১৯ এপ্রিল ২০২৩, ২৩:২১

অধ্যক্ষ শেলীকে চাকরিচ্যুতের প্রতিবাদ, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি

রাজধানীর শাহবাগে অধ্যক্ষ সেলিনা শেলীকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে সমাবেশ   © টিডিসি ফটো

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের অবৈধ ও প্রতিহিংসামূলক সিদ্ধান্তে কবি ও অধ্যক্ষ সেলিনা শেলীকে চাকরিচ্যুত করার প্রতিবাদে সমাবেশ করেছে ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’। একই সঙ্গে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বাতিল করার দাবিও জানানো হয় সমাবেশ থেকে।

বুধবার (১৯ এপ্রিল) রাজধানীর শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে এ প্রতিবাদ সমাবেশ হয়। প্রতিবাদ সমাবেশে কবি, শিক্ষক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ অংশ নেন।

সমাবেশের অন্যতম সংগঠক রবিন আহসান বলেন, মৌলবাদীদের ষড়যন্ত্র ও রোষানলের শিকার চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা শেলীকে হয়রানির প্রতিবাদে আমরা এই সমাবেশ করছি। একজন কবিকে ফেসবুকে কয়েকটি শব্দ লেখার জন্য চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এই ঘটনা ন্যক্কারজনক।

ডিজিটাল অ্যাক্ট বাতিলের দাবিতে অন্তত ৬০টির বেশি সমাবেশ করার কথা জানিয়ে রবিন আহসান বলেন, ডিজিটাল অ্যাক্টের মাধ্যমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে দমন করা হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ করে যাচ্ছি।

একটা শব্দ লেখার জন্য কলেজ কর্তৃপক্ষ যেভাবে সেলিনা শেলিকে চাকরিচ্যুত করেছে, তাতে জামায়াত-শিবির চক্রের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে মনে করেন নাট্যকার রতন সিদ্দিকী।  

তিনি বলেন, সেলিনা শেলী চট্টগ্রাম বন্দরে স্কুল, কলেজে পড়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রগতিশীল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। এজন্য তিনি শিবিরের হামলার শিকারও হয়েছেন।

সেলিনা শেলী যখন কলেজে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন, তখন থেকেই জামায়াত-শিবিরের টার্গেটে ছিলেন উল্লেখ করে রতন সিদ্দিকী বলেন, শেলী কলেজের উপাধ্যক্ষ হলেন এবং কিছুদিন আগে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হলেন। জামায়াত-শিবির একটা ইস্যু খুঁজছিল তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দেওয়ার। ফেসবুকে লেখা একটা পোস্টকে ইস্যু বানিয়ে তারা এখন সেলিনা শেলীকে চাকরিচ্যুত করেছে।

সমাবেশে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি শরিফুজ্জামান, কবি আলফ্রেড খোকন, আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অলিক নৃ, মুশফিকা লাইজু, নাট্যনির্দেশক অলোক বসু, কবি শাহেদ কায়েস, সাকিরা পারভীন, আফরোজা সোমা, কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেত্রী সুমাইয়া সেতুসহ আরও অনেকে। উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর মীর সাখাওয়াত হোসেন ও সুস্মিতা কীর্তনীয়া গান পরিবেশন করে সমাবেশে সংহতি জানান।  

কবি আলফ্রেড খোকন বলেন, সেলিনা শেলীকে ফেইসবুকে লেখার জন্য চাকরিচ্যুত করার পেছনে ষড়যন্ত্র রয়েছে। নাহলে সামান্য এই শব্দের জন্য কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়া একজনকে হুট করে বহিষ্কার করে দেবে, এটা হতে পারে না। শেলী আপা একজন প্রগতিশীল শিক্ষক। বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলনে তিনি ভূমিকা রেখেছেন। তাকে বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। কোনো তদন্ত ছাড়াই তাকে শাস্তি দেওয়ার এই প্রক্রিয়াটি দেখে মনে হচ্ছে এটা পুতুলখেলা। ইচ্ছা হলো চাকতিচ্যুত করা হলো। এমন পুতুলখেলা বন্ধ হোক।

কবি আফরোজা সোমা বলেন, একজন কবি তিনি শব্দ নিয়েই তো কাজ করেন। তিনি ফেসবুকে রমজান কেন ‘রামাদান’ হলো। সেটা নিয়ে একটু স্যাটায়ার করেছেন। তার জন্য চাকরিচ্যুত করাটা ভীষণ অন্যায়। ডিজিটাল অ্যাক্টের মাধ্যমে এখন সামান্য বিষয়কেও যেভাবে দমন করা হচ্ছে, সেটা ভীতিকর। কণ্ঠরোধ করার এই আইন বাতিল করতে হবে এবং কবি সেলিনা শেলী যে ভীতিকর অবস্থায় রয়েছেন তাকে চাকরি ফিরিয়ে দিয়ে মত প্রকাশের পথকে মুক্ত করে রাখতে হবে।

গত তিনদিন আগে ফেসবুকে মন্তব্য নিয়ে বিতর্কের জেরে চট্টগ্রাম বন্দর মহিলা কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা আক্তার শেলীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কর্তৃপক্ষ। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মমিনুর রশিদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সেলিনা আক্তার শেলীকে বরখাস্তের বিষয়টি জানানো হয়।

বন্দর কর্তৃপক্ষের নোটিশে বলা হয়েছে, ফেসবুকে পবিত্র রমজান মাসের আরবি উচ্চারণ ‘রামাদান’কে কটাক্ষ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে অসংখ্য মানুষ আপনার পোস্টের মন্তব্যে এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র প্রতিবাদ ও প্রতিক্রিয়া জানায়।

এ বিষয়ে বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক জানিয়েছেন, ফেসবুকে এক পোস্ট নিয়ে বির্তক হওয়ায় উনাকে সাময়িক বরখাস্ত এবং বিভাগীয় মোকদ্দমা করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত করা হচ্ছে।

প্রতিবাদ সমাবেশে কথাসাহিত্যিক মোজাফফর হোসেন বলেন, যেকোনো বিষয় নিয়ে সমালোচনা করার অধিকার আমাদের রয়েছে। আবার সেই সমালোচনা গ্রহণ না করার অধিকারও সবার রয়েছে। ফেসবুক পোস্ট কারো পছন্দ না হলে ইগনোর করতে পারেন। কিন্তু একটা প্রতিষ্ঠান অতি-উৎসাহী হয়ে সেলিনা শেলীকে চাকরিচ্যুত করলো। এই অতি-উৎসাহী হওয়ার পেছনে কী উদ্দেশ্য তা খতিয়ে দেখতে হবে।

সাকিরা পারভীন সোমা বলেন, এখন জীবনানন্দ দাশের কবিতাও পাঠ্য বই থেকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমাদের এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে।

আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কথা বলে, অথচ তাদের সময়ে জামায়াত-শিবিরের এই আগ্রাসী রূপ কেন প্রশ্ন রেখে কবি শাহেদ কায়েস বলেন, সেলিনা শেলীর সাথে যে ঘটনাটি ঘটেছে, সেটি বর্তমান বাংলাদেশের চিত্রকে তুলে ধরে। সারা জীবন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা সেলিনা শেলী একটা শব্দ বলেছেন, যেটি ধর্মের বিপক্ষে নয়। শেলী বলেছেন রমজান কিভাবে রামাদান হলো। এই শব্দটি বেমানান লাগে। কিন্তু এই শব্দ লেখার জন্য তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা। সেলিনা শেলীকে যদি চাকরিতে বহাল না করা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ অন্ধকারের দিকেই হাঁটবে।

সরকারকে উদ্দ্যেশ্য করে মুশফিকা লাইজু বলেন, তোমারে বধিবে যে গোকূলে বাড়িছে সে। এদের রুখে দাঁড়াতে না পারলে তারা আপনাকেও বধিবে। তখন আর পথ থাকবে না।

ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী সুমাইয়া সেতু বলেন, একটি শব্দতে অনুভূতিতে আঘাত লাগে, অথচ কত মানুষ ক্ষুধার্ত, কত মানুষ ঈদের আনন্দ করতে পারছে না। তখন তো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না। ওয়াজ মাহফিলে প্রতিনিয়ত নারীদের অবমাননা করা হচ্ছে, তখন তো কারো অনুভূতিতে আঘাত লাগে না।

মানুষ যখন তার অধিকার নিয়ে কথা বলছে। তখন ডিজিটাল আইনে দমন করা হচ্ছে উল্লেখ করে উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক অমিত রঞ্জন দে বলেন, কোনো ধরনের তদন্ত না করে সেলিনা শেলীকে যেভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, সেটা অন্যায়। এই অন্যায় যারা করেছে সেই বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং কলেজ পরিচালনার সাথে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে।

নাট্যনির্দেশক অলোক বসু বলেন, কবি এখন কবিতা লিখতে পারছে না। কারণ বাংলাদেশে এখন অনুভূতির চাষাবাদ হচ্ছে। আমাদের পহেলা বৈশাখ নিয়ে তারা বিতর্ক তৈরি করছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের যে সরকার আছে, তাদের বোধদয় হওয়া দরকার। এই অনুভূতির চাষাবাদ বন্ধ না হলে দেশ অন্ধকারে হারিয়ে যাবে।

নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগের সংগঠক খান আসাদুজ্জামান মাসুম বলেন, আমরা এই প্রতিবাদ সমাবেশ করে করে ক্লান্ত হয়ে গেছি। আওয়ামী লীগ যেভাবে রাষ্ট ক্ষমতায় থেকে সাম্প্রদায়িক চাষাবাদ করছে, সেখানে সেলিনা শেলীর মতো প্রগতিশীল মানুষ আক্রান্ত হবেন, এতে আমি অবাক হই না। কারণ আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে আমি আর প্রত্যাশা করি না। সরকার জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে চায় না। তারা এখন সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করছে।