গবেষণায় শেকৃবি
সাগরতলে মাছের প্রজাতি নির্ণয়ে ডিএনএ!
- আরাফাত রহমান অভি, শেকৃবি
- প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:০৪ PM , আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৯, ১০:২৬ AM
সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপের সাগর তলে মাছের প্রজাতি নিরূপণ করতে প্রথমবারের মত ডিএনএ ডাটাবেজ তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় প্রবাল দ্বীপের জলরাশিতে এই কাজটি শুরু করেছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বায়োলজি এন্ড জেনেটিক্স বিভাগের একদল গবেষক।
জানা অজানা অসংখ্য প্রজাতির মাছের অভয়ারণ্য সেন্টমার্টিনের নীল জলরাশি। বর্ণিল এসব মাছের কোনটি ভয়ানক আবার কোনটি নিরীহ। যাদের প্রত্যেকেরই আছে ভিন্ন ভিন্ন নাম আর আলাদা আলাদা প্রজাতি। কিছুদিন আগেও গবেষকরা সনাতন পদ্ধতিতে জেলেদের সাহায্যে এসব মাছের গঠন ও বাহ্যিক আকৃতি দেখে তাদের নাম ও প্রজাতি নির্ণয় করতেন। জীবনচক্র পরিবর্তনের সাথে সাথে বাহ্যিক বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের কারণে সনাতন পদ্ধতিতে এদের সনাক্ত করা খুবই জটিল। তবে ডিএনএ বারকোডিংয়ের মাধ্যমে এই ডাটাবেজ তৈরীর কাজ সমাপ্ত হলে আকৃতিগত পরিবর্তন হলেও অতি সহজেই মাছগুলোকে সনাক্ত করা সম্ভব হবে।
এ পদ্ধতিতে প্রথমে সমুদ্র থেকে মাছের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। এজন্য মাছের শরীরের যেকোন অংশ যেমন- লার্ভা, ডিম, রক্ত ইত্যাদি হলেও ডিএনএ বারকোডিং করা যায়। এরপর সংগৃহীত নমুনাটিকে নিয়ে আসা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে।
এরপর এই সংগৃহীত নমুনা থেকে ডিএনএকে আলাদা করা হয় যাকে ডিএনএ এক্সট্রাকশন বলে। এরপর এই জিনোমিক ডিএনএকে ন্যানোড্রোপের মাধ্যমে সংগৃহীত ডিএনএটির গুণগত ও পরিমাণগত মান নির্ণয় করা হয় যাকে বলে পিউরিফিকেশন। তারপর পিসিআর’র মাধ্যমে ডিএনএ’র একটি নির্দিষ্ট অংশকে বহু কপি তৈরি করা হয় যাকে এ্যামপ্লিফিকেশন বলা হয়। এরপর এই ডিএনএ’র অংশকে সিকুয়েন্সিং করা হয়। এরপর সিকোয়েন্সিং করা জিনটিকে গবেষকদের কাছে সংগৃহীত জিন ব্যাংক অথবা আন্তর্জাতিক জিন ব্যাংকের তথ্যের সাথে মিলানো হয়। সংগৃহীত কোডের সাথে নমুনাটির কোড মিলে গেলে অতি সহজেই নমুনাটির নাম ও প্রজাতি সনাক্ত করা সম্ভব। আর যদি এটি কোন নতুন সিকোয়েন্স দেয় অর্থাৎ ব্যাংকে জমা রাখা কোন কোডের সাথে না মিলে; তাহলে নতুন কোন প্রজাতির অস্তিত্ব নিশ্চিত হবে।
গবেষকরা বলছেন, সেন্টমার্টিনের জলরাশির প্রবাল সংলগ্ন এলাকায় বর্তমানে প্রায় একশত (৮৯ প্রজাতি) এর কাছাকাছি প্রজাতির মাছ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে পানির তলদেশের প্রাকৃতিক অবস্থা পরিবর্তনের কারণে অনেক সময় বিরল প্রজাতির মাছগুলো বিলুপ্ত হয়ে যায়। আবার কিছু কিছু মাছ আলাদা প্রজাতি হওয়া সত্ত্বেও বাহ্যিক আকৃতির সাদৃশ্যের কারণে এদের আলাদাভাবে সনাক্ত করাও কঠিন। তাই ডিএনএ বারকোডিংয়ের এই পদ্ধতিতে বিরল ও অনাবিষ্কৃত মাছের প্রজাতি নির্ণয় করা যেমন সহজ হবে; ঠিক তেমনিভাবে আগের ভুল-ভ্রান্তিগুলোও শুধরে নেয়া সম্ভব।
গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক ড. কাজী আহসান হাবীব বলেন, আমরা সেন্টমার্টিন দ্বীপে জলজ প্রাণের সঠিক ও নির্ভুল ডাটাবেজ নির্ণয়ের জন্য দেড় বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যেটা এই বছরের নভেম্বর মাসে শেষ হবে। এতে মাছের ডিএনএ’র একটি নির্দিষ্ট জীনকে সনাক্ত করার মাধ্যমে এর সঠিক প্রজাতি নির্ণয় করা সম্ভব হবে। ফলে এই প্রবালদ্বীপে মাছের প্রকৃত জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া সম্ভব।
তিনি আরো বলেন, স্থলজ জীববৈচিত্র্য রক্ষার পাশাপাশি আমাদের পানির তলদেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষার ব্যাপারেও সচেতন থাকা উচিত। মূলত সেই দায়বদ্ধতা থেকেই এই গবেষণা কার্যক্রমটি শুরু করা হয়েছে। সুতরাং পানির তলদেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করাই এই গবেষণারর প্রধান উদ্দেশ্য। এছাড়াও ডিএনএ মেটা বারকোডিংয়ের মাধ্যমে শুধু মাছই নয় সাগর তলের শামুক, ঝিনুক, কাকড়া, ফাইটোপ্লাংকটসহ নানা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলজ প্রাণীরও ডিএনএ সিকুয়েন্স নির্ণয় করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ডিএনএ বারকোডিংয়ের ব্যবহার আরও আগে থেকে শুরু হলেও সেন্টমার্টিন প্রবাল দ্বীপে মাছের জীববৈচিত্র্য নিরূপনে ডিএনএ বারকোডিংয়ের ব্যবহার এবারই প্রথম।
তাই গবেষকরা মনে করেন, এ ধরণের কার্যক্রম বাংলাদেশের SDG-14 লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করার পাশাপাশি সামুদ্রিক গবেষণায় একটি নতুন মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।