কলেজ এমপিওর পর চাকরি গেল ৭ শিক্ষকের, নতুনদের টাকায় নিয়োগের অভিযোগ
২০২২ সালের ৬ জুলাই নতুন করে ২ হাজার ৭১৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করেছিল সরকার। এরমধ্যে একটি ছিল শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলার কাকিলাকুড়া মালেকুননিসা হজরত আলী কলেজ। ২০১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে যারা শিক্ষক-কর্মচারী হিসেবে কর্মরত ছিলেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাদের একটি অংশকে বিনা নোটিশে চাকরিচ্যুত করার অভিযোগ উঠেছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, এমপিওভুক্ত হওয়ার পর কলেজ সভাপতি-অধ্যক্ষ নিয়োগ বাণিজ্য করে হাতিয়েছেন কোটি টাকা। তাদের অভিযোগ, কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মো. আবদুল খালেক ও কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম দুজনে মিলে এমপিওভুক্ত হওয়ার পর কলেজটির শুরু থেকে চাকরিতে থাকা নিয়মিত ৭ জন শিক্ষক ও ২ জন ল্যাব ও অফিস সহায়ককে চাকরিচ্যুত করেছেন। মোটা অংকের টাকা দিতে না পারায় এসব শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরিচ্যুত করে তাদের স্থলে নতুনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু একটি ‘প্রভাষক’ পদের নিয়োগে লেনদেন হয়েছে ১৫ লাখ টাকা। বর্তমানে চাকরি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন চাকরিচ্যুত এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা।
কাকিলাকুড়া মালেকুননিসা হজরত আলী কলেজ
শিক্ষকদের এমন অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে নানা অনিয়মের সত্যতা পেয়েছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস। অনুসন্ধান বলছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন দপ্তরের উপ-পরিচালক ও ওই কলেজের সভাপতি মো. আবদুল খালেক কলেজের শুরু থেকে চাকরিতে থাকা শিক্ষকদের থেকে ৭ জন শিক্ষক এবং একজন ল্যাব সহকারী ও একজন অফিস সহকারীকে বাদ দিয়ে তাদের স্থলে নতুন নিয়োগ করে দেওয়া হয়েছে।
নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি অগ্রাধিকার দিয়েছেন বেশি অর্থ প্রদানকারী শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের। একইসঙ্গে অর্থ না দেওয়া বা নিতে না পারার কারণে নতুন তালিকায় বাদ পড়েছেন কলেজ সভাপতি মো. আবদুল খালেকের ভাইয়ের মেয়ে এবং কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাহমিনা আক্তার সুরমী। সুরমীর স্থলে অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বর্তমান অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিমকে। বর্তমান অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম নিয়োগ পাওয়ার পূর্বে কর্মরত ছিলেন বেসরকারি পদ্মা ব্যাংকের শেরপুর নালিতাবাড়ি শাখায়।
কাকিলাকুড়া মালেকুননিসা হজরত আলী কলেজের এমপিওভুক্তির পর চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন- সাবেক অধ্যক্ষ তাহমিনা আক্তার সুরমী, ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক মো. মহিউদ্দিন সরকার, আইসিটির শিক্ষক সুরাইয়া জাহান, ফিন্যান্স ব্যাংকিং ও বীমা বিষয়ের শিক্ষক মো. আওয়াল হোসাইন, পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের শিক্ষক এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন, রসায়ন বিষয়ের শিক্ষক মৃণাল চন্দ্র দাস এবং উৎপাদন, ব্যবস্থাপনা ও বিপণন বিষয়ের শিক্ষক মো. জাকির হোসাইন প্রভাষক। এছাড়াও এমপিওভুক্তির পর চাকরি হারানোর তালিকায় রয়েছেন ল্যাব সহকারী মো. আমিনুল ইসলাম ও অফিস সহকারী মো. মজনু রহমান।
অনুসন্ধান বলছে, নতুন নিয়োগ দেয়া শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির আগের তারিখ দেখিয়ে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন চূড়ান্ত করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানো হয়েছে। তাতে গরমিল রয়েছে বয়সেও; নতুন নিয়োগ পাওয়া কলেজের অফিস সহকারী (কাম হিসাব সহকারী) মো. আবুল হাশেমের যোগদানের সময় বয়স দেখানো হয়েছে ৪২ বছর ২ মাস ১০ দিন।
অথচ স্কুল-কলেজের জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা-২০২১ অনুযায়ী, চাকরিপ্রার্থীর বয়স ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে হলে নিয়োগ অবৈধ হবে। তবে, এ নিয়োগে অগ্রাধিকারে উঠে এসেছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের বিষয়টি; নিয়োগপ্রাপ্ত মো. আবুল হাশেম কলেজের বর্তমান সভাপতি মো. আবদুল খালেক পত্নীর বড়ভাই।
অন্যদিকে, কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম কলেজে যোগদান করেন বিগত সাত-আট মাস আগে; কিন্তু তার যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ২০১৬ সালের অক্টোবরের ২০ তারিখে। আর ২০১৩ সালে কলেজের যাত্রা শুরুর পর থেকে পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়র প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে থাকা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনকে চাকরিচ্যুত করে তার স্থলে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে শফিকুল ইসলাম নামের এক শিক্ষককে।
চাকরিচ্যুত শিক্ষকদের অভিযোগ, নতুন নিয়োগে শিক্ষকদের কাছ থেকে জনপ্রতি ১৫ থেকে ২০ লাখ করে নিয়েছেন কলেজের সভাপতি আবদুল খালেক এবং এই কাজে তাকে সহায়তা করেছেন কলেজ অধ্যক্ষ রেজাউল করিম।
২০১৩ সালে কলেজটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে চাকরি করে আসা বেশ কয়েকজন শিক্ষক অভিযোগ করে জানান, মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে দীর্ঘ দিন থেকে শিক্ষকতা করা শিক্ষকদের বিনা নোটিশে মৌখিকভাবে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ অনৈতিক। প্রতিটি নিয়োগের বিপরীতে ১৫ থেকে ২০ লাখ করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে কলেজের সভাপতি আবদুল খালেক ও অধ্যক্ষ রেজাউল করিম নতুন শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে। এছাড়াও হঠাৎ চাকরিচ্যুত এসব শিক্ষককে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেত দেওয়া হয়নি। চাকরি হারিয়ে বর্তমানে মানবেতর জীবনযাপন করছেন চাকরিচ্যুত শিক্ষক-কর্মচারীরা।
এসব বিষয় নিয়ে কলেজের শুরু থেকে শিক্ষকতা করে আসা প্রভাষক এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, প্রতিষ্ঠাকালীন (২০১৩ সাল) থেকে এই কলেজে শিক্ষকতা করেছি। এই কলেজের মাটির সাথেও এখন আমার সম্পর্ক। সম্প্রতি এমপিওভুক্ত হওয়ার পর হঠাৎ কলেজের সভাপতি আবদুল খালেক আমাকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন, আমাকে আর কলেজে আসার দরকার নেই। এটি শুনে আমি অনেকটা হতভম্ব হয়েছি; আমি তো কোন অপরাধ করিনি।
কেন আমাকে অপমানজনকভাবে কলেজ থেকে চকরিচ্যুত করা হল— এমন প্রশ্ন জানিয়ে এই শিক্ষক বলেন, এরপর খবর নিয়ে জানতে পেরেছি, আমার পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ে শফিকুল ইসলাম নামের একজনের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নগদ নিয়ে আমাকে কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
এ নিয়ে চাকরিচ্যুত আরেক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে আমাকে চাকরিচ্যুত করে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এটি করেছেন কলেজের সভাপতি আবদুল খালেক। টাকা ছাড়া তিনি কিছুই বুঝেন না; কলেজটিকে তিনি অবৈধ বাণিজ্য কেন্দ্র বানিয়েছেন বলে অভিযোগ তার।
কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাহমিনা আক্তার সুরমীর কাছে সার্বিক অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে তিনি বিস্তারিত জানেন না; তাঁকে তার চাচা (কলেজের সভাপতি) দায়িত্ব দিয়েছিলেন, কিন্তু কলেজে তার সেভাবে যাওয়া হয়নি। সব কাজ ভারপ্রাপ্ত দায়িত্বে যিনি ছিলেন তিনি করে দিতেন—তবে, এমপিওভূক্তির পর চাকরি হারানো এ শিক্ষক প্রতিবেদকের সাথে কথা বলেছেন কলেজের সভাপতি অর্থাৎ তার চাচার পক্ষ নিয়ে।
তার বক্তব্যে উঠে আসে, তিনি শুধুমাত্র দায়িত্বেই ছিলেন; বাকিসব কাজ কাজ ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ এবং সভাপতিই করতেন। এমনকি তিনি চিনতেন না কলেজের নিয়মিত শিক্ষকদেরও। এছাড়াও কলেজের সাবেক এই অধ্যক্ষ জানেনই না তিনি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কতদিন এবং কখন থেকে দায়িত্বে ছিলেন। তবে, এমপিওভূক্তির পর তার চাকরি না থাকার বিষয়টি তিনি জানতে পেরেছেন।
কাকিলাকুড়া মালেকুননিসা হজরত আলী কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ মো. রেজাউল করিম বলেন, এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বানোয়াট। তার মতে, জেলা প্রশাসন থেকে যে তদন্ত করা হয়েছে; তাতে তারা এর জবাব দিয়েছেন।
এমপিওভুক্তির পর চাকরিচ্যুতির বিষয়ে তিনি বলেন, কাউকে চাকরিচ্যুত করা হয়নি। এনটিআরসিএ’র গণবিজ্ঞপ্তি পর তারা চলে গেছেন। ফলে শূন্য পদেই নিয়োগ দেয়া হয়েছে, কাউকে বাদ দেওয়া হয়নি।
কলেজের পৌরনীতি ও সুশাসন বিষয়ের প্রভাষক হিসেবে চাকরিতে থাকা এস এম আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তিনি এখানে শিক্ষক হিসেবে ছিলেনই না। তবে, শিক্ষক হিসেবে না থাকলেও তিনি শিক্ষকের তালিকায় ছিলেন এবং বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা কিভাবে পেয়েছেন— এমন প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি মো. রেজাউল করিম। উল্টো তিনি বলেন, সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে তিনি অন্যায় করেছেন।
আর সকল অভিযোগ ভিত্তিহীন দাবি করে কলেজের সভাপতি মো. আবদুল খালেক জানান, তিনি অফিসে ব্যস্ত রয়েছেন; পরে কথা বলবেন। এরপর তার সাথে আর কোনো যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি এই প্রতিবেদকের।
এ বিষয়ে শেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার মো. রেজুয়ান বলেন, এমপিওভুক্তির পর শিক্ষকদের নিয়োগ এবং আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে আমি কিছু জানি না; তবে, একজন শিক্ষক অভিযোগ করেছিলেন। কিন্তু, তিনি কোনো প্রমাণ দিতে পারেননি বিধায় আমরা কোনো ব্যবস্থা নিতে পারিনি। নিয়োগ বাণিজ্যসহ যেসব অনিয়মের কথা এসেছে তা নিয়ে যদি কেউ অভিযোগ করেন, তাহলে আমরা তা খতিয়ে দেখবো।