১০ জুলাই ২০২১, ১২:৪৬

করোনাকালে ভয়াবহ মানসিক চাপে শিক্ষার্থীরা

  © প্রতীকী ছবি

দেশে করোনার প্রাদুর্ভাবে সব ধরণের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১৬ মাস বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ এ ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৩১ জুলাই পর্যন্ত করা হয়েছে। করোনার দীর্ঘ এই সময়ে ভয়াবহ রূপ নিয়েছে তরুণ-তরুণীদের মানসিক বিপর্যয়। এই সময়ে তারা মূলত ১০ কারণে মানসিক চাপজনিত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।

আর তা হলো- ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা, পড়াশোনা ও কাজে মনোযোগ হারানো, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, একাকী হয়ে যাওয়া, অনাগ্রহ থাকা সত্ত্বেও পরিবার থেকে বিয়ের চাপ, আর্থিক সমস্যা, সেশনজট, অনশ্চিত ভবিষ্যত, মোবাইলের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি ইত্যাদি।

আজ শনিবার (১০ জুলাই) দুপুরে এক ওয়েবনিয়ারে করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয় শীর্ষক এক জরিপের ফলে এসব তথ্য জানানো হয়। ‘করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের মানসিক বিপর্যয়; আত্মহননের পথে তরুণ সমাজ’ শীর্ষক এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান আঁচল ফাউন্ডেশন।

জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ক্যারিয়ার নিয়ে হতাশা-সেশনজটসহ এসব কারণে মানসিক অস্থিরতায় ভুগে ৭০.৮ শতাংশ তরুণ-তরুণী শারীরিকভাবে কিংবা অন্যান্যভাবে নিজেদের ক্ষতি করেননি ঠিকই  তবে ২৯.২ শতাংশ তরুণ-তরুণীই শারীরিক বা অন্যান্য নানান উপায়ে নিজেদের ক্ষতি করেছেন। গবেষকরা বলেছেন শারীরিক ক্ষতি করা আত্মহত্যা করার প্রাথমিক ধাপ।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ, মানসিকস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও প্লে থেরাপিস্ট মোশতাক আহমেদ ইমরান এবং আঁচল ফাউন্ডেশনের কর্মীবৃন্দ।

সংগঠনের তথ্য মতে, গত মার্চে আঁচল ফাউন্ডেশন কর্তৃক করোনাকালীন পরিস্থিতিতে আত্মহত্যার হার সংক্রান্ত একটি জরিপ পরিচালিত হয় যেখানে দেখা যায়, আত্মহননকারীদের মধ্যে প্রায় ৪৯% হচ্ছেন তরুণ তরুণী, যাদের বয়স ১৮-৩৫ এর মধ্যে। তরুণদের মাঝে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধির কারণ খুঁজতে এরই ধারাবাহিকতায় গত জুন এর ১-১৫ তারিখ  পর্যন্ত ‘আত্মহত্যা ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে তরুণদের ভাবনা’ শীর্ষক একটি জরিপ পরিচালনা করে আঁচল ফাউন্ডেশন।

আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, এই জরিপের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিলো তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা, আত্মহত্যার কারণগুলো চিহ্নিতকরণ ও তার সমাধানের উপায় খুঁজে বের করা এবং পরিশেষে সকলে যেনো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্যোগী হয় সে বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা।

জরিপে মোট ২ হাজার ২৬ জন ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। জরিপটিতে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় অংশ ছিলো ১৮-২৫ বছর বয়সী ১ হাজার ৭২০ জন তরুণ-তরুণী বা ৮৪.৯ শতাংশ জুড়ে।  জরিপে অংশগ্রহণ করেন ২৬- ৩০ বছর বয়সী মোট ২৪৩ জন যা জরিপের ১২ শতাংশ। এছাড়া ৩১-৩৫ বছর বয়সী ৬৩ জন ব্যক্তি  দখল করে ছিলো এ জরিপের ৩.১ শতাংশ। এদের মধ্যে নারীর সংখ্যা ছিলো ১ হাজার ২৯৩ জন বা ৬৩. ৮ শতাংশ ও পুরুষের সংখ্যা ছিলো ৭৩১ জন বা ৩৬.১ শতাংশ এবং তৃতীয় লিঙ্গের ছিলো ০.১০ শতাংশ।

জরিপে অংশ নেয়া ২ হাজার ২৬ জনের মধ্যে মাত্র ৭৮৭ জন (৩৮. ৮) শতাংশ বলেছেন তারা বিষন্নতায় ভোগেন নি। তবে ১ হাজার ২৩৯ জনই বলছেন তারা বিষন্নতায় ভুগছেন, যার হার ৬১.২ শতাংশ। এদের মধ্যে মাত্র ৫৫.৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী জানিয়েছেন তারা তাদের বিষন্নতা কাছের মানুষের কাছে শেয়ার করতে পারলেও ৪৪.৩ শতাংশ জানান তারা তাদের বিষন্নতা বা মানসিক অস্থিরতা শেয়ার করার জন্য কাউকেই পাশে পান না। 

আমরা সবাই কম বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো ব্যবহার করে থাকি। গবেষকরা বলছেন, প্রয়োজনের বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। জরিপ অনুসারে, মাত্র ১৪.৯ শতাংশ তরুণ তরুণী সর্বনিম্ন ২ ঘন্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যয় করেন। বাকী ৮৫.১ শতাংশ দুই ঘণ্টারও বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটান। এর মাঝে ২৭.৬ শতাংশ দৈনিক ৬ ঘন্টার বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অতিমাত্রায় ব্যবহার করেন। গবেষণায় দেখা যায় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার মানসিক বিপর্যস্ততা বাড়ায়।

মানসিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পরিমিত ঘুম হওয়া আবশ্যক, এ বিষয়টি জরিপে উঠে আসায় দেখা যায়, ৭৬.১ শতাংশ বলেছেন তাদের পরিমিত (৬-৮ ঘণ্টা) ঘুম হয় কিন্ত ২৩.৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীদেরই পরিমিত ঘুম হয় না যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ ।       

জরিপে দেখা যায় মোট ৬৩.৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী বলছেন করোনাকালীন সময়ে তাদের মানসিক চাপ আগে থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে; এদের মধ্য ৩৪.৯ শতাংশ বলছেন এই চাপ আগের থেকে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে আবার ২৮.৬ শতাংশ বলছেন এই চাপ করোনাকালীন সময়ে সামান্য বেশি এবং ১৮.১ শতাংশ জানিয়েছেন চাপ আগের মতোই রয়েছে। তবে বাকি ১৮.৪ শতাংশ বলছেন তাদের মানসিক চাপ আগের থেকে কমেছে। 

মানসিক বিভিন্ন চাপের ফলে অনেকের মাঝেই আত্মহত্যা করার চিন্তা বা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। জরিপের মাধ্যমে দেখা যায়, ৪৯.৯ শতাংশ তরুণ-তরুণীরা আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেন নি কিন্ত বাকি ৫০.১ শতাংশই আত্মহত্যা করার কথা চিন্তা করেছেন। এদের মধ্যে করোনাকালীন সময়েই আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন ২১.৩ শতাংশ। ৩৮.১ শতাংশ মানুষ আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছেন, তবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেননি। কিন্তু ৮.৩ শতাংশ এর মাথায় আত্মহত্যার কথা এসেছে, তারা আত্মহত্যার উপকরণ প্রস্তুত করেছেন কিন্ত শেষে পিছিয়ে এসেছেন এবং ৩.৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন তবে তারা বিফল হয়েছেন। 

সাধারণত মানসিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শ দ্বারা এই ধরণের মানসিক অসুস্থতা অনেকটাই সমাধান করা সম্ভব। জরিপের ৯৩.৪ শতাংশ এ ব্যাপারে জানলেও মাত্র ৮.৫ শতাংশ মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়েছেন কিন্ত বাকি ৯১.৫ শতাংশ তরুণ তরুণী কখনোই কোন বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হননি যা বেশ হতাশাজনক । 

জরিপের বিষয়ে আঁচল ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি তানসেন রোজ বলেন তরুণরাই আগামীর দেশ গড়ার কারিগর। তরুণরা যখন আত্মহত্যাপ্রবণ কিংবা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে তা নিশ্চিতভাবেই দেশের জন্য অশনী সংকেত। যারা মানসিকভাবে হতাশাগ্রস্ত শুধুমাত্র তাদেরকে কউন্সেলিং দেয়ার মাঝে সীমাবদ্ধ থাকলে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান হবে না। বরং একজন তরুণ বা তরুণী কেনো আত্মহত্যাপ্রবণ বা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে তার কারণ বের করে সমাধান করে সমস্যার মূলোৎপাটন করতে হবে।

সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়ার প্রতি জোর দিয়ে তিনি বলেন, এটার সমাধান কেবল এক পক্ষের হাতে নেই। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজও রাষ্ট্রকে যুগপৎভাবে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে। ব্যক্তির যেমন সচেতন হওয়া জরুরী, তেমনি পরিবারেরও বড় ধরনের ভূমিকা রয়েছে সন্তানকে মানসিক ট্রমার হাত থেকে বাঁচাতে। সমাজেরও দায়িত্ব হচ্ছে কেউ যেন নিগৃহীত, বৈষম্যের শিকার না হয় তার প্রতি লক্ষ্য রাখা। একই সাথে একজন তরুণ তরুণীর সব ধরনের প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করে তাকে পরিপূর্ণভাবে তৈরি করতে এগিয়ে আসতে হবে রাষ্ট্রকেও।

“আমাদের মনে রাখতে হবে, যে কোনো সমস্যা বিষাক্ত বৃক্ষের ন্যায়। শুধু ডালপালা কেটে এর হাত থেকে বাঁচা যাবে না। শিকড়সহ উপড়ে ফেলতে পারলেই কেবল সমস্যার সমাধান হবে।”

সাইকোলজিস্ট এবং প্লে থেরাপিস্ট মোস্তাক ইমরান বলেন, আমরা বুঝতে পারছি করোনায় তরুণ তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকি উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে থাকার ফলে শিক্ষার্থীদের ঘুম কম হচ্ছে, বিষণ্ণতা ও হতাশা বাড়ছে, আত্মহত্যার হারও বাড়ছে। এ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের ও তাদের পরিবারের মনোসামাজিক সহায়তা বা কাউন্সেলিং সেবা নিশ্চিত করতে হবে।

এক নজরে জরিপের খুঁটিনাটি

১) করোনাকালীন সময়ে ডিপ্রেশনে ভুগছেন ৬১.২ শতাংশ তরুণ-তরুণী;

২) আত্মহত্যা করার চেষ্টা করেছেন ৩.৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী;

৩) শারীরিকভাবে নিজে ক্ষতি করেছেন যা আত্মহত্যার প্রাথমিক লক্ষণ ২৯.২ শতাংশ তরুণ তরুণী;  

৪) অনাগ্রহ সত্ত্বেও পারিবারিকভাবে বিয়ের চাপ আসছে, যাদের মাঝে মেয়েদের সংখ্যাই বেশি ১০ শতাংশ শিক্ষার্থীর;

৫) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অধিকাংশ সময় ব্যয় করছে; এদের বেশির ভাগই শিক্ষার্থী ৮৫.১ শতাংশ তরুণ-তরুণী;

৬) করোনাকালীন সময়ে আগের চেয়ে তাদের মানসিক চাপ বেড়েছে বলেছেন ৬৩.৫ শতাংশ তরুণ-তরুণী;

৭) করোনাকালীন সময়েই আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছেন ২৩.৩ শতাংশ তরুণ-তরুণী।