স্বপ্নে ভরা জীবন, চাকার তলায় চূর্ণ
থামছে না সড়কে মৃত্যুর মিছিল। প্রতিনিয়তই এই প্রক্রিয়ায় অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। কেউবা বরণ করছেন চিরতরে পঙ্গুত্ব। পুলিশ বিভাগ থেকে প্রাপ্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে প্রায় চার থেকে পাঁচ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। যদিও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের জরিপে তথ্য, বছরে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার লোক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছেন। ছাত্রদের আন্দোলনের প্রতি সম্মান দেখিয়ে কিছুদিন খানিকটা শুভবুদ্ধির উদয় হলেও ফের তা স্বরূপে ফিরে এসেছে। বিষয়টি নিয়ে শুধু সাধারণ জনগণই নয়, চিন্তায় পড়েছেন খোদ মন্ত্রী, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সচেতন মহলের অনেকেই।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার মধ্যেই আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। আবার প্রভাবশালীদের কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিরুপায় থাকার তথ্য রয়েছে। তাই সবার আগে আগে সড়কে প্রাণহানি ও দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ শনাক্ত করতে হবে। মহাসড়কে অবৈধ গাড়ি, অদক্ষ চালক, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালক, গতির প্রতিযোগিতা- সবগুলোর পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে শ্রমিক-মালিক সংগঠন, রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের এই খাতে বেপরোয়া সংশ্লিষ্টতা। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে কঠোর হলে দুর্ঘটনা অনেক কমে যাবে। সেই সঙ্গে পথচারী ও যাত্রীদেরও সড়ক যাতায়াতে সচেতন হতে হবে। যানবাহনে ওঠার আগে সেটি চলার উপযোগী কি-না দেখতে হবে। সড়ক পারাপারে আইন মেনে চলতে হবে। গতির প্রতিযোগিতায় চালককে নিবৃত্ত করতে হবে। তা না হলে শুধু সরকার ও কর্তৃপক্ষকে দোষ দিয়ে লাভ হবে না।
চলতি বছরে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য হিসাব-নিকাশে দেখা গেছে, শুধু বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেশ কয়েকজন ছাত্র এই তালিকায় রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে শিক্ষক, চাকরিজীবী কৃষক-শ্রমিকসহ অনেক পেশাজীবী মানুষ।
অনুসন্ধানে ও গণমাধ্যমে প্রকাশিতি তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরে শুরুর দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আ স ম জুলহাস জীমের দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার খবরটি প্রথমে গণমাধ্যমে আলোচিত হয়। জানা যায়, গত ২৪ জানুয়ারি সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ উপজেলার ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের ওভারব্রিজ এলাকায় কাভার্ডভ্যানের ধাক্কায় নিহত হন জুলহাস। ওই সময় তার বড় ভাই একেএম জাকারিয়া গুরুতর আহত হন। নিহত জুলহাস বগুড়া জেলার বৃন্দাবন পাড়ার তারাজুল ইসলামের ছেলে ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র।
বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম থানার ওসি সৈয়দ সহিদ আলম জানান, ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে বগুড়ায় যাচ্ছিলেন জুলহাস ও তার বড় ভাই জাকারিয়া। বঙ্গবন্ধু সেতু পশ্চিম সংযোগ সড়কের ঝাঐল ওভারব্রিজ এলাকায় পৌঁছলে স্থানীয় বিড়ি কোম্পানির একটি কাভার্ডভ্যান তাদের চাপা দেয়। স্থানীয়রা তাদের উদ্ধার করে সিরাজগঞ্জ বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করার পর জুলহাসের মৃত্যু হয়।
সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে করুণ মৃত্যু হওয়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী নুসরাত চৌধুরী নিশাতের (২৩) ঘটনাটি। টানা ১২ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে মারা যান নুসরাত। নুসরাত চৌধুরী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি বিভাগের সম্মান (২০১২-১৩) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া গ্রামের মরহুম কবির হোসেন চৌধুরীর মেয়ে।
জানা গেছে, নুসরাত ২১ জানুয়ারি সকালে পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে ভাটিয়ারি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হন। তিনি মাথায় গুরুতর আঘাত পান। হাসপাতালে দীর্ঘসময় ছিলেন কোমায়। অস্ত্রোপচার শেষে প্রথমে নুসরাতকে নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে রাখা হয়। এরপর অবস্থার আরও অবনতি হলে দু’দিন আগে তাকে চমেক হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। অবশেষে মারা যান নুসরাত। মেধাবী এ শিক্ষার্থী দ্রুতসময়ে এবং সুচিকিৎসা পায়নি বলে অভিযোগ তার সহপাঠীদের। তার মৃত্যুতে ক্যাম্পাসে নেমে আসে শোকের ছায়া।
রাজধানীর আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি-বাংলাদেশের (এআইইউবি) তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার হামদুর রহমানের ছেলে কাজী মশিউর রহমান (২৪) মারা যান ৯ ফেব্রুয়ারি। নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপপরিদর্শক শাহ আলম জানান, বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসা মশিউর বাড়ি ফেরার জন্য নরসিংদী স্টেশন থেকে ঢাকামুখী উপকূল ট্রেনে চড়েন। ভিড়ের কারণে তিনি দরজায় দাঁড়ানো ছিলেন। এক পর্যায়ে তার ব্যাগ পড়ে যেতে গেলে তিনি তা ধরতে যান। কিন্তু ট্রেন থেকে পড়ে গিয়ে কাটা পড়ে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছে বলে জানান শাহ আলম।
২৫ ফেব্রুয়ারি বেপরোয়া চালকের গাড়িতে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে সড়ক দুর্ঘটনায় ফরিদুল ইসলাম (২৫) নামে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক ছাত্র মারা যান। তিনি আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের পঞ্চম সেমিস্টারের ছাত্র। হাইওয়ে পুলিশ জানায়, ফরিদ ফজরের নামাজ শেষ করে বায়তুল আমান জামে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় ঢাকামুখী একটি ট্রাকের চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি মসজিদে ঢুকে পড়ে। এ সময় ঘটনাস্থলেই ফরিদের মৃতু্য হয়।
রাজধানীতে আবরারের আগের সড়ক দুর্ঘটনাটি হয় শাকিল আহমেদ তুর্য নামে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বেলায়। ৫ মার্চ রাত দুইটার দিকে প্রগতি সরণি এলাকায় তুর্যের ড্রাইভ করার প্রাইভেটকারটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সাথে ধাক্কা লাগলে গুরুতর আহত হয় সে। পরে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে যায়; সেখানেই নিহত হয় ওই ছাত্র। এ ঘটনায় ফারদিন খান নামে গাড়ির অন্য এক যাত্রী গুরুতর আহত হয়েছেন।
গুলশান থানার এসআই আল হেলাল জানান, শাকিল আহমেদ তুর্যের বড় ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে জরুরি প্রয়োজনে মামাতো ভাইকে নিয়ে বসুন্ধরা যাচ্ছিলেন। এসময় প্রগতি সরণিতে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি একটি বিদ্যুৎ খুঁটিকে সজোরে ধাক্কা মারে। এতে বিদ্যুৎ খুঁটিটি গোড়া উপড়ে প্রায় কয়েক গজ দূরে সড়ে যায়। প্রাইভেটকারটির দুমড়ে-মুচড়ে ফুটপাত অতিক্রম করে একটি দোকানের শাটার ভেঙে ফেলে। পুলিশ জানায়, দুর্ঘটনার পর পথচারীরা এসে গাড়ি থেকে আহত দুজনকে উদ্ধার করে অ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ভোরে মারা যান তুর্য।
এর আগে রাজধানীজুড়ে চলা নিরাপদ সড়ক আন্দোলন
সবশেষ করুণ ঘটনাটি ঘটে গতকাল মঙ্গলবার সকালে। রাজধানীর কুড়িলের যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাসে ওঠার সময় পেছন থেকে সুপ্রভাত পরিবহনের একটি বাস বিইউপি শিক্ষার্থী আবরার আহমেদ চৌধুরীকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তিনি নিহত হন। এ দুর্ঘটনার পর থেকেই নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, তারা আট দফা দাবিতে বিক্ষোভ করছেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে,চালকের সর্বোচ্চ শাস্তি। শিক্ষার্থী মায়েশা নূর বলছেন, ‘আমরা সর্বোচ্চ শাস্তি বলতে বাসচালকের ফাঁসি চেয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘গতবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে জাবালে নূরের রোড পারমিট বাতিল করা হয়েছিল বলে আমাদের জানানো হয়েছিল। কিন্তু জাবালে নূর এখনও রাস্তায় চলছে। আমরা জাবালে নূর ও সুপ্রভাত বাস রাস্তায় দেখতে চাই না।"