২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:২৫

নেপথ্যে সরকারের নমনীয়তা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী-প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন কলেজগুলোতে সংঘর্ষের ঘটনা  © টিডিসি সম্পাদিত

গত ১০ দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের অন্তত ৯টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বড় ধরনের সহিংসতায় জড়িয়েছে। এতে নিহতের খবর পাওয়া না গেলেও আহত হয়েছেন কয়েকশ শিক্ষার্থী। ভাঙচুর ও লুটপাটে ক্ষতি হয়েছে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মধ্যে গত ১০ দিনেই সবচেয়ে বেশি সংঘাতে জড়ায় শিক্ষার্থীরা। এজন্য তারা এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নমনীয়তা এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা বলে মনে করছেন।

সরকারের নমনীয়তা বিষয়টি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর বক্তব্যের মধ্যেও ফুটে উঠেছে। গতকাল মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ছাত্ররা যেন রাস্তায় না নামে, রাস্তা ব্লক না করে। এতে জনগণের সমস্যা হয়। এটা তাদের বোঝাতে হবে। তাদের সঙ্গে আলোচনা করেই আমরা সব সমাধান করতে চাই। আমরা এ বিষয়ে কঠোর হতে চাই না।

১৮ নভেম্বর রাজধানীর সরকারি তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবিতে মহাখালীতে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ রাখেন ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা। তাদের এ কর্মসূচি থেকে নোয়াখালী থেকে ছেড়ে আসা ‘উপকূল এক্সপ্রেস’ ট্রেনে ইট-পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী-শিশুসহ বেশ কয়েকজন যাত্রী আহত হয়েছেন। পরে যাত্রীদের রক্তাক্ত হওয়ার একাধিক ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক সমালোচনা হয়।

গত ২০ নভেম্বর রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুই কলেজের শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এরপর কয়েকদিন কলেজ দুটি বন্ধ ছিল।

পরদিন গত বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আবাসিক হল খোলাকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়ায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এতে শিক্ষকসহ ১৫ জনের মতো আহত হয়েছে। পরদিন শুক্রবার (২২ নভেম্বর) ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের হামলার প্রতিবাদে নগরীতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ কর্মসূচি পালিত হয়েছে।

এসময়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় সংঘাতে জড়ায় পুরান ঢাকার সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যাত্রাবাড়ীর ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ শিক্ষার্থীরা। গত রবিবার ও সোমবার দুইদিন ব্যাপী চলে কলেজ দুটি সংঘর্ষ। এতে ভাঙচুর ও লুটপাটে ক্ষতি হয়েছে অন্তত অর্ধশত কোটি টাকা বলে দাবি প্রতিষ্ঠান দুটির।

পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর জেরে কলেজের শিক্ষার্থীরা মানববন্ধন করে। সেখানে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের ড্রেস পরিহিত কিছু শিক্ষার্থীর সাথে সংঘর্ষ জড়ায় তারা। এসময় মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঢাকার আরও একাধিক কলেজের শিক্ষার্থী যোগ দিয়ে সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভাঙচুর এবং লুটপাট করে। পরদিন সোমবার প্রতিশোধ হিসেবে সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজের ভাঙচুর এবং লুটপাট করে।  

এদিকে রবিবার রাতে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় (বুটেক্স) ও ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ। এতে আহত হয়েছেন শতাধিক শিক্ষার্থী। রাত ১০টার পর বুটেক্সের আজিজ হল ও ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইন্সটিটিউটের লতিফ হলের শিক্ষার্থীর মধ্যে এ সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে। সংঘর্ষের কারণ সম্পর্কে নানা তথ্য পাওয়া গেছে।

এসময় সংঘর্ষের পেছনে আসল উদ্দেশ্য কী? এর পেছনে কারা উসকানি দিচ্ছে, তা নিয়েও জল্পনা-কল্পনা চলছে। বিভিন্ন মহল থেকে শিক্ষার্থীদের এমন কর্মকাণ্ডে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরও শক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।

যদিও সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষে না জড়িয়ে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। সাম্প্রতিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সংঘাতের পেছনে যদি কোনো ইন্ধন থেকে থাকে, তবে তা খুঁজে বের করে দায়ীদের কঠোরভাবে দমন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সরকার।

এসব সংঘর্ষের পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাম্প্রতিক সংঘাতগুলো আমরা নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। আমাদের আহ্বান, শিক্ষার্থীরা যেন কোনো সংঘর্ষে লিপ্ত না হয় এবং পরিস্থিতি শান্ত রাখে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, বর্তমান পরিস্থিতি এক ধরনের অনিশ্চয়তার ইঙ্গিত বহন করছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে শান্তিপূর্ণ রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের মনোভাব বুঝে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে দায়িত্বশীল ভূমিকা নিতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের উচ্ছৃঙ্খল আচরণ বন্ধ করতে উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে শিক্ষার্থী সংগঠনগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক আধিপত্যের প্রভাব কমাতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান মিসেস শাহরিয়া আফরিন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, জনচলাচল ও স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে জনমনে যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা দূর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর হওয়া উচিত। একইসাথে যেকোনো দোষীদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। তবেই অরাজকতা কমে আসবে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের কেউ উসকিয়ে ভিন্ন উদ্দেশ্য হাছিলের চেষ্টা করছে কিনা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আরও বেশ সক্রিয় ভূমিকা রাখার কথা বলেন তিনি। এই শিক্ষিকা বলেন, আপদকালীন মুহূর্তে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের আরও বেশি সচেতন করতে হবে। যেন কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা না ঘটে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের অভিযোগ করে সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ কাকলী মুখোপাধ্যায় দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষার্থীরা সুপার সানডে ঘোষণা করেছে তাদের নিজস্ব গ্রুপে বিষয়টি সম্পর্কে আমি অবগত ছিলাম না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবগত ছিল কি না আমার জানা নেই। তারা জানলেও তারা আমাকে জানায়নি। আমি যখন জানতে পারি তখন তাদের অবহিত করি। তবে তাদের লোকবল কম ছিল যার কারণে শিক্ষার্থীদের হামলার মুখে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি বলে তারা মন্ত্রণালয়ে স্বীকার করেছেন।

ডা. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ চৌধুরী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানায়, আমাদের কলেজের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি।