ঢাবিতে ৫০ বছরের পুরনো নীতিমালায় পাঠদান!
৫০ বছরের পুরনো নীতিমালা দিয়ে চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি। পরিবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ‘টিচিং লোড’ বিধি হালনাগাদ না করায় একদিকে যেমন ক্লাস বন্টন নিয়ে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, তেমনি বেশি ক্লাস নেয়ার চাপ থাকায় ব্যক্তিগত ‘শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম’ চালাতে পারছেন অনেক শিক্ষক। যা নিয়ে প্রায়ই বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হচ্ছে অনুষদের ডীন ও বিভাগীয় চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হালনাগাদ ‘টিচিং লোড’ নীতিমালা না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছুসংখ্যক শিক্ষকের উপর অপেক্ষাকৃত বেশি ক্লাস নেয়ার কারণে চাপ পড়ে। এতে ওই শিক্ষকের শিক্ষা ও গবেষণা কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এ অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সুনির্দিষ্ট টিচিং লোড নীতিমালা প্রণয়ণ বা হালনাগাদ সময়ের দাবি। বিভাগের চেয়ারম্যান ও শিক্ষকদের ভাষ্য, একই পদমর্যাদার শিক্ষকরা সপ্তাহে সমান সংখ্যক ক্লাস নেন না। শুধু তাই নয়, শিক্ষকভেদে সপ্তাহে নেওয়া ক্লাস সংখ্যার ব্যবধান অনেক সময় আকাশ-পাতাল। আবার বিভিন্ন বিভাগের প্রবীণ শিক্ষকরা অনেক সময় কোর্স ছাড়তে চান না। এমনও হয়- সংশিষ্ট কোর্সে ক্লাস নেন নবীন প্রভাষক; কিন্তু কোর্স রয়ে যায় আগের শিক্ষকের নামেই। এসব বিবেচনায় বর্তমান ব্যবস্থার সাথে উপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের পক্ষে মত দিয়েছেন একাধিক বিভাগের চেয়ারম্যান।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর ও সিনিয়র শিক্ষক সূত্রে জানা যায়, ১৯৭৩ সালের সংবিধি দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ওই অধ্যাদেশে টিচিং লোড বা ক্লাস বন্টন বিষয়ে কোনো বিধি অন্তভূক্ত করা হয়নি। ফলে ১৯৬৯ সালে প্রণীত একটি নীতিমালা দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠদান চলছে। যদিও তা বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ নীতিমালা কার্যকর নয়। বিভিন্ন বিভাগ ঐতিহ্য অনুযায়ী কিংবা নিজস্ব বিবেচনায় এটি নির্ধারন করে কাজ পরিচালনা করছে। কিন্তু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় বিভাগগুলোতে সুষমভাবে ক্লাস বন্টন হয় না। প্রচলিত নিয়মেই অনেক শিক্ষককে অপেক্ষাকৃত বেশি ক্লাস নিতে হয়। আবার অনেকে নির্ধারিত ক্লাসও নেন না। এ ক্ষেত্রে এক ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। ক্লাস বন্টনের সময় বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যানদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হচ্ছে।
খোঁজে জানা যায়, সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরির জন্য বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিভিন্ন বিভাগের চেয়ারম্যান। ২০১১ সালে ক্লাস বন্টনে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরীর বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আজিজুর রহমান সংশ্লিষ্ট অনুষদের ডীনের কাছে একটি চিঠি দেন। কিন্তু একাডেমিক কাউন্সিল কিংবা সংশ্লিষ্ট কোনো সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়নি।
সূত্রের তথ্য, ১৯৭৩ সালের সংবিধি দ্বারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ওই বিধিতে টিচিং লোড বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই। তাই এ বিষয়ে ১৯৬৯ সালে প্রণীত নীতিমালা দ্বারা পাঠদান ও ক্লাসবন্টন কার্যক্রম চলছে। এ নীতিটি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্যমান কলা, আইন ও বিজ্ঞান অনুষদের জন্য তৈরী করা হয়। কিন্তু বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ রয়েছে। বিভাগের সংখ্যা বেড়েছে কয়েকগুণ। শিক্ষাদান পদ্ধতিতে এসেছে ভিন্নতা।
তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ বিষয়ে হালনাগাদ নীতিমালা ও শিক্ষক মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. আবুল কালাম সরকারসহ বেশকয়েকজন শিক্ষক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের একাডেমিক কাউন্সিলের বৈঠকে শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী ক্লাস বন্টন করে থাকি। বিভিন্ন বিভাগে এমনও শিক্ষক আছেন যেখানে তারা একটা বিষয়ে অনেক বছর যাবত একই ধরণের লেকচার দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে যদি কয়েকবছর পর পর এগুলো পরিবর্তন করা হয় তাহলে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি হবে। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে ক্লাস বন্টনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা থাকা উচিত। পাশাপাশি ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে শিক্ষকদের মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকা দরকার বলেও মনে করছি।’
১৯৬৯ সালের ১৫ জুলাই সিন্ডিকেটের সভায় পাস হওয়া টিচিংলোড নীতিমালা পর্যালোচনায় জানা যায়, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ক্যাটাগরী তিনটি ভাগে বিভক্ত ছিল। নীতিমালায় প্রতি সপ্তাহে একজন অধ্যাপকের জন্য ১০টি, রিডারের জন্য ১৪টি ও প্রভাষকের জন্য ১৬টি ক্লাস নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া বিভাগে প্রতি ১০ জন শিক্ষকের মধ্যে একজন অধ্যাপক, তিন জন রিডার, চার জন সিনিয়র প্রভাষক ও দুই জন প্রভাষক রাখার আনুপাতিক হার নির্ধারণ করা হয়। এ অনুযায়ী বিভাগে সৃষ্ট নতুন পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে পরামর্শ দেয়া হয়। এরপর শিক্ষাদান পদ্ধতিতে পরিবর্তন ছাড়াও শিক্ষকদের আগের ক্যাটাগরীর পরিবর্তে অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক, প্রভাষক ক্যাটাগরী নির্ধারণ করা হয়। এ কারনে ৬৯’র নীতিমালা দিয়েও ক্লাসবন্টন কার্যক্রম পরিচালনা করা জটিল হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী বলেন, ‘হলনাগাদ না থাকলেও শিক্ষকদের ক্লাস বন্টনে একটি নীতিমালা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য আছে। ঐতিহ্য অনুযায়ী ক্লাস বন্টন করা হয়। সিনিয়র শিক্ষকদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী নিচের দিকের ক্লাসগুলো দেয়া হয়। এক্ষেত্রে ১ম ও ২য় বর্ষের শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞ অধ্যাপকদের কাছ থেকে জ্ঞান লাভের সুযোগ পান।’
তবে ক্লাস সাইজ ও বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষক সংখ্যার অনুপাত নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, ‘কিছু বিভাগে ব্যাচ প্রতি ৩০/৪০ জন শিক্ষার্থী; অথচ সেখানে শিক্ষক সংখ্যা অনেক বেশি। আবার কিছু বিভাগে ব্যাচপ্রতি শিক্ষার্থী ২ শতাধিক। যদিও সেখানে সেকশন হয়। কিন্তু তারপরও সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের উপর বেশি চাপ পড়ে।’ এসব নিয়ে ভাবা প্রয়োজন বলে মনে করেন অধ্যাপক রব্বানী।