ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে যা করবেন
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা অনেক স্বপ্নবাজ ছাত্র-ছাত্রীর অন্তরে লুকায়িত আছে। তাদের মধ্যে অনেকেই স্বপ্ন পূরণে সক্ষম হয়। আবার অনেকই ব্যর্থতার অতল গহ্বরে তলিয়ে যান। প্রতিটি স্বপ্নই খুবই মূল্যবান। কোনো স্বপ্ন যেন অতলে হারিয়ে না যায় সেজন্য আমি আলোচনা করবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চান্স পেতে কী কী পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে? তাহলে মূল আলোচনায় যাওয়া যাক।
প্রথমত, শিক্ষার্থীর স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে ঢাবির ইউনিট বা বিভাগগুলো সম্পর্কে। ঢাবিতে মোট পাঁচটি বিভাগে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়। বিভাগগুলো হলো— ক খ গ ঘ চ।
‘ক’ ইউনিটে শুধু বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে। ‘খ’ ইউনিটে শুধু মানবিকের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করবে। ‘গ’ ইউনিটে শুধু ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে। ‘ঘ’ ইউনিটে সব ইউনিটের (ক খ গ) শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে। কিছু শর্ত সাপেক্ষে। ‘চ’ ইউনিটে সব ইউনিটের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করতে পারবে।
প্রতিটি ইউনিটে অংশগ্রহণের জন্য শিক্ষার্থীদের আলাদা যোগ্যতার প্রয়োজন আছে। যেমন—
‘ক’ ইউনিটে অংশগ্রহণের জন্য এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৮.০০ থাকা আবশ্যক এবং পৃথকভাবে দুটিতে জিপিএ ৩.৫০ থাকতে হবে। ‘খ’ ইউনিটে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৭.০০ এবং পৃথকভাবে দুটি পরীক্ষায় ৩.০০ থাকা বাধ্যতামূলক। ‘গ’ ইউনিটে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৭.৫০ এবং পৃথকভাবে দুটি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.৫০ থাক বাধ্যতামূলক।
‘ঘ’ ইউনিটে মানবিকের পরীক্ষার্থীদের জন্য এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৭.০০ বিজ্ঞানের পরীক্ষার্থীদের জন্য জিপিএ ৮.০০ এবং ব্যবসায় শিক্ষা পরীক্ষার্থীদের জন্য জিপিএ ৭.৫০থাকতে হবে। নাহলে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
‘চ’ ইউনিটে এসএসসি ও এইচএসসিতে ন্যূনতম জিপিএ ৬.৫০ এবং পৃথকভাবে দুটি পরীক্ষায় জিপিএ ৩.০০ থাকা আবশ্যক। এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলে চতুর্থ বিষয়সহ জিপিএ গণ্য করা হবে। এটা সব ইউনিটের জন্য প্রযোজ্য।
এবারে ইউনিটগুলোর মানবণ্টন আলোচনা করা যাক,
প্রতিটি ইউনিটে (ক খ গ ঘ চ) ১২০ মার্কসের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা এমসিকিউ ও লিখিত দুভাবে নেওয়া হয়। (ক খ গ ঘ) ইউনিটে এমসিকিউতে ৭৫ নাম্বার আছে। প্রশ্ন থাকে ৬০টি। সময় ৫০ মিনিট। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১.২৫। প্রতিটি ভুলের জন্য দশমিক ২৫ নাম্বার কাটা যাবে। তবে ‘ঘ’ ইউনিটে প্রতিটি ভুলের জন্য দশমিক ৩০ নাম্বার কাটা যাবে।
লিখিত পরীক্ষার ক্ষেত্রে ইউনিট ভেদে প্রশ্নের সংখ্যার তারতম্য লক্ষ্য করা যায়। ৪৫ নাম্বার আছে লিখিত পরীক্ষায়। সময় ৪০ মিনিট। এমসিকিউ এবং লিখিত পরীক্ষার মোট সময় (৫০+৪০) মিনিট = ৯০ মিনিট বা ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট।
তবে ‘চ’ ইউনিট একটু ব্যতিক্রমী। এই ইউনিটে দুই ধাপে পরীক্ষা নেওয়া হয়। প্রথমত এমসিকিউ, দ্বিতীয়ত অঙ্কন (ফিগার ড্রয়িং)। ৫০টি এমসিকিউ থাকে। প্রতিটি প্রশ্নের মান ১। সময় ১ ঘণ্টা। ফিগার ড্রয়িংয়ে ৭০ নাম্বার আছে। সময় ১ ঘণ্টা ৩০ মিনিট।
এবার পাস নাম্বার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক!
ক খ গ ঘ ইউনিটে এমসিকিউতে ৩০, লিখিত পরীক্ষায় ১২ এবং সর্বমোট ৪৮ মার্কস না পেলে অকৃতকার্য হিসেবে বিবেচিত হবে। ‘চ’ ইউনিটে ৫০ নাম্বারের এমসিকিউ পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম ১৫০০ জন ফিগার ড্রয়িং পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারবে। পাস নাম্বার ৪৮।
মেধাতালিকা নির্ণয়ঃ
‘চ’ ইউনিট বাদে বাকি ইউনিটগুলোতে মেধাতালিকা নির্ণয় করা হয় মোট ২০০ মার্কসের ভিত্তিতে। এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার প্রাপ্ত ফলাফলে ৮০ মার্কস থাকে। এসএসসি পরীক্ষার প্রাপ্ত জিপিএ ৬ দ্বারা এবং এইচএসসি পরীক্ষার প্রাপ্ত জিপিএ ১০ দ্বারা গুণ করে ভর্তি পরীক্ষায় প্রাপ্ত নাম্বার যোগ করে মেধাতালিকা তৈরি করা হয়। ‘চ’ ইউনিটে শুধু ১২০ মার্কসের পরীক্ষা হয়। এখানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ যুক্ত হয় না।
সুতরাং একটি বিষয় খুবই পরিষ্কার যে, ঢাবিতে চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার জিপিএ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপরে বর্ণিত বিষয়গুলো সম্পর্কে একজন পরীক্ষার্থীর অবশ্যই জানা থাকা জরুরি।
এবার আলোচনা করবো কীভাবে, কতক্ষণ পড়লে ঢাবিতে চান্স পাওয়া যাবে। চান্স পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো কী কী। সেগুলো থেকে উত্তরণের উপায়—
আমাদের দেশে দেখা যায় এইচএসসি পরীক্ষার পরে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়। আবার অনেকে বাসায় ভর্তির প্রস্তুতি নিয়ে থাকে। যারা কোচিং করবে তাদের জন্য পরামর্শ হলো কোচিংয়ের শিটগুলো ভালোভাবে পড়া। শুধু শিটের ওপর নির্ভর করে থাকলে চলবে না। এডমিশন সংক্রান্ত বহু বই বাজারে পাওয়া যায় সেগুলো সংগ্রহ করে পড়া।নিয়মিত নিউজপেপার পড়া, কারেন্ট আ্যফেয়ার্স/ টাইমস পড়া। আমি কারেন্ট টাইমস পড়তাম। এটা অনেক ভালো।
মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বুলেটিন বের হয় সেগুলো পড়া। বিশেষত পরীক্ষার কিছুদিন আগে ‘বিশেষ বুলেটিন’ বের হয় সেগুলোতে চোখ রাখতে হবে। সাম্প্রতিক বিষয়াবলি সম্পর্কে চোখ, কান খোলা রাখতে হবে। সামান্য তথ্যও বাদ দেওয়া যাবে না যেটা ভর্তি সংক্রান্ত। ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজির ভোকাবুলারিতে স্ট্রং হতে হয়। ‘Saifur's Vocabulary’ বইটা পড়া যেতে পারে ভোকাবুলারি স্ট্রং করার জন্য। এছাড়াও Compact/ Competitive English বইগুলো ইংরেজির জন্য অসাধারণ।
সাধারণ জ্ঞানের জন্য ‘চমক’ বইটা পড়া যেতে পারে। খুবই উপকারে আসে। বাংলার ক্ষেত্রে ‘বাংলা প্লাস’ বা ‘বাংলা প্যানাসিয়া’ পড়লে অনেক লাভ হবে। নবম দশম শ্রেণির বাংলা ব্যাকরণটা খুবই ভালো করে পড়তে হবে। এছাড়াও এইচএসসির বাংলা ও ইংরেজি সাহিত্যটা সম্পর্কে ভালো করে জানা থাকতে হবে।
এসএসসি ও এইচএসসিতে পড়াশোনার ভিত্তি ঠিক থাকলে কোচিং সময়ে বেশি ঝামেলায় পরতে হয় না। কোচিং সময়টাই জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। এই সময়টাকে যে কাজে লাগাবে সে বাকী জীবন উপভোগ করতে পারবে। এসময়ে প্রতিটি মিনিটই গুরুত্বপূর্ণ। সময়কে অযথা নষ্ট করা যাবে না একেবারেই। আমি ‘খ’ ইউনিটের পরীক্ষার্থী ছিলাম তাই আমার সাজেশনগুলো বিশেষভাবে মানবিকের পরীক্ষার্থীদের উপকারে আসবে।
নানারকম প্রতীবন্ধকতা সৃষ্টি হয় কোচিং সময়ে। যারা প্রথম ঢাকায় আসে তাদের জন্য অনেক সমস্যা হয়। যেমন, থাকা, খাওয়া, পানি, যাতায়াত ও বিভিন্ন অসুস্থতা। এগুলো আমার ক্ষেত্রে ঘটেছিল। শুরুতে খাবার নিয়ে ব্যাপক ঝামেলায় পরতে হয়েছিল। শুধু আমি নই আমার বন্ধুদের একই অবস্হা হয়েছিল। এসব অবস্থা দেখে আমার বেশ কয়েকজন বন্ধু ঢাকা ছেড়ে জেলা শহরের কোচিং-এ ভর্তি হয়েছিল।
তবে আমরা যারা ছিলাম তাদের প্রায় সবারই চান্স হয়েছে। অনেকে পড়াশোনা না করে পিছিয়ে যায় তারপর এগুলোর দোষ দিয়ে থাকে। এসব প্রতিবন্ধকার অজুহাতে পড়াশোনার ক্ষতি করা যাবে না। মনে রাখতে হবে জীবনটা নিজেকে গড়তে হবে। ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলের দিন চান্স না পেলে কেউ বুঝবে না তুমি ডেঙ্গুতে পাঁচ দিন বিছানায় পরে ছিলে, নাকি ফার্মগেটের জ্যামে দুই ঘণ্টা আটকে ছিলে। সবাই জানতে চাইবে চান্স হয়েছে কিনা।
পরীক্ষার দেড় থেকে দুমাস আগে ডিপ্রেশন নামে একটা ভূত মাথায় সবসময় ঘুরঘুর করবে। মনে হবে আমি অনেক পিছিয়ে আছি, কিছুই পড়তে পারিনি, অনেক পড়া বাকী আছে। এরকম হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। তবে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে হবে। ভেঙ্গে পরলে চলবে না। আত্মবিশ্বাস রাখতে হবে— ‘আমি পারবো, আমাকে পারতেই হবে, আমার দ্বারা হবে।’
তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী হওয়া যাবে না। এটা প্রচন্ড ক্ষতিকর। জীবনকে খাঁদের কিনারায় ফেলতে এটাই যথেষ্ট। আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখার জন্য বাজারে প্রচুর টেস্ট পেপার পাওয়া যায় সেগুলো অনুশীলন করা দরকার। ব্যক্তিগত অনুশীলন আত্মবিশ্বাস ঠিক রাখতে সাহায্য করবে।
অনেকে মনে করে সারাদিন শুধু বই ধরে বসে থাকলে চান্স পাওয়া যাবে। এটা ভুল ধারণা। কেউ অল্পতেই মনে রাখতে পারে আবার কেউ অনেক পড়ে মনে রাখতে পারে না। এটা সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মেধা ও স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করে। কেউ যদি মনে করে আমি সারাদিনে তিন ঘণ্টা করে পড়ে পরীক্ষা দেব, আমি অল্পতেই মনে রাখতে পারি। আবার কেউ যদি বলে, আমি আট থেকে দশ ঘণ্টা করে পড়বো, আমি মনে রাখতে পারি না।
তাহলে তাদেরকে তাদের মতো পড়তে দেওয়া উচিত। আবার অনেকে রুটিন অনুযায়ী পড়তে পছন্দ করে, অনেকে স্বাধীন মতো পড়তে চায়। একটা বিষয় খেয়াল করতে হবে যার যেভাবে, যতক্ষণ পড়া আদায় হয় সে সেভাবে পড়বে। এতে ধরাবাঁধা কোনো নিয়ম করা উচিত নয়। তবে মনে রাখতে হবে পরীক্ষা দেওয়ার আগ পর্যন্ত পড়াশোনার ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে হবে।
একদিন ১২ ঘণ্টা পড়াশোনা করে বাকী তিন চার দিন পড়াশোনার কোন খোঁজ খবর নাই এরকম হওয়া যাবে না।
যারা এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫.০০ পায়নি তাদের মন খারাপ করার কিছুই নেই। ভর্তির সময়ে একনিষ্ঠ হয়ে পড়াশোনা করলে চান্স হয়ে যাবে। এরকম বহু উদাহরণ আছে যারা দুটো পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ পায়নি।সুতরাং পড়াশোনা চালিয়ে যাও।
যারা মেস বা হোস্টেলে থাকবে তারা অবশ্যই বন্ধু নির্বাচনে মেধাবী, পরিশ্রমী, উপকারী বন্ধু নির্বাচন করবে। যাবতীয় নেশা থেকে দূরে থাকতে হবে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ ডিএক্টিভেট করে দেবে। স্মার্টফোন ব্যাবহার না করাই ভালো। যোগাযোগের জন্য বাটন সেট মোবাইল ব্যাবহার করা যেতে পারে। ঘোরাঘুরির অভ্যাস থাকলে বাদ দিতে হবে।
কোচিং সময়ে সম্ভব হলে একজন ঢাবিয়ান বড় ভাই/বোনের সান্নিধ্যে থাকা ভালো। সমস্যাগুলো যাতে শেয়ার করা যায়, বিভিন্ন দিকনির্দেশনা পাওয়া যায় তাদের কাছ থেকে, যেটা খুবই উপকারী।
শুধু পড়লেই হবে না। পড়লেই হবে না। সৃষ্টিকর্তাকেও স্মরণ করতে হবে। কপালে না থাকলে সারাদিন পড়লেও কাজ হবে না। পড়াশোনা চালানোর পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তাকে খুশি করতে হবে।
আমি এখানে আমার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করলাম। মনে রাখতে হবে, আমাকে পারতেই হবে। না বলার জন্য আমি বড় হইনি। যদি সময় নষ্ট না করে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর তবে জেনে রাখ তোমার মতো একজন মেধাবী ছাত্রের জন্য ঢাবি অপেক্ষায় আছে। তোমার স্বপ্ন পূরণ হোক।
লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ১৪তম ব্যাচ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়