বিশ্বে করোনা সংক্রমণের তালিকায় ১০ নম্বরে উঠে এল বাংলাদেশ
চলমান মহামারি করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারনে থমকে গেছে পুরো বিশ্ব। করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের সংখ্যা ও প্রাণহানির পরিসংখ্যান রাখা ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটার প্রতিনিয়ত আপডেট দিচ্ছে প্রতিটি দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। করোনা সংক্রমনের এই বিশ্বতালিকায় বাংলাদেশ ১৫ নম্বরে থাকলেও নতুন করে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বিচারে এটি দশ নম্বরে চলে এসেছে।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের ওপরে রয়েছে ভারত, আমেরিকা, ব্রাজিল, রাশিয়া, পেরু, মেক্সিকো, কলোম্বিয়া, আর্জেন্টিনা ও ফিলিপাইন। অথচ মাত্র দুদিন আগেও এ তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩ নম্বরে।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার দেশে নতুন করে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে ২ হাজার ৫৯৫ জন। এদিন ভারতে ৫৪ হাজার ২৮৮ জন, আমেরিকায় ৪০ হাজার ৬১২ জন, ব্রাজিলে ২৩ হাজার ৪৮ জন, কলোম্বিয়ায় ৮ হাজার ৩২৮ জন, পেরুতে ৫ হাজার ৫৪৭ জন, রাশিয়ায় ৪ হাজার ৮৯২ জন, আর্জেন্টিনায় ৪ হাজার ৫৫৭ জন, মেক্সিকোতে ৪ হাজার ৪৪৮ জন ও ফিলিপাইনে ৩ হাজার ৩১৪ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়েছে।
এর দুইদিন আগে অর্থাৎ শনিবার ভারতে ৫৮ হাজার ১০৮ জন, আমেরিকায় ৩৭ হাজার ৬৮২ জন, ব্রাজিলে ২২ হাজার ৩৬৫ জন, কলোম্বিয়ায় ১১ হাজার ৬৪৩ জন, পেরুতে ১০ হাজার ১৪৩ জন, রাশিয়ায় ৪ হাজার ৯৬৯ জন, আর্জেন্টিনায় ৫ হাজার ৪৬৯ জন, মেক্সিকোতে ৬ হাজার ৩৪৫ জন ও ফিলিপাইনে ৩ হাজার ৩২৭ জন নতুন করে করোনায় সংক্রমিত হয়। এ ছাড়া ফ্রান্সে ৩ হাজার ১৫ জন, ইরাকে ৪ হাজার ৩৪৮ জন, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩ হাজার ৬৯২ জন ও স্পেনে ৩ হাজার ৪৯০ জন নতুন রোগী শনাক্ত করা হয়। এদিন বাংলাদেশে শনাক্তকৃত নতুন রোগীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২৪ জন।
এদিকে মঙ্গলবার (২৪ ঘণ্টায়) দেশে নতুন করে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে ৩ হাজার ২০০ জনের শরীরে। যা তিন দিন আগে অর্থাৎ গত শনিবারে শনাক্ত হওয়া রোগীর চেয়ে ১ হাজার ১৭৬ জন বেশি। এবং আগের দিনের (সোমবার) তুলনায় ৬০৫ জন বেশি। অর্থাৎ সংক্রমিত রোগীর বৃদ্ধির হার ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশ।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের এ পরিসংখ্যান পর্যালোচনায় দেখা গেছে, উপরের তালিকার ১০টি দেশের মধ্যে পেরু, মেক্সিকো, কলোম্বিয়া, ফিলিপাইন এই ৪টি দেশে শনিবারের তুলনায় সোমবার নতুন আক্রান্তের সংখ্যা কমেছে। এছাড়া এ তালিকার বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, ফ্রান্স ও ইরাকেও ওই সময় নতুন সংক্রমিত রোগীর সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। এরমধ্যে পেরুতে মাত্র ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে নতুন করে সংক্রমিত রোগী প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। অথচ বিশ্বতালিকার ১৩ নম্বরে থাকা বাংলাদেশে নতুন করে শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়েছে। ফলে নিচের দিকে থাকা তিনটি দেশকে টপকে বাংলাদেশের অবস্থান ১০ নম্বরে এসে দাঁড়িয়েছে।
দেশের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বিশ্বে আক্রান্ত দেশগুলোতে নতুন করে সংক্রমনের হার ক্রমেই নিম্নমুখি হলেও বাংলাদেশে তা অনেকটা একই জায়গায় স্থিতিশীল রয়েছে। বরং সময় সময়ে তা কিছুটা বাড়ছে। করোনা নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের বিভ্রান্তিকর তথ্যে জনসচেতনতা উধাও হয়ে যাওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ পরিস্থিতি চলমান থাকলে দেশে করোনার প্রকোপ হ্রাস পেতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এমনকি আগামীতে এ মরণব্যাধির প্রকোপ আরো ভয়াবহভাবে বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা।
স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নানা প্রতিবন্ধকতা ও ভোগান্তির কারণে টেস্ট করানোর ব্যাপারে সাধারণ মানুষের মধ্যে চরম অনাগ্রহ দেখা দিয়েছে। যা করোনা প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পেতে হলে সবার আগে নমুনা পরীক্ষার সুযোগ বাড়ানো জরুরি। পাশাপাশি এ ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভাইরোলোজি বিভাগের একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে বলেন, দেশের জনসংখ্যার তুলনায় অনেক কম সংখ্যক নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। টেস্ট করতে আসা মানুষজন নানাভাবে হয়রানি-ভোগান্তির শিকার হয়ে এ ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়েছে। এছাড়া ফল পেতে বিলম্ব, টেস্ট ফি ধার্য, নমুনা পরীক্ষায় জালিয়াতি ও ভুল ফলাফলের নেতিবাচক প্রভাব এর উপর পড়েছে। ফলে একান্ত বিপাকে না পড়লে কেউ নমুনা পরীক্ষা করাচ্ছেন না।
বিশেষজ্ঞ ওই চিকিৎসক আরও বলেন, এরকম আংশিক চিত্র দিয়ে একটি দেশের মহামারি প্রতিরোধের কৌশল তৈরি করা সম্ভব নয়। দেশে করোনাভাইরাস মোকাবেলার জন্য কমিউনিটি ভিত্তিক সার্ভেইলেন্স অনেক বাড়াতে হবে। কমিউনিটি পর্যায়ে যাদের উপসর্গ নেই তাদের শনাক্ত করাও জরুরি।
করোনা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, সামাজিক যোগাযোগ যত বাড়বে, করোনা ততই ছড়াবে- এটাই স্বাভাবিক। অথচ দেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে না আসলেও অফিস-আদালত-কলকারখানা ও গণপরিবহনসহ সব জায়গায় আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবনতা পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে। এ সময় যতটা সচেতনতা তৈরি করার কথা ছিল, ততটা আমরা পারিনি। শুরু থেকেই স্বাস্থ্যবিধি মানানোর যে কাজ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসন তা করেনি। মানুষও সচেতন নয়, আইন না মানার প্রবণতা তাদের ভেতরে রয়েছে, কিন্তু সে আইন না মানার কারণে তার শাস্তি কী হতে পারে, এর কোনো উদাহরণও সরকার সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং এ বিষয়টি সাধারণ মানুষের খেয়াল-খুশির উপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। কাউকে আইন মানাতে বাধ্য করা হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া বলেন, দেশের বেশিরভাগ মানুষ এখন মাস্ক ব্যবহার করছে না, সামাজিক দূরত্বও মেনে চলছে না। অফিস-আদালত, কলকারখানা, মার্কেট-শপিংমল ও রাস্তাঘাট সবখানেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবনতা উধাও হয়ে গেছে। হঠাৎ করেই যেন সাবধানতা অনেকটাই কমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে দেশে করোনার আরেকটি ঢেউ আসার আশঙ্কা রয়েছে।