যে কারণে ২৯ জেলা করোনা সংক্রমণের মারাত্মক ঝুঁকিতে

সংক্রমণ বাড়ার পেছনে মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা
সংক্রমণ বাড়ার পেছনে মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা  © বিবিসি

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে সম্প্রতি জানানো হয়েছে, দেশের ২৯ জেলা করোনাভাইরাসের উচ্চ সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এসব জেলার মধ্যে রয়েছে- ঢাকা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ফেনী, চাঁদপুর, নীলফামারী, সিলেট, টাঙ্গাইল, গাজীপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, মাদারীপুর, নওগাঁ, রাজশাহী প্রভৃতি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে রোগের মাত্রা, রোগীর সংখ্যা, সংক্রমণের হারের মতো তথ্যগুলো প্রতি সপ্তাহেই বিশ্লেষণ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, সে হিসেবে গত ১৩ মার্চ এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে ছয়টি জেলাকে সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকার তথ্য পাওয়া যায়। এর সপ্তাহ খানেক পরে অর্থাৎ ২০ মার্চ এই সংখ্যা বেড়ে ২০টিতে দাঁড়ায় এবং ২৪ তারিখের বিশ্লেষণের পর মোট ঝুঁকিপূর্ণ জেলা ২৯টি হয়।

তিনি বলেন, এর মানে হচ্ছে সংক্রমণ আসলে সারা দেশেই ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। সংস্থাটির তথ্য মতে, ২৪ ঘণ্টায় বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে নতুন করে শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজার ৪২ জন। আর একই সময়ে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ৪৫ জন। তবে দেশের যেসব জেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণের বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেগুলোতে কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি যেসব জেলা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে তাদের মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যটি প্রথমেই চোখে পড়ছে সেটি হচ্ছে সপ্তাহ দুয়েকের ব্যবধানে জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে গেছে। জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট-আইইডিসিআর এর প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ. এস. এম. আলমগীর বলেন, বাংলাদেশের যেসব জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি সেগুলোকেই মূলত উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জেলা হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

সাধারণত ওই জেলাগুলোর প্রশাসন যাতে সংক্রমণ কমিয়ে আনতে পদক্ষেপ নিতে পারে সে উদ্দেশ্যেই এই টালি করা হয়। তিনি বলেন, এসব জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংক্রমিত হয়েছে বড় জেলাগুলোয়। পরে ধীরে ধীরে সংক্রমণ ছোট জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে চার-পাঁচটা জেলা ছিল, এখন সেটা ২৯টা হয়ে গেছে। এটা অনবরত পরিবর্তনশীল একটা ব্যাপার।

এ বিষয়ে আইইডিসিআর এর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন বলেন, এই ২৯টি জেলা কেন ঝুঁকিপূর্ণ তা জানতে এর একটি রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা হয়েছে। যাতে দেখা গেছে যে, অন্যান্য জেলার তুলনায় এসব জেলায় রোগীর তুলনামূলক বেড়েছে। এসব জেলায় রোগীর সংখ্যা চলতি সপ্তাহে এর আগের সপ্তাহের তুলনায় অনেক বেশি বেড়ে গেছে। মোট রোগীর সংখ্যা কত বাড়ছে এবং আগের সপ্তাহের চাইতে সংক্রমণ বাড়ার হারের পার্থক্যের মতো বিষয়গুলো দিয়ে ঝুঁকির বিষয়টি পরিমাপ করা হয় বলে জানান তিনি।

সংক্রমণ বেশি ধরা পড়ার একটা কারণ হিসেবে করোনা শনাক্তের পরীক্ষা বা টেস্ট আগের তুলনায় বাড়াকে বিবেচনা করা হচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয় বরিশালের কথা। সম্প্রতি এই জেলাটিকে অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়েছে। এর সংক্রমণের মাত্রা হঠাৎ করেই বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে এ. এস. এম. আলমগীর বলেন, গত দুই সপ্তাহ যাবত বরিশালে শনাক্তের হার বেড়েছে। তবে সেখানে স্যাম্পলিং বা নমুনা পরীক্ষার হারও বেড়েছে। তিনি বলেন, গত জুন-জুলাইতে যেখানে আমরা ১৩-১৪ হাজার স্যাম্পল টেস্ট করতাম এখন সেটা ২৮ হাজার স্যাম্পলও টেস্ট করা হচ্ছে।

যেসব জেলাকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে মাদারীপুর। দুই সপ্তাহ আগেও মাদারীপুরে সংক্রমণের হার ছিল ৭.৭ শতাংশ। কিন্তু মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে এই হার বর্তমানে ১২.৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। মাদারীপুর জেলার সিভিল সার্জন ডা. সফিকুল ইসলাম বলেন, সম্প্রতি যেসব রোগী কোভিডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে আগের তুলনায় কিছু পরিবর্তন এসেছে।

তিনি বলেন, যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে, খুব দ্রুত তাদের অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এ বৈশিষ্ট্য প্রথম ঢেউয়ের সময় যারা আক্রান্ত হয়েছিল তাদের ক্ষেত্রে তিনি দেখেননি বলেন জানান। তিনি বলেন, কিছু বুঝে উঠার আগেই তাদের অক্সিজেনের স্যাচুরেশন লেভেল ফল করছে (কমে যাচ্ছে), তাদেরকে আইসিইউ-তে নিতে হচ্ছে, অনেকের আবার হার্ট অ্যাটাকও হচ্ছে। কিন্তু আগের বার এমন হয়নি।

এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, সংক্রমণের পরিবর্তন বিষয়ে এখনো কোন গবেষণালব্ধ তথ্য না থাকলেও বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ তাদের পর্যবেক্ষণের কথা তাদেরকে জানিয়েছে। ক্লিনিক্যাল প্যাটার্নে কিছু কিছু পরিবর্তন পাওয়ার কথা তারা আমাদের জানিয়েছে। তবে এগুলো শুধু পর্যবেক্ষণ। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রকাশিত কোন প্রতিবেদন নয়।

রোবেদ আমিন বলেন, যেসব পরিবর্তন বা বৈশিষ্ট্যের কথা তারা জানতে পারছেন তার মধ্যে রয়েছে, তরুণদের মধ্যে সংক্রমণ বেশি হওয়া, জ্বরের মাত্রা কম থাকলেও শরীর ব্যথা অনেক বেশি, রেসপিরেটরি প্রবলেম বা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা অনেক বেশি হওয়া।

মুশতাক হোসেন বলেন, যেসব জেলায় সংক্রমণ বাড়তি দেখা যাচ্ছে সেগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, এসব অঞ্চলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান অনেক বেশি পরিমাণে এবং অবাধে হয়েছে। মাস্ক খুলে বদ্ধ ঘরে এক সাথে অনেক মানুষের খাবার খাওয়ার মতো বিষয়গুলোও করোনার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বলে তিনি মনে করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ডা. মোহাম্মদ রোবেদ আমিন বলেন, যেসব জেলাকে উচ্চ ঝুঁকির আওতায় আনা হয়েছে, খেয়াল করলে দেখা যাবে যে, সব কটি জেলাই বেশ বড় এবং জনসংখ্যা অনেক বেশি। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, রাজশাহীর কথা। এসব জেলায় একদিকে যেমন অনেক বেশি মানুষের বাস ঠিক তেমনি জনঘনত্বও বেশি। যার কারণে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার হার বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকা দেয়া নিয়ে মানুষের মনে কিছু ভুল ধারণা রয়েছে। অনেকেই মনে করেন যে একবার টিকা নিলে আর করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি নেই। কিন্তু সেটি ঠিক নয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, টিকার প্রথম ডোজ নেয়ার দুই সপ্তাহ পর দ্বিতীয় ডোজ নেয়া হলে সর্বোচ্চ প্রতিরোধ সক্ষমতা তৈরি হয়। এই সময়ে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

মুশতাক হোসেন বলেন, প্রথম ডোজ টিকা নেয়ার পর অনেকে ভেবেছে যে, করোনা আর আসবে না। এমন ধারণা থেকে স্বাস্থ্যবিধি মানেননি। তাদের দেখে আশপাশের মানুষেরাও স্বাস্থ্যবিধি শিথিল করেছে। যার কারণে তারা আক্রান্ত হয়েছে এবং সর্বোপরি করোনা সংক্রমণ বেড়েছে।

আইইডিসিআর উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন মনে করেন, যে ২৯টি জেলায় আক্রান্তের হার বাড়ছে সেগুলোর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এসব জেলায় মানুষের যাতায়াত বেশি। একই সাথে তারা অবাধে বদ্ধ ঘরে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছে। এছাড়া এসব শহরের সাথে ঢাকা শহরের সাথে যোগাযোগটা অন্য জেলার চাইতে বেশি। যার কারণে দ্রুত গতিতে করোনার সংক্রমণ ছড়িয়েছে।

তিনি বলেন, প্রথম ঢেউয়ের সময় তিন মাসে যে পরিমাণ সংক্রমণ বেড়েছে, এবার মাত্র তিন সপ্তাহে সেই সংক্রমণের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

একই ধরণের তথ্য দিয়েছেন নীলফামারী জেলার সিভিল সার্জন ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবিরও। সম্প্রতি তার জেলাতে সংক্রমণের হার ১০ শতাংশের বেশি ছাড়িয়ে গেছে। তিনি বলেন, তার জেলায় মানুষের যাতায়াত অনেক বেশি। কারণ সেখানে শিল্পাঞ্চল, ইপিজেড, বিমানবন্দর, রেল স্টেশনের মতো জনসমাগম হয় এমন জায়গা বেশি রয়েছে। ফলে প্রতিদিনই হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজন ও উপায়ে যাতায়াত করে থাকে। যা করোনা সংক্রমণকে বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন তিনি।

জাহাঙ্গীর কবির জানান, সম্প্রতি নীলফামারী জেলার অনেক বাসিন্দা ভ্রমণ করে ফিরেছে। সংক্রমণ বাড়ার এটিও একটি কারণ বলে জানান তিনি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ