো ৭ দিনের মধ্যে দুর্দান্ত শক্তি (৪৫ এমপিএ পর্যন্ত) দেয় অপরদিকে এই শক্তি আর্জন করতে ঐতিহ্যবাহী সিমেন্ট ভিত্তিক মর্টারগুলোকে ২৮ দিন সময় দিতে হয়। বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বাড়ার সাথে সাথে মর্টারগুলো আরো ভালো কার্যক্ষমতা দেয়।

বর্জ্য পদার্থগুলোর মধ্যে ইটের ধুলি জিওপলিমার মর্টারে উত্তমরূপে কাজ করে যা ইঙ্গিত করে, এটিকে একটি প্রতিশ্রুতিশীল পরিবেশবান্ধব উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক বালুর বিকল্প হিসেবে নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে।

গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে, জিওপলিমারের ব্যাপক ব্যবহার সিমেন্ট তৈরির পরিবেশগত প্রভাব উল্লেখযোগ্যভাবে কমতে পারে। এই গবেষণা নির্মাণ খাতে টেকশই উন্নয়ন অর্জনের জন্য একটি নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মুক্ত করবে।