বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পুরনো সেশনজট ফেরার শঙ্কা
গত এক দশকে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট যে অনেকাংশে কমে এসেছিল, করোনায় আবারও তা ফিরে আসার আশঙ্কা জেগেছে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলার মধ্যেই করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে যায়। তাই ক্যাম্পাস খোলার পরই এসব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। এরপর পরবর্তী সেমিস্টারের শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হবে। ফলে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার ওপর নির্ভর করছে সেশনজটের ভয়াবহ চিত্র। তবে করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় পুরনো সেশনজটের ফিরে আসার বার্তা দিচ্ছেন শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সেশন জট নিরসনে দুটি কৌশল নেয়ার কথা বলছিল বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। একটি চলতি সেমিস্টারের পরীক্ষা ব্যাচ ধরে নিয়ে পরের সেমিস্টারে তুলে রাখা। আরেকটি অনলাইনে পরের সেমিস্টারের শ্রেণি-কার্যক্রম অব্যাহত রাখা।
কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অনলাইন ক্লাসে অনীহা ছিল। তবুও ইউজিসির চাপাচাপিতে চলতি মাস থেকে তারা অনলাইন ক্লাস শুরু করে। তবে দুই সপ্তাহ পেরিয়ে গেলেও গুটিকয়েক বিশ্ববিদ্যালয়ই অনলাইন ক্লাস শুরু করতে পেরেছে। স্বায়ত্তশাসিত ও ঐতিহ্যবাহী ঢাকা, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো বড় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এ ক্ষেত্রে অন্যদের পথ দেখাতে পারেনি।
অন্যদিকে গ্রামে ইন্টারনেটের গতি কম, খরচ বেশি ও ডিভাইসের অভাবসহ সংগত কারণে অনেক শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারছেন না। ফলে সেশন জটে নিরসনে এই অনলাইন ক্লাস কতোটুকু সহায়ক হবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ দেশের সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আগামী ৬ আগস্ট পর্যন্ত এই বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তবে বর্তমানে করোনার যে পরিস্থিতি তাতে ৬ আগস্টের পরও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খোলার সম্ভাবনা নেই বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
উচ্চশিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই পৌনে ৫ মাসের ছুটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯ মাস থেকে এক বছরের সেশনজট তৈরি হতে পারে। এই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ক্লাস নিতে পারেনি। ছয় মাসের সেমিস্টার হওয়ায় পাঠ্যক্রম শেষ করা তো দূরের কথা, অর্ধেকও এগোয়নি। ফলে পরীক্ষা গ্রহণ কোন প্রক্রিয়ায় হবে সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে বিশ্ববিদ্যালয় এক-দুই মাস বন্ধ রাখা এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে সেশনজট মোকাবেলার অভিজ্ঞতা আছে। এমন ক্ষেত্রে সাপ্তাহিক ছুটি কমিয়ে ও অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার চর্চা আছে। এমন ঘটনায় সেশনজট নিরসন হয়ে যায়। কিন্তু বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সেশনজট অনিবার্য হয়ে গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, কয়েকজন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৬ আগস্টের পর যদি আর ছুটি নাও বাড়ে তবু ৯ মাস থেকে ১ বছরের সেশনজট হবে। আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রলম্বিত হবে বিদ্যমান সেমিস্টার। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অক্টোবর-নভেম্বরে নতুন সেমিস্টার শুরু করা যাবে।
তবে বিকল্প প্রস্তাব আছে। সেমিস্টার বা সেশনে নির্ধারিত সিলেবাস শেষ না হলে যতটা পড়ানো হয় তার ওপর পরীক্ষা নেয়ার দৃষ্টান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। সেই হিসাবে মার্চ পর্যন্ত কোর্সের যা পড়ানো হয়েছে তার ওপর পরীক্ষা নেয়া যায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র আবিদুল ইসলাম আবিদ। গত মে মাসে তাঁর স্নাতক (সম্মান) চূড়ান্ত পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু করোনার কারণে তাঁর শেষ পর্যায়ের ক্লাসই শেষ হয়নি, পরীক্ষা তো দূরের কথা। আবিদ এখন যশোরে গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, ‘জুনেই পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এরপর নানা পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু সব কিছুতেই এখন অনিশ্চয়তা। অনলাইন ক্লাস শুরু হলেও গ্রামে নেটওয়ার্ক জটিলতার কারণে অংশ নিতে পারিনি।’
এর আগে চার থেকে ছয় মাসের সেশনজটে পড়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘আমরা চার থেকে ছয় মাসের সেশনজটের কবলে পড়তে পারি। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার পর সাপ্তাহিক ছুটির দিনসহ অন্যান্য সময় অতিরিক্ত ক্লাস নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশনজটের আশঙ্কা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়টির উপ-উপাচার্য (প্রসাশন) অধ্যাপক মো. আমির হোসেন বলেন, ‘ভিসিবিরোধী আন্দোলনের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনই সেশনজট রয়েছে। করোনার কারণে তা আরও ব্যাপক হবে। তবে উত্তরণের পথ খুজছি।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান বলেন, ‘শুরুতে আমরা অনলাইন ক্লাসের পক্ষে ছিলাম না। কিন্তু কত দিন আর বসে থাকা যায়। আমরা মাত্রই শুরু করেছি। শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অনেক ভালো। ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য, নেটওয়ার্কের সমস্যাগুলো আশা করছি সরকার শিগগিরই সমাধান করবে। তাহলে এই অনলাইন ক্লাস আরো গতি পাবে।’
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে পরীক্ষা ও ক্লাস কার্যক্রম চলমান কিন্তু আমাদের মতো টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটিতে অনলাইনে শিক্ষা ও পরীক্ষা কার্যক্রম চালানো একটু মুশকিল, কারণ আমাদের শিক্ষা-কার্যক্রম অনেকটা মাঠ ও ল্যাব নির্ভর। তাই অনলাইনে শিক্ষা ও পরীক্ষা কার্যক্রম চালালে আমাদের ভালো বেগ পেতে হবে।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক বদরুজ্জামান বলেন, ‘করোনায় অনার্স ফাইনাল, মাস্টার্স ফাইনাল, ডিগ্রি দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষ এবং মাস্টার্স প্রিলিমিনারি পরীক্ষা আটকে গেছে। কলেজগুলো যাতে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে সে জন্য একটা উপায় খুঁজে বের করার চেষ্টা করছি আমরা।’
এদিকে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সবাই মূলত অনিয়মিত। তাঁদের পড়ালেখায় মানের বালাই নেই। করোনায় সেখানেও পড়ালেখা বন্ধ। আরবি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত মাদরাসায়ও পড়ালেখা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে।
ইউজিসির সদস্য প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন ক্লাসের প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে। তাদের অনেকেই এখন ট্রায়াল করছে। এই ক্লাস নিয়ে আমাদের প্রত্যাশার জায়গায় যেতে আরো সময় লাগবে। সব শিক্ষার্থী যাতে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে পারে এ জন্য বিনা মূল্যে ইন্টারনেট পেতে আমরা চেষ্টা করছি। শিক্ষার মানের ব্যাপারটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই নিশ্চিত করতে হবে।’