কিডনি রোগের কারণ, লক্ষণ ও প্রতিকার
শারীরিক বিপাকে উৎপন্ন অতিরিক্ত বর্জ্য বের করে দেহকে সুস্থ রাখার অতন্দ্র প্রহরী হল কিডনি। মানুষের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি ছাঁকনি হিসেবেও কাজ করে। তবে কোন কারণে এ অঙ্গের সমস্যা দেখা দিলে শরীরে বিভিন্ন ধরণের জটিলতার সৃষ্টি হয়।
কিডনি বিকলের লক্ষণগুলো খুবই সূক্ষ্ম হওয়ায় প্রাথমিকভাবে তা বুঝা যায় না। তাই একে নীরব ঘাতক বলে অভিহিত করা হয়।
কিডনি রোগ বিভিন্ন কারণে হতে পারে। মূলত কিডনি বিকলের দুটি কারণ পরিলক্ষিত হয়- স্বল্পমেয়াদী কিডনি রোগ এবং ক্রনিক বা দীর্ঘ মেয়াদী কিডনি রোগ।
আরও পড়ুন : অভিজ্ঞতা ছাড়াই ট্রাস্ট ব্যাংকে চাকরি
স্বল্পমেয়াদী কিডনি রোগে হঠাৎ কিডনিতে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বিশেষ করে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, কলেরা, ডাইরিয়া বা পানিশূন্যতা, টাইফয়েড, ডেঙ্গুজ্বর, অতিরিক্ত ব্যথানাশক ও এন্টিবায়োটিক সেবনের ফলে কিডনি বিকল হয়ে থাকে। এমন সমস্যা দেখা দিলে দ্রুত সময়ের মধ্যে যথাযথ চিকিৎসা নিলে কিডনি আবার ভালো অবস্থানে ফিরে আসে। কিন্তু অবহেলা করলে কিডনি স্থায়ীভাবে বিকল হতে পারে।
অন্যদিকে ক্রনিক কিডনি রোগ একটি দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগ। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস বা কিডনির প্রদাহ হল এই রোগের অন্যতম কারণ। বংশগত বা জন্মগত অসুখ, যেমন পলিসিস্টিক কিডনি ডিজিজ থাকলেও দীর্ঘমেয়াদি কিডনির অসুখ হতে পারে। আবার মাতৃগর্ভে কিডনির গঠনগত অস্বাভাবিকতার জন্যও হতে পারে।
আরও পড়ুন : মাদ্রাসা অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ
এই রোগের মূল সমস্যা হল- কোন রকম লক্ষণ প্রকাশ ছাড়াই ধীরে ধীরে কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা নষ্ট হয় এবং রোগের শেষ পর্যায়ে অসুস্থতা প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় আক্রান্ত হলে কিডনি পুরোপুরি নিরাময় সম্ভব হয় না। তবে রোগের জটিলতা থেকে রোগীকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করা হয়। পরিপূর্ণ কিডনি বিকল হলে ডায়ালাইসিস, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হয়।
লক্ষণ
কিডনি রোগ খুব নীরবে শরীরের ক্ষতি করে। সাধারণত খুব জটিল অবস্থা না হওয়া পর্যন্ত লক্ষণগুলো ভালোভাবে প্রকাশও পায় না। তাই কিডনি রোগের প্রাথমিক লক্ষণগুলো আগে থেকেই জেনে রাখা জরুরি। স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইট হেলথ ডাইজেস্ট এবং দ্যা টাইমস অফ ইন্ডিয়া-এর প্রতিবেদনে কিডনি রোগের কিছু লক্ষণ তুলে ধরা হয়েছে। লক্ষণগুলো হল-
প্রস্রাবে পরিবর্তন
প্রস্রাবের অস্বাভাবিকতা কিডনি রোগের লক্ষণ হতে পারে। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ দিনে ৬ থেকে ১০ বার প্রস্রাব করে। এর চেয়ে বেশি কিডনির ক্ষতির ইঙ্গিত হতে পারে। দীর্ঘদিন এর চেয়ে বেশি বা কম প্রস্রাবে হওয়া কিডনির সমস্যার লক্ষণ। কিডনি বিকল হলে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত বের হয়ে থাকে।
শুষ্ক ত্বক ও চুলকানির সমস্যা
কিডনি রোগের অন্যতম একটি লক্ষণ ত্বকে শুষ্কভাব ও চুলকানি হওয়া। কিডনি প্রস্রাবের মাধ্যমে শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয়। যখন কিডনি ঠিকমতো কাজ করে না, তখন রক্তে টক্সিন জমা হয়ে শরীরে চুলকানি, শুষ্কতা এবং দুর্গন্ধ সৃষ্টি হয়।
শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ফুলে যাওয়া
কিডনির স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলে শরীরে টক্সিন ও সোডিয়াম জমা হতে থাকে। ফলে পায়ে অতিরিক্ত পানি জমা, গোড়ালি ফোলা দেখা যায়। এমনকি চোখ ও মুখের ফোলাভাব দেখা যেতে পারে।
ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভব
কিডনির গুরুতর সংক্রমণের ফলে দেহে অতিরিক্ত টক্সিন জমা হয়ে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হয়। ফলে হাঁটাহাঁটি কিংবা ঘরের কাজ করাও কষ্টকর হয়ে যায়।
খাওয়ার অরুচি
কিডনি বিকল হতে শুরু করলে খাওয়ার অরুচি দেখা দেয়। শরীরে বিষাক্ত পদার্থ এবং বর্জ্য জমা হওয়ার ফলে ক্ষুধা কমে যেতে থাকে। এমনকি সব সময় পেট ভরা ভাব থাকায় খাওয়ার প্রতি তেমন আগ্রহ থাকে না। খাবার খেতে গিয়ে বমি বমি ভাব দেখা দেয়।
নিঃশ্বাস ছোট হওয়া
কিডনি রোগে শরীরে রক্তশূন্যতাও দেখা দেয়। আবার ফুসফুসে তরল পদার্থ জমা হতে থাকে। ফলে নিঃশ্বাস ছোট হয়ে আসে। অনেক সময় শ্বাস নিতে কষ্ট হয়।
কোমরের পেছনে ব্যথা
কিডনি রোগের অন্যতম একটি লক্ষণ কোমরের পিছনে ব্যথা। বিশেষ করে পিঠের পাশে নিচের দিকে ব্যথা হয়। তাছাড়া কিডনি রোগে শরীরে ব্যথাও হতে পারে।
জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফজল নাসের জানান, একদম শুরুর দিকে কিডনি রোগের তেমন কোন লক্ষণ থাকে না। মূলত প্রাথমিক পর্যায় পার হলেই কেবল লক্ষণগুলো চোখে পড়ে। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলেই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুন : জানা গেল ওই দুই শিশু হত্যার আসল কারণ
বর্তমান সময়ে দেশে কিডনি রোগ সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জাতীয় কিডনি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর দেশে নতুন করে কিডনি রোগী বাড়ছে দুই লাখ। সব মিলিয়ে দেশে এখন প্রায় দুই কোটির উপরে রোগী রয়েছেন। প্রতি বছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি রোগে মারা যায়।
প্রতিকার
কিডনি রোগ থেকে বাঁচতে গণসচেতনতা প্রয়োজন। কেননা একটু সচেতনতা সুস্থ রাখতে পারে দেহের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গকে। তাই কিডনি সুস্থ রাখতে খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপনে পরিবর্তন জরুরি। কিডনি অকেজো হওয়ার কারণ হিসেবে নেফ্রাইটিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। তাই ওজন, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা। অলস জীবনযাপন পরিহার করে নিয়মিত ব্যায়াম করা।
তেল চর্বি জাতীয় খাবার পরিহার করা। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা। ধূমপান পরিহার করা। অতিরিক্ত ব্যথানাশক সেবন থেকে বিরত থাকা এবং ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া এন্টিবায়োটিক সেবন না করা। দিনে পরিমিত পরিমাণ পানি পান করা ও পরিচ্ছন্ন থাকা। প্রস্রাবের চাপ আটকে না রাখা। এছাড়া বছরে অন্তত দু’বার রক্তের ক্রিয়েটিনিন পরীক্ষা করা। সুতরাং আপনার সচেতনতা বাঁচাতে পারে আপনার দেহের অমূল্য সম্পদ কিনডি।