এইচএসসির ফলাফল মূল্যায়ন পদ্ধতি নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
এবারের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফল মূল্যায়ন করেই এইচএসসির ফলাফল নির্ধারণ করা হবে। সরকারের এমন সিদ্ধান্তে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকসহ সকল স্তরের মানুষের মধ্যে।
এমনকি উচ্চমাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যেও এর প্রতিক্রিয়া সমানভাবে লক্ষণীয়। এভাবে ফলাফল মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে এবং এমন সিদ্ধান্ত কতটা শিক্ষার্থীবান্ধব ও যুক্তিপূর্ণ তা নিয়ে নিজস্ব মতামত দিয়েছেন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
আহমাদ উল্লাহ, ফুড টেকনোলজি এন্ড নিউট্রিশন সায়েন্স বিভাগ
শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের নিয়ে আরো একটু ভাবতে পারতো। এভাবে এসএসসি ও জেএসসির ফলাফলের ভিত্তিতে এইচএসসির ফলাফল শতভাগ নির্ধারণ না করে অন্তত এডমিশন টেস্টের মতো করে হলেও প্রত্যেকটা বিভাগের সাবজেক্টিভ দুইটা থেকে পাঁচটা বা তা না পারলে অন্তত একটা হলেও যাচাই পরীক্ষা নিয়ে তার ফলাফল এসএসসি ও জেএসসির সাথে শতাংশ হারে যোগ করে রেজাল্ট তৈরি করলে হয়তো কোন শ্রেণী বঞ্চিত হতো না। পূর্বের রেজাল্ট ভালো কিন্তু এইচএসসি ফাঁকিবাজি করেছে এমন সংখ্যা কম নয়। আবার, পূর্বের রেজাল্ট খারাপ কিন্তু এইচএসসি'র দুইবছর আপ্রাণ চেষ্টা করেছে এবং পরীক্ষা হলে রেজাল্টও ভালো করতো এমন সংখ্যাও কম নয়। এসব বঞ্চিত শিক্ষার্থীদের দায়ভার কে নেবে?
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এমন অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত হতাশাজনক। হতাশার মাঝেও শিক্ষার্থীরা আশা খুঁজে পাবে যদি প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের ভর্তি পরীক্ষার জিপিএ এর ক্রাইটেরিয়া অপরিবর্তিত রেখে নম্বর বণ্টন শুধু ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্রিক করে। জিপিএ এর নাম্বার যোগ না করলে আশা করি একটা ভারসাম্য আসবে এবং যোগ্যরা বঞ্চিত হবে না।
হিমেল শাহরিয়ার, বাংলাদেশ এন্ড লিবারেশন ওয়্যার স্টাডিজ বিভাগ
এই ধরনের সিদ্ধান্ত কখনোই কাম্য নয়। অনেকে আছে যারা এসএসসি'তে খারাপ রেজাল্ট করলেও এইচএসসি'তে অনেক ভালো করে। এই ফলাফল মূল্যায়নের মধ্যে দিয়ে বেকারত্ব বাড়বে, হতাশা বাড়বে। কারণ পাশ আর ভালো রেজাল্টের পরিমাণ হবে অস্বাভাবিক বেশি কিন্তু কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় গুলো উচ্চশিক্ষার জন্য সে পরিমাণ ভর্তি নিতে পারবেনা। এতে অনেক ভালো ফলাফলধারী ভর্তি হতে পারবেনা এবং তাদের মাঝে হতাশার সৃষ্টি হবে। এছাড়া মেধা যাচাইয়ের ক্ষেত্রেও এটা ভবিষ্যতে বিরূপ প্রভাব পড়বে।
এস আহমেদ ফাহিম, অণুজীববিজ্ঞান বিভাগ
এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি যৌক্তিক বলে আমি মনে করি না। কারণ,শিক্ষাজীবনের উচ্চমাধ্যমিক ধাপের সিলেবাসের সাথে জেএসসি ও এসএসসি ধাপের সিলেবাসের বেশ ভিন্নতা রয়েছে, সেহেতু ভিন্ন ভিন্ন ধাপে শিক্ষার্থীদের ফলাফল ভিন্ন হতে পারে। এর ফলে কোনো শিক্ষার্থী যদি জেএসসি ও এসএসসি ধাপে খারাপ ফলাফল করে থাকে, তাহলে ঐ শিক্ষার্থী ভালো ফলাফল করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবে। উচ্চমাধ্যমিক সময়কালীন একজন শিক্ষার্থী ভালো ফলাফলের লক্ষ্যে মেধা ও শ্রম ব্যয় করে যে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে তার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন থেকে বঞ্চিত হবে এবং মেধার পরিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যর্থ হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়াও এই সিদ্ধান্তের ফলে অনেক শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থার বিপর্যয় ঘটতে পারে।
সাজবীর হাসান, ইনফোরমেশন সায়েন্স এন্ড লাইব্রেরী ম্যানেজমেন্ট বিভাগ
এই বিষয়টিকে তিনটি দিক থেকে বিবেচনা করা যেতে পারে।
প্রথমত: মহামারীকালীন সময়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই সিদ্ধান্তটি সাধুবাদ পাওয়ার যোগ্য। কারণ এর মাধ্যমে করোনা বিস্তারের সম্ভাবনা অনেকটা কমে আসবে।
দ্বিতীয়ত: এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে,এই সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হলে শিক্ষার্থীদের মেধার যথাযথ মূল্যায়ন হবে না।
তৃতীয়ত: আমাদের এটা মনে রাখা দরকার যে,একটি পরীক্ষা কিংবা ফলাফল কখনোই মেধা ও যোগ্যতার মাপকাঠি হতে পারেনা। তাই যারা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছে তাদের জন্য পরবর্তী ধাপ গুলোতে অপেক্ষা করছে সাফল্যের স্নিগ্ধ অনুভূতি। আর যারা ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেনি তাদের জন্য এটি হতে পারে পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করার সবচেয়ে ভালো সুযোগ।
মো. ফাহাদ হোসেন, অর্থনীতি বিভাগ
এই প্রক্রিয়াকে আমি পুরোপুরিভাবে সমর্থন করি না। প্রথমত, জেএসসি ও এসএসসি স্তরের পড়াশোনার ফলাফল দিয়ে এইচএসসি স্তরের পড়াশোনা যাচাই করা পুরোপুরিভাবে সম্ভব নয়। এইচএসসি স্তরের ফলাফল নির্ধারণ করে দেয় একজন শিক্ষার্থীর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের গতিপথ। অন্যদিকে, এমন অনেক শিক্ষার্থী আছে যারা এসএসসি ও এইচএসসি স্তরে ভিন্ন বিভাগে পড়াশোনা করেছে।সেক্ষেত্রে, যারা এইচএসসিতে বিভাগ পরিবর্তন করেছে তাদের মেধার যথাযথ মূল্যায়নের সুযোগ নেই। আবার, এইচএসসি পরীক্ষার পরপরই অনেক শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ শুরু করে। এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া থেকে নিজকে মূল্যায়ন করে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিটগুলো, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল ও অন্যান্য উচ্চশিক্ষার স্তরে ভর্তির জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করে। এবছর এইচএসসি পরীক্ষা না হওয়ার কারণে শিক্ষার্থীরা নিজেদের মূল্যায়নের সে সুযোগটি পাচ্ছে না। সুতরাং, বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে ভর্তি প্রস্তুতি অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে।
লেখিকা: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।