নটর ডেমের গোল্ডেন জুবিলীতে সাবেক-বর্তমানদের মিলনমেলা, উৎসব
দেশের অন্যতম ও সেরা নামকরা উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজে চলছে ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর নানা আয়োজন। বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হওয়া জমকালো এ আয়োজনের পর্দা নামবে আগামীকাল শনিবার। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ৭৫ বছরে দীর্ঘ পথচলায় উচ্চ মাধ্যমিকের এ প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের গল্পই বেশি।
গত বছরের ৩ নভেম্বর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী থাকলেও ৭৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীকে জমকালো করতে জানুয়ারিতে উৎসব করে কলেজ কতৃপক্ষ। আয়োজনে অতিথি ছাড়াও থাকছেন দেশ ও দেশের বাইরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নটরডেমিয়ানরা। এছাড়াও কলেজ প্রাঙ্গণে মিলনমেলা ঘটেছে সাবেক এবং বর্তমান শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের।
আয়োজকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এবারের জমকালো আয়োজনে সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীদের মেলবন্ধন ঘটবে। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী কাজ করা নটরডেমিয়ানদের অ্যালামনাই আরও শক্তিশালী হবে। এছাড়াও কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীরা আবারও তাদের পুরনো দিনের কলেজের স্মৃতিতে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবেন।
এর আগে ১৯৪৯ সালের ৩রা নভেম্বর মাত্র ১৯ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ধর্মযাজকদের দ্বারা পরিচালিত এ শিক্ষালয়টি। পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার থেকে যাত্রা শুরু করা এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল সেইন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুল। পরবর্তীকালে রাজধানীর মতিঝিলে বড় পরিসরে নতুন ক্যাম্পাসে ১৯৫৫ সালের দিকে যাত্রা শুরু করে মিশনারি এই উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান নামে মুসলিম অধ্যুষিত পাকিস্তান গঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) গঠিত হলে শিক্ষা বিস্তারে তৎকালীন সরকার ক্যাথলিক চার্চের প্রধানকে কয়েকটি কলেজ স্থাপনের অনুরোধের প্রেক্ষিতে পূর্ব পাকিস্তানের ক্যাথলিক চার্চের প্রদান আর্চবিশপ লরেন্স গ্রেনার ছেলেদের জন্য কলেজ স্থাপনের নির্দেশ দেন হলি ক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজক ও সিস্টারদেরকে। সে নির্দেশের প্রেক্ষিতে ১৯৪৯ সালে লক্ষ্মীবাজারে সেন্ট গ্রেগরিজ কলেজ নামে সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে ক্লাস শুরু করে।
১৯৪৯ সালে ঢাকার লক্ষ্মীবাজারে হলিক্রস ফাদারগণ কর্তৃক ‘সেন্ট গ্রেগরি কলেজ’ নামে প্রথমে ক্যাথলিক কলেজ হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে প্রতিষ্ঠানটি। ১৯৫০ সালে ৬১/১ সুভাষবোস এভিনিউর একটি ভবনে কলেজটি স্থানান্তরিত হয় এবং একটি পূর্ণাঙ্গ কলেজ হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৯৫৪ সালে এটি মতিঝিলের বর্তমান স্থানে স্থানান্তরিত হয় এবং মাতা মেরির নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় নটর ডেম কলেজ। পবিত্র ক্রুশ সন্ন্যাস সংঘের ফাদারদের নীতি ও আদর্শ দ্বারা কলেজটি পরিচালিত হচ্ছে শুরু থেকে।
শুরুতে মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখা থাকলেও ১৯৫৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগও চালু হয়েছিল। শুরু থেকেই বোর্ড ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষায় সাফল্য পায় এখানকার শিক্ষার্থীরা। সাফল্যের অগ্রযাত্রায় পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের হলিক্রস সন্ন্যাস সংঘের যাজকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত এই উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে।
মূলত নটর ডেম কলেজ ব্যবহারিক নির্ভর মানসম্মত ও গুণগত শিক্ষায় যুগের চাহিদা ও সময়োপযোগী মানুষ তৈরির ব্রত পালন করছে নিষ্ঠার সাথেই। আদিবাসী, সংখ্যালঘু, খ্রিষ্টান ও মুসলিম শিক্ষার্থীদের নিয়ে বর্তমানে কলেজের শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৬ হাজার ৫০০। মিশনারি কলেজ হলেও এখানকার অধিকাংশ শিক্ষার্থীই মুসলিম, শতাংশের হিসেবে যা ৮৫ শতাংশ।
প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে ১৩টি বিভাগের অধীনে রয়েছেন মোট ৯১জন শিক্ষক। কলেজটির বর্তমান অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি। সুনির্দিষ্ট বাঁচাই ও ভর্তি পরীক্ষা, নিয়মিত কুইজ ও পরীক্ষা, ছাত্র-শিক্ষক সুসম্পর্ক ও শৃঙ্খলিত নিয়মের প্রতিপালনের ফলে প্রতিষ্ঠানটি অন্যদের থেকে আলাদা হতে পেরেছে বলে মনে করেন কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও সংশ্লিষ্টরা।
বিজ্ঞান বিভাগের ১৪টি বাংলা ও ২টি ইংরেজি, মানবিক শাখায় ৩টি ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখায় ৬টিসহ মোট ২৫টি গ্রুপে শিক্ষাদান করা হয় কলেজটিতে। শিক্ষার্থীদের দায়িত্বশীল ও নেতৃত্বের গুণাবলি সম্পন্ন করতে নটর ডেম কলেজে রয়েছে হচ্ছে ২৫টি ক্লাব।
বাংলাদেশের প্রথম ডিবেটিং (বিতর্ক) ক্লাব নটরডেম ডিবেটিং ক্লাবও নটর ডেম কলেজেরই। যাকে বলা হয় ‘ফাদার অব ডিবেটিং’ ক্লাব (Father of debating). এছাড়াও রয়েছে বিজ্ঞান ক্লাব, গণিত ক্লাব, ইন্টারন্যাশনাল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এন্ড রিলেশন ক্লাব, ইংলিশ ক্লাব, চেজ ক্লাব, আইটি ক্লাব ইত্যাদি।
নটর ডেম কলেজের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে কলেজের অধ্যক্ষ ড. ফাদার হেমন্ত পিউস রোজারিও, সিএসসি জানিয়েছেন, আমাদের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের নিষ্ঠা ও পরিশ্রমের ফলেই নটর ডেম কলেজের এতো সাফল্য। আজকের এই অবস্থান।
নটর ডেম কলেজের সকল শিক্ষার্থীরা আর্ত-মানবতার সেবায় কাজ করবে এমন আশাবাদ জানিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, আগামীতে আরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত করতে চায় কলেজ কর্তৃপক্ষ। পাশাপাশি একটি অডিটোরিয়াম ও হেরিটেজ ভবন করার পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের।
একইসঙ্গে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যুগোপযোগী করে গড়ে তোলার কথাও বলেন তিনি। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য আবাসনের কোন সুযোগ নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সংশ্লিষ্টদের আগামীতে আরও বেশি দায়িত্বশীল হওয়ার হতে হবে।