স্কুল-কলেজের টিউশন ফি

মুখোমুখি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকরা, দর্শক মন্ত্রণালয়

করোনার কারণে বন্ধ থাকা অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশন ফি আদায়ে তৎপর রয়েছে। আয় রোজগার না থাকায় সংকটের এই মুহূর্তে বেশির ভাগ অভিভাবকই টিউশন ফি দিতে অপারগ কিংবা নারাজ। কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি আদায় অব্যাহত রেখেছে। এতে মুখোমুখি অবস্থান করছেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকরা। অন্যদিকে দর্শকের ভূমিকায় রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর অধীন দপ্তরগুলো।

প্রায় দুইমাস ধরে বন্ধ রয়েছে প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে টিউশন ফি আদায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাপে বিরক্ত অভিভাবকরা। টিউশন ফি না দেয়ার যুক্তি হিসেবে তারা বলছেন, টিউশন ফি নির্ধারিত হয় মূলত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন, বিভিন্ন ধরনের বিল পরিশোধসহ নানা কাজের জন্য। কিন্তু করোনাকালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় বেতন-ভাতা বাদে প্রতিষ্ঠানের তেমন কোনো খরচ ছিল না। যেসব অভিভাবক বেসরকারি চাকরি ও ছোট ব্যবসা করেন, তাঁরা সমস্যায় আছেন। এই অবস্থায় শতভাগ বেতন আদায় করা কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে না। আর যেসব স্কুলের ফান্ড রয়েছে, তাদের তো কয়েক মাস বেতন না নিলেও কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘ম্যানেজিং কমিটি বাণিজ্য করতে অনেক এমপিওভুক্ত স্কুলে অযথাই অস্থায়ী শিক্ষক নিয়োগ দেয়। এসব স্কুল টিউশন ফি আদায়ে চাপ দিচ্ছে। আবার অনেক স্কুলের ফান্ডে টাকা থাকার পরও চাপ দিচ্ছে। আমাদের দাবি, মার্চ মাস থেকে আগস্ট পর্যন্ত সব স্কুলের শতভাগ টিউশন ফি মওকুফ করতে হবে। এতে যেসব স্কুল সত্যিকার অর্থে সমস্যায় পড়বে তাদের জন্য সরকারের প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। আর এই দায়িত্ব শিক্ষা মন্ত্রণালয়কেই নিতে হবে।’

অপরদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি আদায়ে যুক্তির হিসেবে উল্লেখ করছেন- টিউশন ফি আদায় করেই শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়। খুব কম প্রতিষ্ঠানই আছে যাদের বছর শেষে টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। বর্তমান অবস্থায় টিউশন ফি পাওয়া যাচ্ছে না বলেই শিক্ষকদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। তবে যাঁরা সচ্ছল অভিভাবক তাঁরা যদি সবাই বেতন পরিশোধ করে দিতেন, তাহলে যাঁরা সত্যিকার অর্থেই সমস্যায় আছেন তাঁদের ব্যাপারে ভাবতে পারত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ।

প্রতিষ্ঠান ও অভিভাবকদের এই মুখোমুখি অবস্থানের মধ্যে গত সোমবার সারা দেশে এমপিওভুক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মাসিক বেতন আদায় কার্যক্রম স্থগিত রাখার নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়েছে। আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. সাইফুর রহমান আবেদন করেছেন। রিট আবেদনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (ডিজি), দেশের সব শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক) ও আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষকে বিবাদী করা হয়েছে।

গত এপ্রিলের শেষ দিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠানপ্রধানদের বলা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায়ের অনুরোধ জানানো হয় আদেশে। এ ছাড়া শিক্ষার আর কোনো দপ্তর থেকে টিউশন ফি আদায়ের ব্যাপারে এখন পর্যন্ত আর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি।

আইডিয়াল স্কুলের একজন অভিভাবক বলেন, ‘আমার স্বামী সর্বশেষ এপ্রিল মাসের বেতন পেয়েছে। অথচ স্কুল থেকে জুন মাস পর্যন্ত বেতনের জন্য চাপাচাপি করছে। বাচ্চা স্কুলেই গেল না, তাহলে শতভাগ বেতন পরিশোধ করাটা কি কোনো যুক্তির মধ্যে পড়ে?’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন ঊধ্বর্তন কর্মকর্তা বলেন, ‘আসলে আমাদের কাউকেই কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে সবাইকে বাস্তবতা মেনে চলতে বলব। যেসব স্কুলের পক্ষে সম্ভব, তারা যেন ছাড় দেয়। আর যেসব অভিভাবক সক্ষম তাঁরা যেন টিউশন ফি পরিশোধ করেন। তবে এই মুহূর্তে প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের চাপাচাপি করা ঠিক নয়।’

জানা যায়, নন-এমপিও দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর প্রণোদনার জন্য এরই মধ্যে উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা সারা দেশের শিক্ষক-কর্মচারীদের তালিকা সংগ্রহ করেছে। কিন্তু তালিকা সংগ্রহের পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় নন-এমপিও শতভাগ শিক্ষক-কর্মচারী এই তালিকায় নেই। আর যে পরিমাণ অর্থ দেওয়ার জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে তা একজন শিক্ষকের এক মাসের বেতনের অর্ধেকের চেয়েও কম। ফলে এই প্রণোদনার মাধ্যমে সংকটের পুরোপুরি সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তবে গত ১ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয় এক আদেশে প্রশাসনিক কাজের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার অনুমতি দেয়। এর পর থেকেই মূলত টিউশন ফি আদায়ে তৎপর হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো।


সর্বশেষ সংবাদ