০৭ আগস্ট ২০২০, ০৭:৫৩

নাইজেরিয়ানদের ভবনেই থাকতেন তুর্ণা, বুঁদ ছিলেন টাকার নেশায়

রাহাত আরা খানম তুর্ণা ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিন ও তার বিদেশি বন্ধু

রাহাত আরা খানম তুর্ণা ওরফে ফারজানা মহিউদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাক্তন তিনি। পড়েছেন তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগে, ২০১১-২০১২ সেশনে। এর আগে ঢাকার বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে এইচএসসি ও বিএএফ শাহীন কলেজ, চট্টগ্রাম থেকে এসএসসি পাস করেন। বাবা বিমান বাহিনীতে কাজ করার সুবাধে বেড়ে উঠেন চট্টগ্রামে। পরে তিনি অবসর গেলে সপরিবারে ঢাকায় চলে যান।

প্রতারণার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ায় সম্প্রতি নাইজেরিয়ানদের সঙ্গে তিনিও গ্রেফতার হয়েছেন। আছেন কাশিমপুর কারাগারে। শিগগিরই তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে বলে জানা গেছে। তথ্যমতে, ফেসবুকে প্রতারণার মাধ্যমে সারাদেশ থেকে ৫/৬ কোটি টাকা ঢুকেছে তুর্ণার অ্যাকাউন্টে। মূলত এর দায়েই ১১ নাইজেরিয়ানসহ গ্রেপ্তার হন ওই ছাত্রী। যদিও আইনশৃঙ্ক্ষলা বাহিনীর সদস্যারা বলছেন, ১১ নয়, তূর্ণার যোগসাজস অন্তত ২ শতাধিক নাইজেরিয়ান সদস্যের সঙ্গে। থাকতেন নাইজেরিয়ান থাকা একটি ভবনে। আলাদা ফ্ল্যাটে। সবমিলিয়ে টাকা-আড্ডায় নেশার বুঁদ হয়ে অনেকটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল ঢাবির এই ছাত্রী।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর ২০১৮ সালে অন্ধকার জগতে পা রাখে তূর্ণা। ওই বছর নিউ মার্কেট এলাকায় নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের সঙ্গে পরিচয়। ডেনিস ও জুসেফের সঙ্গে সহজেই সম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। ডেনিসের হাত ধরেই প্রতারক চক্রের সঙ্গে মিশে যায় সে। ওই চক্র প্রতিদিন আট থেকে ১০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিত বিভিন্নজনের কাছ থেকে।

গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, তুর্ণাদের নেটওয়ার্ক শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতের রাজস্থান, কলকাতা, কুয়েত, আমেরিকা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে ছিল। বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা এই চক্রের প্রতারণার শিকার। সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার শামসুন নাহার একটি গণমাধ্যমকে জানান, তারা ঘনঘন ফোন পরিবর্তন করত। প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সচেতন ছিল। তাই দীর্ঘদিন তাদের কেউ গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সিআইডি তাদের গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতারকদের ব্যবহৃত ব্যাংকের ৩৫টি একাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে এই চক্রের এজেন্ট রয়েছে।

খোঁজে জানা গেছে, তুর্ণার সঙ্গে থাকা প্রতারক চক্রের নাইজেরিয়ান সদস্যরা মিরপুর-১০ বেনারশি পল্লীর ৩৯/ডি২ বাড়ির ১০ তলায় থাকত। যে ভবনের দ্বিতীয় তলা ব্যবহার হত অফিস হিসেবে। এখানেই চারতলায় থাকত তুর্ণা। ফ্ল্যাটে একাই থাকত সে। বাসাটি মূলত নাইজেরিয়ান নাগরিক ডেনিসের নামে ভাড়া নেয়া হয়। ওই ভবন ছাড়াও মিরপুর ১১-এর সি ব্লকের পাঁচ নম্বর এভিনিউয়ে তাদের আরেকটি আড্ডাস্থল ছিল। প্রতারণা চলত সেখানেও। রাত হলেই তুর্ণার বাসায় জমতো আড্ডা। নাইজেরিয়ান ও দেশি বন্ধুদের মিলনমেলায় পরিণত হত তার বাসা। 

তুর্ণার এক সহপাঠী জানান, বিশ্ববিদ্যালয় থাকাকালীন সময়ে তার সাথে ক্যাম্পাসে প্রায় আড্ডা দিতাম। এর মাঝে সে নাইজেরিয়াও গেছে; যদিও এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে ‘ওপেন শেয়ারিং’ নেই। তার বক্তব্য, তুর্ণা সবসময় ফেসবুকে সরব থাকত। উদ্ধ্যত্বপূর্ণ পোশাকেও ছবি শেয়ার করত। সব মিলিয়ে সন্দেহ করলেও এতটা প্রতাণা করবে, সেটা ভাবিনি। সত্যি বলতে সে লিমিট ক্রস করেছে।

একটি গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, তুর্ণাদের ওই আড্ডায় তানিম নামের এক যুবক ব্যবসায়ী অংশ নিত। তুর্ণার বয়ফ্রেন্ড হিসেবে পরিচিত রাজশাহীর ওই যুবককে রাত-বিরাতে ওই বাসায় আসা-যাওয়া করতে দেখেছেন প্রতিবেশীরা। তানিম ছাড়াও সুফি ফারুক নামে আরেক যুবকের সঙ্গে তার রয়েছে ঘনিষ্ঠতা। প্রত্যক্ষদর্শী ও তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এরকম অনেক যুবকের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই তুর্ণার উদ্দেশ্য থাকত টাকা। বিত্তশালী বন্ধুদের খোলামেলা ছবি পাঠিয়ে আকৃষ্ট করতো তুর্ণা। সেই সঙ্গে আবেগপ্রবণ কথা বলার এক পর্যায়ে টাকা খুঁজত। প্রায়ই বাসার আসবাবপত্র কেনার জন্য ঘনিষ্ঠদের কাছে টাকা চাইত। বিভিন্ন উৎসবে গিফট চাইত। একই প্রয়োজনের কথা বলে অনেকের কাছে টাকা খুঁজত।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বেশ পরিচিত মুখ ছিল তুর্ণা। সফল নারী উদ্যোক্তা হিসেবে টকশোতেও বেশ কয়েকবার অংশ নিয়েছেন। সখ্যতা ছিল সব মহলে। ছাত্রনেতা ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ এবং অনেক সাংসদও ছিল তার এই সখ্যতার তালিকায়। নিজের ফেসবুকে সদ্য সাবেক ছাত্রলীগের দুই সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন ও গোলাম রাব্বানীর সঙ্গে ছবিও শেয়ার করেছেন তিনি। এর বাইরেও ক্ষমতাসীন অনেক নেতার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে নিজের শিকড় গভীরতর করেছিলেন এই নারী। তথ্যমতে, সাবেক এক এমপির ছেলের সঙ্গেও বেশ খাতির রয়েছে এই তুর্নার।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিনের পুরনো ফেসবুক আইডি হ্যাক করত তুর্ণা চক্রটি। চক্রের সদস্যরা অন্তত দুই শতাধিক আইডি হ্যাক করেছে। এর মধ্যে আহসান উল্লাহ, মো. শামসুল হক, মো. বাবু, মো. রবিউল, মো. শরাফত উদ্দিন, মো. শামীম হোসেনসহ বিভিন্ন নামের আইডি রয়েছে। আইডি হ্যাক করে নাম ও ছবি পরিবর্তন করা হয়। সেইসঙ্গে পোস্টগুলো এডিট করে ভিন্ন লেখা দেয়া হয়। পুরাতন আইডি ও বিপুল মিউচুয়াল ফ্রেন্ড থাকার কারণে টার্গেটকৃতের বিশ্বাস অর্জন সহজ হয়।

জানা যায়, আস্থা অর্জনের জন্য ‍তুর্ণারা নগদ টাকা লেনদেন না করে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করত। সর্বশেষ তুর্ণার দেয়া অ্যাকাউন্টে ভুক্তভোগী একজন তিন লাখ ৭৩ হাজার টাকা জমা দেন এবং তারপর থেকেই তুর্ণাসহ চক্রের সদস্যরা তার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এরপর ভুক্তভোগী বুঝতে পারেন যে তিনি প্রতারিত হয়েছেন এবং তখন তিনি থানায় অভিযোগ জানান। যার ভিত্তিতেই তূর্ণাকে গ্রেপ্তার করা হয়।