এইচএসসি পরীক্ষা: যা পড়েছিলাম, তাও এখন ভুলতে বসেছি
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের পর ঘরবন্দি রয়েছেন প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব স্তরের শিক্ষার্থীরা। সবচেয়ে বেশি অনিশ্চিত দিন কাটছে চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের। করোনা সংকটে পূর্ব নির্ধারিত গত ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিতব্য এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করে সরকার। এরপর দিন যত গড়িয়েছে মহামারির প্রকোপও তত বেড়েছে। সাধারণ ছুটির পর অফিস-ব্যবসা-যানবাহনসহ সব খুললেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বাড়ানো হয়েছে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত।
এখন এইচএসসি পরীক্ষা কবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে ধোঁয়াশায় রয়েছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। নোয়াখালী সরকারী কলেজের ছাত্রী সালমা আক্তার এবার এইচএসসি পরীক্ষা দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে তার সব পরিকল্পনা ওলটপালট হয়ে গেছে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে সালমা জানায়, “আমি পরীক্ষার জন্য খুব ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু লকডাউন শুরুর পর থেকে কোচিং, প্রাইভেট সব বন্ধ। যা পড়েছিলাম, তাও এখন ভুলতে বসেছি। নতুন একটি তারিখ দিলে আবার ভালোভাবে পড়াশোনা শুরু করতে হবে। ইচ্ছা ছিল, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার। কিন্তু পরীক্ষা হবে না জানার পর থেকে পড়াশোনা আর ঠিকভাবে করা হচ্ছে না। সব কিছু মিলিয়ে একটা চিন্তার মধ্যে আছি।”
হবিগঞ্জের বানিয়াচং আইডিয়েল কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছেন মাধবী আক্তার জোনাকি। তিনি জানান, পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা কাটছেই না। যে প্রস্তুতি ছিল তাও ধরে রাখতে পারছি না। জানিনা কবে পরীক্ষা হবে। বই নিয়ে বসলেও পড়ায় মনোনিবেশ করতে পারছি না। খুব অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি আমরা।
একই জেলার সুফিয়া-মতিন মহিলা কলেজের এইচএসএসি পরীক্ষার্থী সনি আক্তার। ব্যবসায় শিক্ষা শাখার এ পরীক্ষার্থী বলেন, পড়ালেখা মোটেই হচ্ছে না। আগের গতি একবারেই এখন মন্থর হয়ে গেছে। আগের প্রস্তুতি ধরে রাখতে পারছি না। উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটছে দিন। পরীক্ষা কবে হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি আমরা।
এ বছরের এইচএসসি পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল এপ্রিল মাসে, কিন্তু করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকি থাকায় এখনো পরীক্ষা শুরু করতে পারেনি সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল বলে মনে করছে অভিভাবকরা। তবে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের স্নাতকে ভর্তির জন্য এই সময়ে প্রস্তুতি নেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পরীক্ষা না হওয়ায় তাদের একাডেমিক ক্যালেন্ডার থেকে একটি বছর হারিয়ে যাওয়ার অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তাই আর অপেক্ষা না করে অতি শীঘ্রই যেকোনো উপায়ে পরীক্ষা নেওয়া উচিত বলেও মনে করছে শিক্ষাবিদরা। প্রায় ১৩ লাখ পরীক্ষার্থী প্রস্তুতি নিয়েও এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা তাদের নির্ধারিত সময়ে দিতে পারেনি। ফলে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থাও কিছুটা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। তাই কেউ কেউ পরীক্ষাটি এমসিকিও পদ্ধতিতে অনলাইনে নেওয়ার ব্যাপারেও পরমার্শ দিয়েছেন।
তবে চলমান পরিস্তিতিতে যেহেতু প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। তাই সেগুলোকে ব্যবহার করে দুরূত্ব বজায় রেখে, শিক্ষার্থীদের সেশনজট থেকে বাচাঁতে প্রত্যেক পরীক্ষার মাঝে সময় কমিয়ে প্রশ্নপত্র সংক্ষিপ্ত করে পরীক্ষা নেওয়ার বিষয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ।
তিনি আরও বলেন, সেপ্টেম্বর অথবা তারপরও যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মত পরিস্তিতি না হয় তাহলে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পর্যায়ে প্রথমবর্ষের রেজাল্ট নিয়ে সেই রেজাল্ট থেকে বিশ্লেষণপূর্বক নির্দিষ্ট পরিমান মার্ক বাড়িয়ে, নিরপেক্ষভাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জিপিএ হিসাব বের করে ফলাফল প্রদান করা সম্ভব। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা প্রথমবর্ষের চেয়েও ফাইনাল পরীক্ষায় সাধারণত রেজাল্ট ভালো করে। তাহলে এতে আর কোনো পরীক্ষা নিতে হবে না।
এছাড়াও পিএসসি এবং জেএসসি পরীক্ষা এই বছর নেওয়া দরকার আছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি মনে করি পিএসসি পরীক্ষা শুধু এই বছর নয় পুরোপুরিভাবে বাদ দেওয়ার দরকার। তবে পরিস্থিতি যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে এই বছর জেএসসি পরীক্ষা না নেওয়ার ব্যাপারেও পরামর্শ দেন তিনি।
এইদিকে করোনাভাইরাসের প্রকোপে সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের সবকিছু প্রায় থমকে গিয়েছে। তারই মধ্যে আমাদের জীবন ও জীবিকা সচল রাখতে লকডাউন কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। কারণ করোনাভাইরাস বৈশ্বিক ও স্থানীয় সব রকমের বাস্তবতায় অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষকেও এখন আর শুধু করোনা সংক্রমণ থেকে বাঁচা বা তার চিকিৎসা নিয়েই নয় বরং ভাবতে হচ্ছে আগামী দিনের জীবনযাত্রা, শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি, যোগাযোগ, ব্যবসা, ইত্যাদি মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে।
বাস্তবতা আমাদের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে গভীরভাবে ভাবাচ্ছে, যা এখন স্থবির রয়েছে। এ বাস্তবতায় তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর অনলাইন শিক্ষা বা ই-লার্নিং পদ্ধতির মাধ্যমেই স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অনলাইন শিক্ষা চলমান করেছে সরকার।